তরিবত
আজ আর রেহাই নেই। দুই অপরাধী মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি। ‘চোরের দশ দিন, গৃহস্থের একদিন’—আজকে আমরা ধরা খেয়ে গেছি! আব্বা প্রতিদিন সকালে অফিস যাওয়ার সময় আমাদের পড়া দিয়ে যান; অফিস শেষে ধরবেন। আব্বা আর্টসের ছাত্র হওয়ায় ইংরেজি গ্রামার আর ট্রান্সলেশনের ওপর ঝোঁক বেশি। ছোট ইঁদুরের দাঁত প্রতিদিনই বাড়ে—আর এ কারণেই বইপত্র-কাপড় সামনে যা পায় কেটে ফেলে। কাটাকুটির প্র্যাকটিসটা বিরতিহীন। আমাদের জন্যও ব্যাপারটা প্রযোজ্য। আমাদের দুষ্টুমির প্র্যাকটিসটাকে দমন করতে আব্বা বড় বড় ছুটির দিনগুলোয় পড়া দিয়ে যান-পড়া ধরেন। ফাঁকে ফাঁকে অফিস থেকে টেলিফোন করে আমাদের মতিগতি সম্বন্ধে আম্মার কাছে খোঁজখবর নেন।
ইমনের অনেক বুদ্ধি। সে গত এক মাস শুধু বীজগণিতের ২.১ অনুশীলনীর [ (a+b)2 = a2+ 2ab+b2 ] দিয়েই আব্বাকে ফাঁকি দিচ্ছে। আমি প্রথম তিন-চারটি ট্রান্সলেশন পড়ার পর ফাঁকে ফাঁকে আরও তিন-চারটি পড়ে সন্ধ্যায় আব্বার মুখোমুখি হই। কিন্তু ইমনের ‘মারি তো গন্ডার, লুঠি তো ভান্ডার’ সিস্টেম। আব্বা অফিস থেকে এসে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরপরই আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জেনে নেন কার কী অবস্থা! ইমন প্রায় প্রতিদিনই পেনসিল কামড়ে গভীর মনোযোগের সঙ্গে অঙ্ক করতে থাকে। আব্বা বিছানায় রেস্টে গেলেই এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের একটি বীজগণিত আব্বার সামনে পেশ করে ‘এটা বুঝি না’। ‘এটা না বুঝলে পরেরটা করো’, আব্বা। দুই-তিন মিনিট পর আরেকটা অঙ্ক দেখিয়ে ‘এটাও বুঝি না, স্কুল খুললে পরীক্ষা হবে; না পারলে স্যার কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখবেন।’ আব্বা বিরক্ত হয়ে, ‘সন্ধ্যায় দেখব, এখন একটু রেস্ট নিতে দাও।’
আজকে সন্ধ্যায় তিনতলার কাজল ভাইকে দেখতে পেয়ে আব্বা বলেন, ‘দেখো তো বাবা কাজল, ইমন কোনো একটা অঙ্ক পারে না।’ কাজল ভাই এর আগেও এই অঙ্ক আরও কয়েক দিন দেখিয়ে দিয়েছিলেন। কিরে ইমইন্যা, এই অঙ্কটা আরও কয়েকবার তোরে দেখাইছি।’ আব্বা তরিবত দেখিয়ে বললেন, ‘আর মারব না, অন্য শাস্তি দিতে হবে।’ আব্বার কাছে বেতই তরিবত! ছেলেপুলে মানুষ করতে হলে আদর-ভালোবাসার সঙ্গে সঙ্গে শাসনেরও দরকার আছে। এ জন্য বাসার মিটসেফের ওপর একটা প্রমাণ সাইজের বেত সব সময় থাকত। এর প্রায়োগিক ব্যবহার খুবই কম, কিন্তু প্রাদর্শনিক ব্যবহার খুব বেশি ছিল। অবশ্য কাজল ভাইয়ের সামনে আমাদের বেত মারতেন না আবার মারতে পারতেনও না। অপশন দুইটা, ‘রিকশা চালাবে, না লাঙল চষবে? আব্বার রাগ দেখে আর একই সঙ্গে সিরিয়াসনেস দেখে আমরা শিওর আমাদের দুটি রিকশা কিনে দেবেন। এতে আমাদের ভবিষ্যতের ব্যবস্থাও হবে আবার বাসায় এক্সট্রা ইনকামের ব্যবস্থাও হবে। আমি লাঙল চালানোর কথা বললে, আম্মা ফুট//// কেটে বললেন, ‘তোমাদের যে সাইজ, গরুর পায়ের তলায় চ্যাপটা হয়ে যাবে।’ কাজল ভাই মিটিমিটি হেসেই চলেছেন। শেষ পর্যন্ত তিনতলার চাচির মধ্যস্থতায় শেষবারের জন্য আমাদের মাফ করা হলো। এ জন্য কান ধরে শপথ করতে হয়েছে।
