বাবা বটের ছায়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

শাওন আর শায়লার কোনো ছেলে নেই। দুটো মেয়ে নাম চন্দ্রা আর তন্দ্রা। বড় মেয়ে চন্দ্রার বয়স খুব বেশি হলে আট বছর হবে। এ বছর তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ছে চন্দ্রা। আর ছোট মেয়ে তন্দ্রার বয়স পাঁচ–ছয় বছর মতো। কয়েক মাস হচ্ছে তন্দ্রা স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। ওদের বাবা শাওন আদর করে দুই মেয়েকে ডাকে চন্দ্রা মণি আর তন্দ্রা মণি মা বলে।

আর ডাকবেই–বা না কেন? ওরা দুই বোন চন্দ্রা আর তন্দ্রাই যে ওদের মা-বাবার প্রাণ। কলিজার টুকরা, দুটি চোখের মণি। বলতে গেলে মেয়ে দুটোর জন্যই শাওন আর শায়লার পৃথিবীতে বেঁচে থাকা। ওরা দুই বোনই যেন ওদের বাবা-মার পৃথিবী।

কখনো মেয়ে দুটোকে ওরা চোখের আড়াল হতে দেয় না। বটবৃক্ষের ছায়ার মতো আদর, স্নেহ, আর ভালোবাসার সুশীতল মায়ার চাদরে আগলে রাখে মেয়ে দুটোকে। প্রতিদিন সকালে শায়লা ঘুম থেকে উঠে ওয়াশ রুমে গিয়ে দাঁত মেজে ফ্রেস হয়ে ওজু করে এসে ফজরের নামাজ শেষ করে। যখন সে তার কুকিং রুমে চন্দ্রা–তন্দ্রা আর ওদের বাবার জন্য ব্রেকফাস্ট তৈরি করতে যায়।

তখন ওদের বাবা শাওন দুই মেয়েকে ডাকে। বলে কই, আমার চন্দ্রা মণি তন্দ্রা মণি মা। সকাল হয়ে গেছে যে উঠতে হবে না? তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ো মায়েরা আমার। নাশতা করে স্কুলে যেতে হবে যে। তারপর ঘুম ভাঙানোর গান গেয়ে নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তোলে দুই বোনকে। ওদের দুই বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে পিতৃ স্বেহ ভরা আদর মাখা চুম্বন দিয়ে ডাকে আর গান গাই।
গানটি হলো...

ও আমার চন্দ্রা মণি তন্দ্রা মণি মা...
খোলো এবার আঁখি...
দ্যাখো, ঐ পুব আকাশের ঊষার কিরণ
কেমন, দিচ্ছে ঘরে উঁকি।।
বাইরে, কতো, কাননজুড়ে ফুল ফুটেছে
গোলাপ, বকুল সূর্যমুখী...
শোনো, ঐ বৃক্ষের শাখায় মিষ্টি সুরে
ডাকছে ঘু-ঘু দোয়েল পাখি।।

ওদিকে রান্না ঘর থেকে শায়লা শাওনের গান শুনে ঠোঁটের কোণে অস্ফুটস্বরে হাসি ফুটিয়ে বিড়বিড় করে নিজে নিজে বলে হু...যেমন দুই মেয়ে। তেমন তাদের মেয়ে পাগলা বাপ। সব পারেও বটে...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

একসময় শাওনের গান শেষে চন্দ্রা–তন্দ্রাও জেগে ওঠে মিষ্টি হেসে বাবা বলে শাওনকে জড়িয়ে ধরে। তারপর দুই মেয়ে চন্দ্রা মণি আর তন্দ্রা মণির ব্রাশ করিয়ে হাত মুখ ধোঁয়ায় নাশতা শেষে বইয়ের ব্যাগ গুছিয়ে মেয়ে দুটোকে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে।

