পড়াশোনার চাপ বনাম সৃজনশীলতা: একজন শিক্ষার্থী যা দেখেন
শিক্ষা মানুষের অন্যতম মানবাধিকার, যেভাবে একজন ব্যক্তির বেড়ে ওঠার জন্য খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ সঠিক সময়ে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তার সঙ্গেই জীবনযাপনের মান উন্নয়নের জন্য অন্যতম এক মাধ্যম হলো শিক্ষা। একটি শিশু বেড়ে ওঠার সময় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমে গুরুজনদের সম্মান করা থেকে শুরু করে ছোটদের স্নেহ করা, সহপাঠীদের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ আচরণ করার মতো যে অসংখ্য মানবিক গুণাবলিগুলো অর্জন করে, তা কোনোভাবেই অন্য কোনো পরিবেশে অর্জন করা সম্ভব নয়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় মাতৃভাষা, জন্মভূমি, ইতিহাস, ধর্মীয়, সামাজিক প্রভৃতি জ্ঞানসহ বিজ্ঞান ও বহির্বিশ্বের নানা ভাষা ও বিবিধ বিষয় নিয়েও শিক্ষার্থীদের চর্চা করার সুযোগ দেয়। তাই জীবনে জ্ঞানচর্চার সূচনার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক বইয়ের বিকল্প নেই। তবে এই জ্ঞানের পরিধি ব্যপ্ত করার একমাত্র উপায় সৃজনশীলতা।
সৃজনশীলতা হলো নতুন এবং কল্পনাপ্রসূত ধারণাকে বাস্তবে পরিণত করার কাজ। সৃজনশীলতা বিশ্বকে নতুন উপায়ে উপলব্ধি করার, লুকানো নিদর্শনগুলো খুঁজে বের করার, আপাতদৃষ্টিতে সম্পর্কহীন ঘটনার মধ্যে সংযোগ স্থাপন এবং সমাধান তৈরি করার ক্ষমতা দ্বারা চিহ্নিত করা হয়।
সহজ কথায় সৃজনশীলতা হলো কোনো বিষয় বা সমস্যা সম্পর্কে নতুন বা ভিন্ন উপায়ে চিন্তা করার যে ক্ষমতা; অথবা জটিল সমস্যার নতুনত্ব কোনো সমাধান খুঁজে পাওয়ার জন্য কাল্পনিক চিন্তাধারাকে বাস্তবে রূপান্তর করার যে প্রবণতা।
কেন সৃজনশীলতার বিকল্প নেই?
বর্তমান বিশ্ব আধুনিকতার, সম্ভাবনার যা ক্রমান্বয়ে নতুন ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলেছে। নতুন চিন্তাধারাকে স্বাগত জানানোর বর্তমান এই বিশ্বে সৃজনশীলতার কোনো বিকল্প নেই।
জ্ঞানচর্চার সূচনা পাঠ্যপুস্তক থেকে হলেও শুধুই বইয়ের সীমিত জ্ঞানই যথেষ্ট নয়, কেননা জানার ক্রমাগত আগ্রহই নতুন কিছুর উদ্ভব ঘটায়। পাঠ্যপুস্তকের সীমিত জ্ঞানে সীমাবদ্ধ থাকলে কখনোই নতুন কিছুর আবিষ্কার হতো না। নতুনত্ব, আরও উন্নত, আরও সহজ—সবকিছু আরও সরল করার ক্রমাগত চেষ্টাই আজ পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তাই জ্ঞানকে অর্জনের পাশাপাশি বাস্তবিকভাবে তা মূল্যায়ন করা আবশ্যক। শুধু তা–ই নয়, ক্রমাগত চর্চার মাধ্যমে সৃজনশীল চিন্তাকে আরও বেশি বৃদ্ধি করতে হবে। জ্ঞানচর্চার সঙ্গে সৃজনশীলতার চর্চাও শিক্ষাজীবন এর মুখ্য একটি অংশ।
সৃজনশীল চর্চার গুরুত্ব
মানসিক চিন্তাচেতনা ও বুদ্ধিমত্তা বিকাশে পড়ালেখার পাশাপাশি সৃজনশীলতা চর্চারও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে:
জ্ঞানভিত্তিক উন্নয়ন
সৃজনশীলতা চর্চার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের দক্ষতা, জগৎ সম্পর্কে জানার আগ্রহ, অধিক জিজ্ঞাসা করার মনোভাব ইত্যাদি চিন্তাধারার বিকাশ ঘটে।
সামাজিক বিকাশ
দলগত সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে বাকিদের সঙ্গে মতবিনিময়, আদান–প্রদান, পরস্পরের সহযোগিতা করাসহ নানা ধরনের সামাজিক দক্ষতার বিকাশ ঘটে।
মানসিক বিকাশ
সৃজনশীল চিন্তা মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটায়, যা পরিস্থিতি অন্বেষণে এবং নতুন ধারণা তৈরিতে সাহায্য করে।
আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি
সমস্যা সমাধানের দক্ষতা কিংবা যেকোনো পরিস্থিতি অন্বেষণের চেষ্টা স্বাভাবিকভাবেই নিজের ওপর আস্থাকে আরও দৃঢ় করে।
দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
সৃজনশীল চিন্তাধারা যেকোনো নতুন চিন্তা বা মতান্তরকেও স্বাগত জানায়; কারণ, তা সীমিত জ্ঞানের ঊর্ধ্বে ভাবতে শেখায়, ফলে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ও জ্ঞানের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে থাকে।
একাগ্রতা বৃদ্ধি
ক্রমাগত চিন্তা করার প্রবণতা ও সৃজনশীলতা চর্চা যেকোনো কাজেই আরও বেশি মনোযোগ, মনোনিবেশ করার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
শারীরিক সুস্থতা
হতাশা, বিষণ্নতা ও মানসিক চাপকে হ্রাস করতে এবং শারীরিক ও মানসিক বিকাশের মাধ্যমে স্বাস্থ্যের উন্নতির ক্ষেত্রেও সৃজনশীল চিন্তাধারার ভূমিকা রয়েছে।
উদ্ভাবন
জটিল ও ভিন্ন চিন্তাধারার যেকোনো কিছুই নতুন আবিষ্কার বয়ে আনে, যার সূচনা সৃজনশীলতার মাধ্যমেই সম্ভব।
রিসার্চ ইন সায়েন্টিফিক আমেরিকান মতে, সৃজনশীলতা মৃত্যুর ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে; কারণ, মস্তিষ্ককে সুস্থ রাখাই সফলভাবে বার্ধক্য হওয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর মধ্যে একটি আর উচ্চতর সৃজনশীলসম্পন্ন ব্যক্তিদের বৃদ্ধ বয়সেও নিউরাল নেটওয়ার্কের সংযোগগুলো অধিক সচল থাকে, তা ছাড়া সৃজনশীল ব্যক্তিরা মানসিক চাপকে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখে, তারা সেটাকে কখনো অতিক্রম করতে পারবে না, এমন না ভেবে বরং সেই মোকাবিলাগুলোকে কীভাবে অতিক্রম করা যায়, তার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে।
জার্নাল অব এজিং অ্যান্ড হেলথের জুন ইস্যুতে প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে অধিকতর মুক্তচিন্তার অধিকারী মানুষের দীর্ঘ জীবনযাপনের সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশি হয়, এবং গত বছরের অন্যান্য গবেষণায় এটিকে নিম্ন বিপাকীয় ঝুঁকি, সুস্বাস্থ্যের হার বৃদ্ধি এবং উপযুক্ত স্ট্রেস প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা
বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা অনেকাংশেই পাঠ্যপুস্তকমূলক শিক্ষাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ তৈরি করে, পাঠ্যক্রমের সীমিত জ্ঞানকেই বিশেষভাবে প্রাধান্য দেওয়ার যে প্রবণতা আর এর ঊর্ধ্বে চিন্তা না করতে দেওয়ার পারিপার্শ্বিক চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশকে ক্রমাগত বাধাগ্রস্ত করে থাকে। তা ছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক ফলাফল নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এক প্রকার দম্ভ কিংবা স্বনামধন্য হওয়ার আকাঙ্ক্ষা এই প্রতিযোগিতাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে।
বর্তমানে শিক্ষাব্যবস্থার এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার অন্যতম একটি বড় অংশ -বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিযুদ্ধ। যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রায় এক বছরের ওপর কঠোর পরিশ্রম ও পড়াশোনার চাপসহ নানা ধরনের মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। অধিকাংশ শিক্ষার্থী সেরা জায়গায় ভর্তির সুযোগ না পেলে বরাবরই উন্নত শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। অনেক সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের প্রতি শিক্ষকদের অবহেলা, ক্লাস না নেওয়ার প্রবণতা, প্রশাসনের দায়িত্বহীনতাসহ নানা কারণে জ্ঞানের বিকাশকে আরও সীমাবদ্ধ করে দেয়।
একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫-৭১ শতাংশ শিক্ষার্থী মাঝারি থেকে গুরুতর বিষণ্নতা, উদ্বেগ এবং মানসিক চাপ অনুভব করে। আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে যে বাংলাদেশে ২৮ দশমিক ৭ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা বিষণ্নতায় ভোগেন।
স্কুল ও কলেজভিত্তিক পড়াশোনাও এখন পাঠ্যপুস্তককেন্দ্রিক। মাধ্যমিক (এসএসসি) ও উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) বোর্ড পরীক্ষার ফলাফলকে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে প্রতিবছর বহু শিক্ষার্থীরা আশানুরূপ ফলাফল না পেয়ে ঝরে পরে, যার মধ্যে প্রায় ১০-১৩ জন শিক্ষার্থী পারিবারিক ও সামাজিক চাপে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩-১৭ বছর বয়সী ছাত্রদের মধ্যে, ৪ দশমিক ৪ শতাংশ ছেলে এবং ৫ দশমিক ৮ শতাংশ মেয়েরা আত্মহত্যা করে, যার অন্যতম প্রধান কারণ পড়াশোনার চাপ ও পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল না করতে পারা। (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন, ১২ জুন ২০২৪)
পড়ালেখার পাশাপাশি সহপাঠ্যক্রম–সংক্রান্ত কার্যক্রম, যেমন শারীরিক শিক্ষা, গণিত অলিম্পিয়াড, বিতর্ক, জিমন্যাস্টিক, দাবা, ইত্যাদি বেসরকারি স্কুল–কলেজে কিছুটা প্রাধান্য দেওয়া হলেও সরকারি স্কুল–কলেজে এর চর্চা নেই বললেই চলে। অন্যদিকে পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম যেমন সংগীত, নাটক, সাঁতার, স্পোর্টস; ক্রিকেট, ভলিবল, ফুটবল , বাস্কেটবল, শিল্পকলা, বিতর্ক, ক্লাব, বিদেশি ভাষা, ইন্টার্নশিপ ইত্যাদি নিয়ে পর্যাপ্ত চর্চা কিংবা সঠিক গুরুত্ব উপলব্ধি করানোর পরিবেশ বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় খুবই কম দেখা যায়। অথচ এই কার্যক্রমগুলোর মাধ্যমে একটি শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে; যেমন সৃজনশীল চিন্তা, কল্পনা, চিন্তাধারার বৃদ্ধি, স্মৃতিশক্তির ইত্যাদি বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন
সৃজনশীলতার চর্চার সূচনা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই হতে হবে। শিক্ষার্থীদের মুক্তচিন্তার সুযোগ দিতে হবে, পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞানচর্চার ওপর যেমন ফলাফল নির্ধারণ করা হয়, সেভাবেই সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের জন্য প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের বিকাশ ঘটাতে হবে যাতে প্রত্যেকেই নতুন আবিষ্কার, নতুন চিন্তার, নতুন সম্ভাবনার অংশ হতে পারে। সায়েন্স প্রজেক্ট, কেস কম্পিটিশনসহ আরও নতুন নতুন সৃজনশীলমূলক প্রতিযোগিতা, যা শিক্ষার্থীদের বইয়ের সীমিত জ্ঞানের বাহিরেও চিন্তার জন্য অনুপ্রেরিত করবে।
সৃজনশীল দক্ষতার শিক্ষা
সৃজনশীল দক্ষতাগুলোকে হাতে–কলমে ক্লাসরুমে শেখানোর ব্যবস্থা করলে শিক্ষার্থীরা সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করার পরিপূর্ণ আগ্রহ পাবে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদেরকে কিছুটা ভিন্ন, জটিল চিন্তাভাবনা করতে উদ্বুদ্ধ করার সবচেয়ে অন্যতম কিছু উপায়ের মধ্যে একটি হলো স্টেম কার্যক্রম পরিচালনা।
