বাবা, বেঁচে থাকতে চাইলে কাঁদতে জানতে হয়
বাবার মৃত্যুর আড়াই বছর। আমার রুমের ঠিক পাশের রুমে বাবা থাকত। বাবা আমাকে খুব একটা ডাকত না, আমিও তেমন যেতাম না বাবার কাছে। খেতে বসলে আমাদের মধ্যে একটু–আধটু আলাপ হতো। আমি কী করছি, জীবনে আমি কী করতে চাইছি—এসব নিয়ে বাবা কথা বলত না। বাবা এমন দু-একটা বিষয় নিয়ে আলাপ করত, যেগুলো নিয়ে আলাপ না করলেও চলে। বাবাকে আমি একটু দূর থেকে দেখতে ও চিনতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতাম। সবার ধারণা, আমি বাবাকে ভালোবাসি না। সবাই ভাবে, বাবার কোনো কিছুতেই আমার কিছু এসে যায় না। আমি কী, তা আমি ছাড়া আর কেউই জানে না। জানবর কথাও নয় অবশ্য।
বাবাকে আমি ছোটবেলা থেকে একজন শিক্ষক হিসেবেই পেয়েছি। এমন একজন শিক্ষক, যিনি নিজ থেকে কিছু শেখান না, তবে যাঁর সংস্পর্শে এলে অনেক কিছুই শেখা হয়ে যায়। আমি আর কারও কাছ থেকে এতটা শিখতে পারিনি, যতটা পেরেছি বাবার কাছ থেকে, না শিখেও। না শিখিয়েও শেখানোর কায়দাটা বাবা জানত, কিংবা জানত না যদিও, তা-ও সেটা আপনাআপনিই হয়ে গেছে। আমার সব শিক্ষা ও বোধ দিয়ে বাবাকে আমি অনুভব করতে পারি। এই ব্যাপারটা আমার কাছে আগে কখনো ধরা পড়েনি। কেন পড়েনি?
বাবা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশিটুকু আমি যা জানি, তা হচ্ছে, আমার বাবা আমার রুমের পাশের রুমে থাকত। এক কাজ বাদে রুম থেকে বেরিয়ে আর কোথাও যেতে বাবাকে তেমন দেখিনি। বাবার রুমে অনেক বই রাখা ছিল ও আছে। কখনো কখনো আমি বাবার রুমে গিয়ে বই নিয়ে আসতাম, আর বাবাকে জিজ্ঞেস করতাম, বাবা, কেমন আছ? আমার নির্বিবাদী বাবা বলত, বোধ হয় ‘ভালো আছি।’ এ ছাড়া আর কিছু বলতে জানত না কিংবা চাইত না। আমরা ‘ভালো আছি।’ শুনতেই ‘কেমন আছ?’ বলি। এমনও হতে পারে, ‘আমি ভালো নেই।’ বলার চেয়ে ভালো হচ্ছে, খারাপ থাকাটাকে নিজের মতো করে গিলে ফেলে চুপ করে থাকা।
বাবার রুমে আমি আসলে বই আনতে যেতাম না। বাবার রুম থেকে নিয়ে আসা বইগুলো আমি উল্টেও দেখিনি তেমন। তবুও কেন বই আনতে ও ফেরত রাখতে যেতাম, তা আমি জানি না। শুধু জানি, বাবার রুম থেকে বই নিয়ে আসতে আমার ভালো লাগত। পাশের রুমেই বাবা আছে, বাবার অবস্থান সম্পর্কে এর বাইরে আর কোনো ধরনের অনুভূতি আমার মধ্যে কখনো তৈরি হয়নি। বাবাকে কখনো কাঁদতে দেখিনি। আমার ধারণা ছিল, কাঁদবার মতো তেমন কিছুই বাবার নেই। ধারণাটি ভুল বলেই আমার অনুমান। এমন নয় যে বাবার সঙ্গে আমার খুব দেখা হতো কিংবা বাবার সান্নিধ্য আমি খুব করে চাইতাম। তবু বাবা পাশের রুমে এক দিন না-ও থাকতে পারে, এমনটা কখনো আমার মাথায় আসেনি।
বাবার হাসি, বাবার তাকানো, বাবার হাঁটা–চলা, বাবার টুকরা টুকরা সুখ ও দুঃখ, বাবার বিষণ্ণতা আমাকে দূর থেকে স্পর্শ করত। ওসব নিয়ে ঘাঁটতে আমি চাইতাম না। মনে হতো, ওসব নিয়েই তো মানুষটা! বাবা থাকুক না ঠিক তেমনই, যেমন থাকতে তার ভালো লাগে! কাউকে ঘাঁটতে যাবার পক্ষে আমি ও আমার বাবা কখনো ছিলাম না। বাবা বলত, দুঃখ ও সুখ, দুই-ই উদ্যাপন করার নামই জীবন।
