ফেরা
সারা দিন ব্রহ্মপুত্রের শহর ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা ফেরার পথে সন্ধ্যার ট্রেনটি মিস হয়ে গেল। হাতে রয়ে গেল সেই পুরোনো টিকিট—যেন সময়ের এক নীরব স্মারক। ভাবলাম, এই টিকিটেই রাতের ট্রেনে উঠে পড়ি। সিট নেই, ভিড় ঠাসা। কিন্তু আমার ভেতরে তখন এক অদ্ভুত আনন্দ—আজ বসে নয়, দাঁড়িয়ে যাত্রা করব। চার ঘণ্টার ভ্রমণ, অথচ মনে হচ্ছিল এই স্বল্প সময়ের ভেতরেই আমি পৃথিবীর এক নতুন প্রান্তে পৌঁছে যাব।
গফরগাঁও স্টেশন পার হতে না হতেই রাতের বুক ভারি হয়ে এল। ধান সিদ্ধের বাষ্পের মতো কুয়াশা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। ট্রেন যেন কুয়াশার সমুদ্রে ভাসমান এক অগ্নিসাপ—তার গর্জন মিশে যাচ্ছে অন্ধকারের গভীর সুরে। জানালার বাইরে ধানখেত, নিঃশব্দ গ্রাম আর মাঝেমধ্যে ঝিমিয়ে থাকা গাছের সারি। ট্রেনের আলোয় হঠাৎ দেখা মেলে কাশফুলের—সাদা, তুলোর মতো, নিঃশব্দ সৌন্দর্যে ভরা।
আমি ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে নিজেকে উষ্ণতা দিতে এক চুমুক কফি খেলাম। আকাশে জ্যোৎস্না নেই, কেবল ট্রেনের মৃদু আলো। সেই আলো রেললাইনের পাশে কাশফুলে প্রতিফলিত হয়ে যেন কোনো সরল জ্যোৎস্না তৈরি করেছে—একটি নীরব, সাদা দীপ্তি, যা আরণ্যক উপন্যাসের পৃষ্ঠার মতো বাস্তব হয়ে উঠেছে। মনে হলো, আমি কোনো সাহিত্য নয়, বরং জীবন্ত উপন্যাসের ভেতর হাঁটছি—প্রতিটি শ্বাসে শব্দ, প্রতিটি দৃশ্যে গল্প।
কুয়াশা এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে মুখে, চুলে, জামার ভাঁজে। মনে হচ্ছে, আমি কুয়াশারই অংশ—ভাসমান, অথচ জীবিত। ট্রেনের চাকার ঘূর্ণি আর লোহা-মেশিনের ছন্দ যেন এক অজানা রাগিণীতে পরিণত হচ্ছে। রাত গভীর হচ্ছে, অথচ আমার ভেতরে জেগে উঠছে এক মৃদু আলোক।
এই যাত্রা কেবল গন্তব্যে পৌঁছানোর নয়। এটি নিজের ভেতর ফিরে দেখা—যেখানে সময়, প্রকৃতি ও নিঃসঙ্গতা মিলে এক অব্যক্ত সংলাপ রচনা করে। শহরের আলো দেখা দিল যখন, কুয়াশা ধীরে ধীরে পিছু হটে যাচ্ছে। তবু মনে হচ্ছে, সেই কুয়াশাচ্ছন্ন রাতের বুকের ভেতর আমি রেখে যাচ্ছি নিজেরই এক অংশ—যে অংশ এখনো ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে, কফির কাপে কুয়াশার গন্ধ মিশিয়ে, নিঃশব্দে হারিয়ে যাচ্ছে।
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]