স্টেম কার্যক্রম হলো নানা সৃজনশীল প্রকল্প এবং পরীক্ষা সমন্বিত কিছু কর্মকাণ্ড যেখানে বৈজ্ঞানিক নীতিগুলোকে হাতে-কলমে শিক্ষা দেওয়া হয়। STEM - Science , Technology , Engineering & Mathematics এর সংক্ষিপ্ত রূপ। স্টেম কার্যক্রমে কয়েকটি ধাপ:
১. চ্যালেঞ্জ শনাক্তকরণ: প্রথমে শিক্ষার্থীদের একটি প্রশ্নের সম্মুখীন করা কিংবা একটি পাজল ছুড়ে দেওয়া।
২. বুদ্ধিমত্তার ধারণা: শিক্ষার্থীদের তাদের ধারণা এবং সমাধান বিনিময় করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।
৩. প্রাথমিক সমাধান: প্রথমে কিছু ধারণার ভিত্তিতে প্রাথমিকভাবে একটি সমাধান তৈরি করা কিংবা কাঠামো সাজানো।
৪. পরীক্ষার মাধ্যমে উন্নতিসাধন: সমাধানটি কতটা যৌক্তিক, তা ক্রমাগত প্রশ্ন করা বা পরীক্ষা করার মাধ্যমে উপলব্ধি করতে থাকা, একই সঙ্গে এটিকে আরও সরল ও সহজতর করার চেষ্টা করা।
৫. ফলাফলের ব্যাখ্যা: তৈরিকৃত সমাধান যথাযথ যুক্তি দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা।
এই STEM কার্যক্রম শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে:
* স্মৃতি শক্তি বৃদ্ধিতে
* সমস্যা সমাধানের দক্ষতা তৈরিতে
* সৃজনশীলতাকে উৎসাহিত করতে
* ভাষার দক্ষতা বৃদ্ধিতে
* সৃজনশীল দক্ষতাগুলো শেখার আগ্রহের পাশাপাশি চর্চা বৃদ্ধিতে
ইউ.এস. ব্যুরো অফ লেবার স্ট্যাটিস্টিকস–এর মতে, STEM–সম্পর্কিত পেশাগুলো এখন থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে, যেখানে STEM-বহির্ভূত পেশাগুলোর জন্য ৩ দশমিক ৪ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
তা ছাড়া আরও কয়েকটি উপায়ে পড়াশোনার পাশাপাশি সৃজনশীল চিন্তাধারায় শিক্ষার্থীদের উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
প্রজেক্টভিত্তিক পড়াশোনা
শিক্ষার্থীরা প্রজেক্টভিত্তিক পড়ালেখার মাধ্যমে নিজেদের পাঠ্যক্রমে অর্জিত জ্ঞানকে বাস্তবেও ব্যবহার করার সুযোগ দিতে হবে; যেখানে শিক্ষকেরা থাকবেন তাঁদের সর্বোচ্চ সহায়ক হিসেবে, যাঁরা তাঁদের মুক্তচিন্তায় কোনো রকম বাধা দেবেন না বরং তাঁদের নিজস্ব সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ স্বাধীনতা দেবে।
জানার ইচ্ছাকে উৎসাহিত করা
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় আলাদা আলাদা কর্নার কিংবা ক্ষেত্র স্থাপন করা যেতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীদের নতুন নতুন বিষয় যেমন জীবনচক্র, আবহাওয়া, বায়ুমণ্ডল ইত্যাদি নিয়ে উপলব্ধি করতে বলা হব। তার জন্য প্রতিটি কর্নারে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করার জন্য এক্সপেরিমেন্টমূলক আইটেম থাকবে, যা থেকে তারা হাতে–কলমে শিখার সুযোগ পাবে এবং আবিষ্কারগুলো উপভোগ করবে পারবে।
সামগ্রিক সমাধানের উন্নতি
শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যার সমাধানের আরও সরল প্রক্রিয়া বা সহজতর উপায় খোঁজার মতো কার্যক্রম দিতে হবে। যেমন আরও সহজে পেনসিল শার্প করা যায়, এমন নতুন শার্পনার এর একটি মডেল তৈরি বা কম খরচে ও কম পরিশ্রমে মালামাল পরিবহন করা যায়, কিংবা বৃক্ষরোপণ করা যায়—অর্থাৎ আরও উন্নতর সমাধান কীভাবে বের করা যায়, তার ক্রমাগত চর্চা করানো।
কল্পনাচিত্র নির্মাণ