এভাবে শাওন প্রতিদিন সকালে অফিসে যাওয়ার পথে মেয়ে দুটোকে স্কুলে দিয়ে যায়। আবার স্কুল ছুটির পর ওদের মা শায়লা বেগম নিজে গিয়ে স্কুল থেকে মেয়েদের বাড়ি নিয়ে আসে। এতটাই ভালোবাসে শাওন মেয়ে দুটোকে। অফিস শেষে প্রতিদিন সন্ধ্যায় যখন বাড়ি ফেরে। এসেই অমনি দুই মেয়েকে ডাক দেয়। কই, আমার চন্দ্রা মণি,  তন্দ্রা মণি মায়েরা? এই দ্যাখো তোমাদের জন্য কি এনেছি? যেইনা শাওনের কণ্ঠ, ওদের দুই বোনের কানে পৌঁছায়। অমনি ওরা আব্বু এসেছে... আব্বু এসেছে...বলতে বলতে আনন্দ করতে করতে ছুটে এসে দুই বোন দুই দিক থেকে শাওনকে জড়িয়ে ধরে। শাওনও দুটি হাত বাড়ায় স্নেহ ভরা আদরের চুম্বন দিয়ে মেয়ে দুটোকে কোলে তুলে নেয়। দুই মেয়ে চন্দ্রা মণি আর তন্দ্রা মণিকে নিয়ে স্বর্গ সুখে ভরা যেনো শাওন আর শায়লার সাজানো ছোট্ট সংসারটি।

কিন্তু এ সুখ যে বেশিদিন ওদের ভাগ্যে সইলো না।

আর তাই তো কিছুদিনের মাথায় এক দিন শাওন যখন মেয়েদের হাত ধরে স্কুলে দিয়ে। বাইক নিয়ে তার অফিসে যাওয়ার জন্য রাস্তায় উঠল। চন্দ্রা আর তন্দ্রা তখনো স্কুলের গেটে দাঁড়িয়ে ওরা ওদের বাবার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে।

হঠাৎ! পিছন দিক থেকে দ্রুতগামী মালবোঝাই একটা ট্রাক এসে প্রচণ্ড জোরে ধাক্কা দিলো শাওনকে। শাওন তার বাইকসহ ছিটকে গিয়ে পড়ল দূরে। বাবার ওই অবস্থা দেখে দুই বোন চন্দ্রা আর তন্দ্রা বাবা বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠে বইয়ের ব্যাগ ফেলে ছুটে গিয়ে শাওন-কে জড়িয়ে কাঁদতে লাগল। আশপাশের সব লোকজন ছুটে এল। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছে শাওনের মাথা থেকে। চন্দ্রা আর তন্দ্রা বাবা...বাবা...বলে হাউমাউ করে কাঁদছে আর উপস্থিত লোক-দেরকে বলছে আপনারা কেউ আবার বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে বাঁচান, দয়া করে আমাদের বাবাকে বাঁচান। তাদের মধ্য থেকে একজন বললো এই কেউ একজন তাড়াতাড়ি একটা গাড়ি আনুন তো, উনাকে এখুনি হাসপাতালে নিতে হবে। কেউ কেউ  শাওনকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য গাড়ি খুঁজছে। কেউ বা- গাড়ি থামানোর চেষ্টা করছে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

শাওন কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। রক্তে ভিজে যাচ্ছে শাওনের দেহের কাপড়চোপড় আশ-পাশ সব। রক্তাক্ত শরীরে শাওন কোনরকম হাত তুলে দুই মেয়ে চন্দ্রা তন্দ্রার মাথায় মুখে হাত দিয়ে খুব কষ্টে  বললো। আ..আ..মার...চ-ন্দ্রা...ত-ন্দ্রা...

মা...ম...ণি..। তারপর, শাওনের হাত ধীরেধীরে নিস্তেজ হয়ে নিচে পড়ে গেল। আশপাশের লোকজন বলতে লাগল আহারে!..লোকটা মারা গেছে। এখন এই ছোট ছোট মেয়ে দুটোর উপায় কী হবে? এই বয়সে মেয়ে দুটো যে এতিম হয়ে গেলো। বাবা মারা গেছে এ কথা শুনে। চন্দ্রা তন্দ্রা পাগলের মতো ওদের বাবা শাওনকে জড়িয়ে ধরে আঁচড়াপিচড়ে করে কাঁদতে লাগল। সংবাদ দেওয়া হলো বাড়িতে। কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এল শাওনের স্ত্রী শায়লা। স্বামী শাওনের রক্তমাখা লাশ দেখে কেঁদে ফিটের পরে ফিট হতে লাগল।