বিকেলে আসরের আজান শেষ হওয়ার পরপর বাইরে যাওয়ার জন্য আম্মার কাছে তদবির শুরু হয়। সারা দিনের আচার-আচরণ এবং পড়াশোনার হাল দেখে আব্বা ছুটি মঞ্জুর করতেন। যেতে দেরি, কিন্তু বাসায় ফেরত এর বেলায় মাগরিবের আজান শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই দৌড়। মাগরিব শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাত–মুখ ধুয়ে পড়ার টেবিলে। আব্বা নামাজ পড়ে এসে টেবিলে আমাদের উচ্চকণ্ঠে পড়াশোনা দেখে ও শুনে সন্তুষ্ট হলে, আম্মার ডিপার্টমেন্টে আমাদের চালান দিতেন। তখন নাশতার ইন্তেজাম। ‘চা-টা’র চা নেই। তবে আম্মার বিশেষ ক্ষমতাবলে সাহায্যকারী বাসিরের (বশীর) মাধ্যমে চোরাই পথে আমাদের এক কাপ করে চায়ের ব্যবস্থা করে দিতেন।
ছাপরা মসজিদের মক্তবে আজিমপুর কলোনির ছেলে-মেয়েরা আরবি পড়ত—আদব–লেহাজ সম্বন্ধে জ্ঞান নিত। এখানেও তরিবতের প্রধান হাতিয়ার বেত। দুপুরগুলো ছিল নির্জন। রাস্তায় একটা দুইটা রিকশার টুংটাং শব্দ আর মাঝেমধ্যে হকারদের ‘ই-ই-ই ক্যাঁগাজ’ শব্দগুলো অনেক দূর থেকে ভেসে এসে নির্জনতাকে আরও গভীর করত। আমরা দুই ভাই বগলে আমপারা ও মাথায় বড় সাইজের ফেজটুপি পরে পায়জামা সামলে দুপুরে মক্তবে আরবি পড়তে যেতাম। মাঝেমধ্যে আজিমপুর ছাপরা মসজিদের আশপাশে ২৭ নম্বর মাঠের ওই পারে ‘কইলজাখোর খলিলুল্লাহ’কে দেখে জানে পরানে এক হাতে টুপি অন্য হাতে পায়জামা সামলে দৌড় দিয়ে কোন একটি বিল্ডিংয়ের সিঁড়ির মধ্যে পালাতাম। সিঁড়ির খোপ দিয়ে খলিলুল্লাহর মতিগতি অবজার্ভ করতাম। বিরাট বিভীষিকা। ছোট্ট একটি মাথা, ধনুকের মতো বাঁকা শরীর নিয়ে খলিলুল্লাহ ভয়ার্ত ও সতর্ক চোখে আস্তে আস্তে হেঁটে যেত—লিটল অ্যাঞ্জেলেস স্কুল হয়ে আজিমপুর কবরস্থানের দিকে। শরীরে প্রায় সময়ই বোতাম না লাগানো সাদা ময়লা শার্ট আর বুকের কাছাকাছি গিঁট দেওয়া লুঙ্গি পরা খলিলুল্লাহ ছিল আমাদের ছোটবেলার ত্রাস। আশপাশের ছেলেপেলে ও রিকশাওয়ালাদের সিগন্যাল পেলে বের হতাম। বুকের ধুকপুকানি থামতে অনেক সময় লাগত। একদিন পুরান ঢাকার বনগ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়ার সময় রিকশা থেকে খলিলুল্লাহকে দেখে ভয় না পেয়ে আপন মনে হয়েছিল—‘আরে, ওই যে আজিমপুরের খলিলুল্লাহ।’ উনি বোধ হয় আজিমপুর এলাকাতেই শান্তিমতো হেঁটে যেতে পারতেন। কারণ, বনগ্রামের ওই রাস্তায় অনেক ছোট-বড়-সিকি-আধুলি সাইজের বাচ্চা-কাচ্চা-তরুণ-যুবক গালি দিতে দিতে ঢিল ছুড়ছিল। মেডিকেল কলেজে পড়ার সময় আজিমপুর কবরস্থানের দক্ষিণ গেটে খলিলুল্লাহকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখতাম। সেই ছোট্ট মাথাটি ও শীর্ণকায় শরীরটা পরিবর্তিত হয়ে পৃথুলা হয়ে গেছে। কখনো কখনো আশপাশের যানজট নিরসনে রিকশাগুলোকে লাইনমতো চলার জন্য কাজ করত। চোখের ভয়ার্ত-সতর্ক দৃষ্টির পরিবর্তে স্বাভাবিক চাহনি। তখন তাকে দেখলে মানসিকভাবে সুস্থ একজন মানুষই মনে হতো।
ক্যানিবাল (cannibal) নরমাংসভুক মানুষ। ক্যানিবালিজম পৃথিবীর কিছু কিছু এলাকায় সাংস্কৃতিক ও সামাজিক রীতি; আবার খাবারের তীব্র স্বল্পতায় ও বিশেষ পরিস্থিতিতে ক্যানিবালিজমের চর্চা হয়েছে। মানসিক কিছু রোগের কারণেও অনেকে নরমাংসভুক হয়ে যায়। মানসিক সমস্যাগুলোর মধ্যে কুরু ডিজিজ (Kuru Disease)-নিউরো ডিজানেরেটিভ ডিজঅর্ডার (Neuro Degenarative Disorder), প্যারানয়েড সিজোফ্রেনিয়া (Paranoid Schizophrenia), প্যারাফিলিয়া (Paraphilia)—অস্বাভাবিক যৌন বিকারগ্রস্ততা। এদের কারও কারও মধ্যে স্যাডিসটিক পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার (Sadistic Personality Disorder) থাকে—অন্যের ওপর অত্যাচার, নিপীড়ন, ভয় প্রদর্শনও অনেককে ক্যানিবালে রূপান্তর করে।