শিক্ষার্থীরা বরাবরই কাল্পনিক গল্প নিয়ে ভাবতে অধিক পছন্দ করে থাকে, তাই তাদের এই কল্পনাশক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ গল্পের নতুন চরিত্র, নতুন প্লট, নতুন কাহিনি নির্মাণ করে একটি গল্প আকারে প্রকাশ করার টাস্ক দেওয়া যেতে পারে, যেখানে তাদের গল্পকে আরও আগ্রহ নিয়ে ব্যক্ত করার জন্য গল্পটি নিয়ে নিজেদের আকা ছবিও এর সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ করতে পারে।
সহপাঠ্যক্রম ও পাঠ্যক্রমবহির্ভূত কার্যক্রম পরিচালনা: শিল্পচর্চা ও সৃজনশীলতা চর্চা অনেক আংশেই একে অপরের পরিপূরক বলা যায়। কেননা অনেক ক্ষেত্রেই শিল্পই সৃজনশীল চিন্তাধারার সূচনায় সাহায্য করে থাকে। যেমন:
নাটক: পাঠ্যক্রমে যেকোনো নাটক বা উপন্যাস কিংবা ঐতিহাসিক ঘটনার চরিত্রগুলো সাজিয়ে অভিনয় করার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দিয়ে একটি নাটকের আয়োজন করানো যেতে পারে, যেখানে তারা নিজ নিজ সংলাপ বিনিময়ের মাধ্যমে সেই ঘটনা সম্পর্কে আরও ভালোভাবে জানতে পারবে।
ছবি আকা: যেকোনো নির্দিষ্ট কোনো বিষয়, অধ্যায় অথবা সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে শিক্ষার্থীদের নিজের আকা ছবি প্রদর্শনীর প্রকাশ করার মাধ্যমে সৃজনশীলমূলক চিন্তাকে উদ্বুদ্ধ করা যেতে পারে।
বক্তৃতা বা কবিতা আবৃত্তি: বিশেষ দিবস উপলক্ষে বা ঐতিহাসিক কোনো ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের কবিতা কিংবা বক্তৃতা লিখার টাস্ক দেওয়া যেতে পারে, যা তাদের সেই নির্দিষ্ট দিবস পালনের বা ইতিহাসের গুরুত্বকে আরও বেশি উপলব্ধি করার পাশাপাশি শিক্ষক এর সহায়তায় বক্তৃতা/ আবৃত্তির সঠিক চর্চার মাধ্যমে তা উপস্থাপন করে সৃজনশীল চিন্তার বিকাশ ঘটানো যেতে পারে।
কেন শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন একান্ত জরুরি
বেসরকারি সংস্থা আচল ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে অন্তত ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। ৫১৩ জনের মধ্যে ২২৩ জন স্কুলছাত্র, ১৪০ কলেজছাত্র, ৯৮ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র এবং ৪৮ জন মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। এ ছাড়া নিহতদের মধ্যে ২০৪ জন ছাত্র এবং ৩০৯ জন ছাত্রী ছিল। মানসিক যন্ত্রণা ও হতাশাকে শিক্ষার্থী আত্মহত্যার প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করলেও পরীক্ষায় ভালো ফলাফলের জন্য পরিবার থেকে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি, পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ এবং পাবলিক পরীক্ষায় চান্স না পাওয়া ইত্যাদি কারণগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন
এ ছাড়া বাংলাদেশে স্নাতকদের মধ্যে আত্মহত্যার উচ্চহার এর প্রধান কারণ হলো বেকারত্ব, দারিদ্র্য যা ক্রমান্বয়ে তাদের হতাশা ও বিষণ্নতার দিকে ঠেলে দেয় এবং সেটি পরবর্তী সময়ে আত্মহত্যার চিন্তার দিকে পরিচালিত করে থাকে; আবার অনেক শিক্ষার্থী অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেও জড়িয়ে পড়ে। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের চাকরির ভবিষ্যৎ ২০২৩ রিপোর্টে অনুযায়ী, ২০২৭ সালের মধ্যে চাকরির বাজারে সর্বোচ্চ চাহিদার শীর্ষে যে দক্ষতাটি অবস্থান করবে তা হলো সৃজনশীলতা। তাই বেকারত্ব, দারিদ্র্য, মানসিক চাপের মতো শিক্ষার্থী আত্মহত্যার অন্যতম প্রধান কারণসমূহকে হ্রাস করতে হলে শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্মূল্যায়ন একান্তু জরুরি।
*লেখক: সামিহা তাসনিম, শিক্ষার্থী, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়