একমুহূর্তে শেষ হয়ে গেলো সব। ঘোর অমানিষা নেমে এল সাজানো একটি সংসারে তিন তিনটি জীবিত মানুষের জীবনে। শাওনের মৃত্যুর পর মাঝেমধ্যে ঘুমের মধ্যে বড় মেয়ে চন্দ্রা শাওনের এক্সসিডেন্টের সেই দৃশ্য স্বপ্নে দেখে মাঝরাতে বাবা বলে চিৎকার করে কেঁদে জেগে ওঠে। চন্দ্রা ওর বাবার মর্মান্তিক এক্সসিডেন্টের সে ঘটনা ভুলতে পারে না।

আজ ওরা পিতৃহীন এতিম। অথচ চন্দ্রা তন্দ্রাদের স্কুলে আজ বাবা দিবস পালিত হচ্ছে। শুধু যে ওদের স্কুলে তা নয়। প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার সারা বিশ্বে এখন মা দিবসের মতো বিশ্ব বাবা দিবসও পালিত হয়। চন্দ্রা তন্দ্রাদের স্কুলের সহপাঠীদের সবার বাবা এসেছে স্কুলে। কিন্তু চন্দ্রা তন্দ্রার বাবা বেঁচে না থাকায়। ওদের সঙ্গে ওদের মা শায়লা বেগম এসেছে।

এক এক করে সব ছেলেমেয়েরা তাঁদের বাবাদের সম্পর্কে বলছে। একসময় চন্দ্রাকে তার বাবাকে নিয়ে কিছু বলার জন্য ডাকলো শিক্ষকরা। চন্দ্রা তার মায়ের পাশে বেঞ্চে বসে ছিল। সে মায়ের কাছ থেকে উঠে। তার বাবার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে কাঁদতে লাগল। মুহূর্তেই যেন থমথমে নীরবতা নেমে এল পুরো পরিবেশটাজুড়ে। তারপর চন্দ্রা চোখের জল মুছে কান্না জড়িত ধরা কণ্ঠে সে তার বাবাকে নিয়ে একটা গান পরিবেশন করল সবার সামনে....

সবাই নীরব হয়ে চন্দ্রার সে গান শুনতে লাগল। সে গানটি হলো...

আজ যে, আমার বাবা হয়ে গেছে
ঐ, দূর আকাশের তারা...
তাই তো আজকে, আমরা দুই বোন
এমন, হলাম বাবা হারা।।
যে বাবার, স্নেহ আদর ভালোবাসায়
এ জীবন ছিল ঘেরা...
আমরা, কেমন করে বাঁচব বলো
সেই বাবাকে ছাড়া?
আজ, কেউ আর এখন দেখায় নাতো
আমার, বাবার মতো মায়া...
আমার, বাবাই যেনো এই জীবনে
ছিল বটের ছায়া।।
বটের, ছায়ার মতো আগলে রাখতো
বাবা, সুখের চাদর দ্বারা।।

গানটি শেষ হতে বাবা...বাবা... বলে ডুকরে কেঁদে উঠল চন্দ্রা। শাড়ির আঁচল মুখে চেপে কাঁদতে লাগল চন্দ্রার মা শায়লা বেগমও। মাকে ধরে ছোট মেয়ে তন্দ্রাও কাঁদছে। বাবাকে নিয়ে আট বছরের ছোট্ট মেয়ে চন্দ্রার মুখে অমন মায়া জড়ানো গান শুনে। স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাসহ অনুষ্ঠানের উপস্থিত অন্য অন্য লোকজন কেউ-ই নিজেদের দুই চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। সবার চোখ থেকে শ্রাবণের বারিধারার মতো অঝোরে টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়তে লাগল। শিক্ষকেরাও যেন বাবা হারা চন্দ্রার গান

শুনে চন্দ্রা তন্দ্রাকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। নীরবেই শুধু পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখের জল মুছতে লাগল।

  • লেখক: ফারুক আহম্মেদ জীবন, নারাংগালী, ঝিকরগাছা, যশোর, বাংলাদেশ

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]