বাবা নেই, এটা আমার মাথায় আনতে পারছি না। চেষ্টা যে করেছি আনতে, তা অবশ্য নয়। তবে এই ঘরটা বাবাকে বাদ রেখে কখনো চিনিনি বা চিনবার চেষ্টা করতে হয়নি। বাবার কণ্ঠস্বরটা শুনবার জন্য আমি অপেক্ষা করে থাকতাম, যা বাবা জানত না। ‘বাবা, একটু আসবি?’ কোনো বই খুঁজে না পেলে বাবা আমাকে হঠাৎ হঠাৎ ডাকত। আমার বড়ো ভালো লাগত। এই সত্যিটা বাবাকে বলিনি। বাবার হয়তো মনে হতো, বাবা আমাকে বিরক্ত করছে। বাবা কখনো কাউকে বিরক্ত করতে চাইত না।
বাবার রুমে পানির বোতল রাখা থাকত। বাবা ঘুমিয়ে পড়লে আমি বোতলটা ভর্তি করে বাবার ল্যাপটপের টেবিলে রেখে দিতাম। এর কারণ, বাবার চোখের সামনে বাবার জন্য কিছু করতে আমার মধ্যে একধরনের সংকোচ হতো। বাবার কাজগুলো বাবা কাউকে দিয়ে করাতে চাইত না। কষ্ট হলেও প্রতিটি কাজ নিজের হাতে করতে বাবা পছন্দ করত। পানির বোতলটা ভর্তি করার সুযোগ আমি সব সময় পেতাম না, বাবা নিজেই কাজটা করত। কিন্তু মাঝে মাঝে পানির বোতলটা কে ভর্তি করে দেয়, সেটা বাবা কেন কখনও জানতে চাইল না কেন, আমি জানি না।
বাবা একদিন না-ও থাকতে পারে, এটা ভাববার প্রয়োজন আমার কোনো দিনই হয়নি। দুঃখ ঝেড়ে ফেলতে কেঁদে ফেলাটা খুব সহজ একটা রাস্তা। অতটা সহজভাবে বাবার অনুপস্থিতি মেনে নিতে আমি পারছি না। এটা ব্যর্থতাই হয়তো। যে জীবনে ব্যর্থতা বেশি, সে জীবনে এই ভয়ংকরতম ব্যর্থতাটাও লেপটে গেল। আমার কিছুতেই কান্না পাচ্ছে না, আবার হাসিও পাচ্ছে না। সবাই আমার কাছে বারবার এসে আমাকে কাঁদতে বলে যাচ্ছে। ওদের দেখলেই আমার পালাতে ইচ্ছা করছে।
বাবা এখানে নেই, আমার এখানে থাকতে ইচ্ছা করছে না। আমার মনে হচ্ছে, ‘বাবা তো আছেই!’, এর বাইরে বাবাকে নিয়ে কিছু মাথায় আনাটা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার খুব ইচ্ছা করছে বাবার কাছে চলে যেতে। চলে যদি যাই সত্যি সত্যি, তবে তার নাম মৃত্যু হবে না, তার নাম হবে কাছে থাকার ইচ্ছা। আমার আশপাশের সবাই মৃত্যু নিয়ে এত কিছু জানে, অথচ মৃত্যুর অর্থটা যে কী, সেটিই কারও মাথায় আসছে না।
আমি বারবার পাশের রুমে চলে যাচ্ছি, বাবার খাটে কয়েকটা বই পড়ে আছে। বাবার কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা আছে। বাথরুমে বাবার অনেক সময় লাগে। বাবা নিশ্চয়ই বাথরুম থেকে বেরিয়ে আবার বই পড়তে বসে যাবে। বেঁচে থাকার সময়টাতে মানুষ স্মৃতি জমায় মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকার আশায়। অথচ বাবাকে আমার সব সময়ই নির্লোভ মনে হয়েছে! আচ্ছা, বাবাকে ভেবে আমি কি দুঃখ পাচ্ছি? কিংবা বিষাদ ছেয়ে ফেলছে আমাকে? মনে তো হয় না! আমার মধ্যে যা ভর করে আছে, তার নাম দুঃখ বা বিষাদ নয়, তার নাম শূন্যতা।
আমি বাবাকে মিস করছি, আমি নিজের কান্নাকে মিস করছি। মনে হচ্ছে, কেঁদে ফেলতে পারার চাইতে বড় ঐশ্বর্য আর নেই। বেঁচে থাকার কেবল দুটি রাস্তা আমার সামনে খোলা আছে—হয় চিৎকার করে কাঁদা, নয় তো বাবার কাছে চলে যাওয়া। আমার বাবাও তো সুস্থ ছিল! সুস্থতার সঙ্গে মৃত্যুর কোনো বিরোধ নেই।
কী আশ্চর্য! বেঁচে থাকতে চাইলে কাঁদতে জানতে হয়, এই সহজ সত্যটা বাবার কাছ থেকে কখনো শিখলাম না কেন?