‘এই কে, কে ওখানে?’ লাউডস্পিকারের মতো এই আওয়াজটি আমাদের ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলের হেডস্যার আবদুর রশিদ সরকার স্যারের। বৈরুত ইউনিভার্সিটির পিএইচডি হেডস্যার সব সময়ই স্যুটেড-বুটেড। হাতে জালিবেত। এই স্কুলের ছাত্রদের শিক্ষা, সহবত শেখানোর জন্য অর্থাৎ তরিবতের জন্য যা দরকার তার একটি ছোটখাটো নমুনা। আগে দর্শনধারী, পরে গুণবিচারী—স্যারের লাউডস্পিকার কণ্ঠস্বর, ব্যক্তিত্ব দিয়েই ক্রমক্ষয়িষ্ণু এককালের বিখ্যাত স্কুলের ঐতিহ্য ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। দুষ্টু ছাত্রদের মধ্যে বেশি ইঁচড়ে পাকাগুলো স্কুল বিল্ডিংয়ের বাইরের টয়লেটে গিয়ে সিগারেট ফুঁকে এবং বনালা ছাত্ররা দেয়াল টপকে বাইরে গিয়ে চার আনা-আট আনা দিয়ে মামুর হালিম-চটপটি খেয়ে শার্টের কলারে ঝাড়া দিয়ে আবার স্কুলে ঢুকে পড়ত। স্যারের সিম্বল এই লম্বা জালি বেতের ব্যবহার খুব একটা দেখিনি।
মাঝেমধ্যে অনিবার্য কারণে কোনো শিক্ষক ক্লাসে আসতে না পারলে গেম টিচার ছোটখাটো গড়নের আমির আলী স্যার চুপচাপ ক্লাসে ঢুকে পড়তেন। হাতে ৬ ইঞ্চি থেকে ৯ ইঞ্চি সাইজের বেত প্রদর্শন করে ছেলেদের তরিবত শিক্ষা দিতেন। ‘এই যে এটা দেখতে পাচ্ছ, দু’ঘা এমন জায়গায় দেব, উফ্ করবে; বাসায় গিয়ে বাবাকে দেখাতে পারবে না, মাকে দেখাতে পারবে না, ভাইকে দেখাতে পারবে না। শুধু বাথরুমে গিয়ে নিজেই চেক করতে পারবে।’
অনেক দিন পর একদিন আমাদের আজিমপুরের বাসায় সেই ওয়েস্ট অ্যান্ড হাইস্কুলের একজন শিক্ষককে পরম মমতায় হাত ধরে নিয়ে আসে ইমন। বেসরকারি স্কুল হওয়ায় চাকরিজীবনের শেষে প্রায় সব টিচারই অসহায় হয়ে পড়েন। যারা বিজ্ঞান ও ইংরেজি শিক্ষক না তাদের জন্য ব্যাপারটা আরও কষ্টদায়ক। খুব যত্নে সোফায় বসিয়ে চা–নাশতা পরিবেশন করে স্যারের কাছ থেকে ঠিকানা জোগাড় করে রিকশায় উঠিয়ে দিয়েছে। একদিন পর আব্বার কাছে স্যারের জন্য তদবির করে কোনো কিছু করা যায় কি না, পরামর্শ চেয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপারটা হচ্ছে সে যখন স্যারের জন্য তদবির করছিল, তখন তার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। পরে তার বন্ধু এবং পরিচিত স্কুলের অন্য ছাত্রদের নিয়ে একটা ফান্ডের ব্যবস্থা করে দেয়।
আসলে তরিবত শিক্ষার জন্য বেতের প্রায়োগিক ব্যবহার খুব একটা দরকার না। শ্রদ্ধা, সম্মানবোধ, গুরুজনদের কথা ও নৈতিক শিক্ষা মানুষকে অনেক মানবিক ও শক্তিশালী করে। আব্বা আবদুর রহমান সাহেব এবং শিক্ষকেরা কথা দিয়ে বুঝিয়ে, মাথায় হাত বুলিয়ে, বুকে জড়িয়ে ধরে যে নৈতিক শিক্ষা, পুঁথিগত শিক্ষা ও ধর্মীয় শিক্ষা দিয়েছেন, সেটা প্রতিটি রক্তকণিকায় এমনভাবে সেট হয়েছে যে অনেকবার চেষ্টা করেও লাইনছাড়া হতে পারিনি।
* লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।