বোনদের মতো ভালো বন্ধু আর কেই–বা হতে পারে? তারা আমাদের প্রয়োজনের সময় পাশে থাকে। বিপদে আমাদের হয়ে লড়াই করে। তারা ঝগড়াও করে, কিন্তু ঝগড়ার শেষে আবার ঠিক ভাবও করে নেয়। এমন বোনদের সঙ্গে সম্পর্কের বিশেষ বন্ধনকে সম্মান জানাতে জাতীয় বোন দিবস প্রতিবছর আগস্টের প্রথম রোববার পালিত হয়। এ বছর জাতীয় বোন দিবস পালিত হচ্ছে ৩ আগস্ট, রোববার। দিবসটির লক্ষ্য, বোনদের মধ্যে বন্ধনকে শক্তিশালী করা এবং একে অপরের প্রতি তাদের ভালোবাসা প্রকাশ করার সুযোগ দেয়।
জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর আগস্টের প্রথম রোববার এ দিবস উদ্যাপন করা হয়। বোন দিবসের সূচনা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। আমেরিকার বাসিন্দা ট্রিসিয়া এলিওগ্রাম ও তার বোন প্রথম তার বোনদের জন্য দিনটি উদ্যাপন করেছিলেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল, বোনদের ভালোবাসার প্রতি সম্মান জানানো। পাশাপাশি তাঁদের সঙ্গে সময় ভাগ করে নেওয়া এবং অন্যদের মধ্যে ভালোবাসা আর সহানুভূতি ছড়িয়ে দেওয়া। বোনেরা যে আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলোকে সম্পূর্ণ করে এবং সেগুলোকে আরও সুন্দর করে তোলে, সেটিই প্রমাণ করে এই দিন। আমাদের দেশে এখনো দিনটি সবার কাছে তেমন পরিচিত নয়। তবে দেশেও দিনটি ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে। সম্পর্কের মাত্রার ভিত্তিতে বোন দিবস নিঃসন্দেহে তাৎপর্যপূর্ণ।
ভাই-বোনের সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে মধুর, গভীর সম্পর্ক, যা সাধারণত শৈশব থেকে শুরু করে আজীবন স্থায়ী হয়। এই সম্পর্ক ভালোবাসা, যত্ন এবং একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে। ভাই-বোনের মধ্যে ঝগড়া, ঠাট্টা, খুনসুটির মধ্যে লুকিয়ে থাকে গভীর ভালোবাসা ও আন্তরিকতা। এই বন্ধন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। কারণ, আমাদের সুখে-দুঃখে—এমনকি আনন্দ-বেদনায় ভাই-বোনেরা সব সময় পাশে থাকে। জন্মের সঙ্গে সঙ্গে ভাই-বোনের সম্পর্ক শুরু হয়। একই ঘরে, একই পরিবারে বড় হওয়া, একই খেলনা নিয়ে খেলা, একই স্কুলে পড়া—এসবের মাধ্যমে গড়ে ওঠে ভালোবাসার এক নিবিড় বন্ধন। ছোটবেলায় ভাই-বোনের মধ্যে তুমুল ঝগড়াও হয়, কিন্তু সেই ঝগড়ার মধ্যে থাকে ভালোবাসার খুনসুটি। এই ঝগড়ার স্থায়িত্ব খুব বেশি হয় না। এভাবেই বোনের সঙ্গে ভাইদের স্মৃতিগুলো অম্ল-মধুর হয়ে থাকে। ভাই-বোনের এই মধুর সম্পর্ক জীবনকে সুন্দর করে। ভাই-বোনের সম্পর্ক নিয়ে বদরুল হক বলেছেন—
ভাইবোন চিরসাথী মায়ার বাঁধন,
প্রেম-প্রীতি ভালোবাসা আদরের ধন।
সুখে-দুঃখে এক হয়ে দিন করে পার,
দূরে গেলে মনে পড়ে কত শত বার।
বোনের সঙ্গে আমাদের যে বন্ধন, তার সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা হয় না। সেই ছোট্ট থেকে বোনের সঙ্গে হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তার আদর-ভালোবাসায় আমরা বেড়ে উঠি। বাবার শাসন কিংবা মায়ের বকুনি থেকে যে মানুষটি আমাদের সব সময় আগলে রাখে, সে আর কেউ নয়, বোন। যাকে আমরা আদর করে বু, বুবু, আপা কিংবা আপু, দিদি বলে ডাকি। এ ডাকের মধ্যে মিশে থাকে ভালোবাসা ও আবেগ। বোন কখনো বন্ধু, কখনো পরামর্শক, অভিভাবক আবার কখনো শিক্ষক হয়ে ওঠে। বোন কেবল রক্তের সম্পর্ক দ্বারা যুক্ত নয়, বরং মনের এক অটুট বন্ধনে আবদ্ধ। আমরা যখন দুঃখে ভেঙে পড়ি, বোন আমাদের পাশে এসে আমাদের সান্ত্বনা দেয়। আমরা যখন আনন্দে উচ্ছ্বসিত হই, বোন সেই আনন্দ ভাগ করে নেয়। তেমনি একজন ভাই কেবল তার বোনের বন্ধুই নয়, সে তার রক্ষাকর্তা, পরামর্শদাতা এবং সঙ্গীও বটে। ছোটবেলা থেকেই ভাই তার বোনকে দেখাশোনা করে, বিপদ থেকে রক্ষা করে এবং জীবনের বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষা দেয়।
আমাদের শৈশবে ভাই-বোনের মধ্যকার সম্পর্ক আজকের তুলনায় একটু বেশি আন্তরিক ও ঘনিষ্ঠ ছিল। এর অন্যতম কারণ, অনেক ভাই–বোন এক ঘরে থাকা, একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া, একই স্কুলে পড়াশোনা করা, খেলাধুলা করা ইত্যাদি। আমরা পাঁচ ভাই-বোন—দুই ভাই, তিন বোন। শিক্ষক বাবা আদর করে তিন বোনের নাম রাখেন বিউটি, রোজী ও লাভলী। নাম তিনটির অর্থ কিন্তু এক; অর্থাৎ সুন্দর। বড় বোন বিউটি আমার একেবারে পিঠাপিঠি হওয়ায় ছোটবেলা থেকে তাকে নাম ধরে ডাকি এবং তুই সম্বোধন করি। শৈশবে প্রতিদিনই তার সঙ্গে নানা বিষয় নিয়ে নিয়মিত সকাল-সন্ধ্যা ঝগড়া-কলহ-মারামারি হতো। আমি বয়সে ছোট ও শারীরিকভাবে দুর্বল হওয়ার কারণে প্রায়ই তার আক্রমণের শিকার হতাম। তার বিশেষ আক্রমণ ছিল হাতের বড় বড় নখ দিয়ে আমার দুই গালে চিমটি কাটা। সে ভয়ানক দৃশ্যের কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে ওঠে। তবে বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, বিশেষ করে ওর বিয়ের পর আমাদের সম্পর্ক পাল্টাতে থাকে। ব্যস্ত জীবনের নিয়মে আমাকে ভাই-বোনদের থেকে দূরে বসবাস করতে হয়। কাজের সুযোগ, পড়াশোনা, ব্যক্তিগত জীবন—নানা কারণে দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবে এই দূরত্ব কখনো আমাদের ভালোবাসা কমাতে পারেনি; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই ভালোবাসা আরও গভীর ও অটুট হয়ে উঠেছে। দুজন বেশ দূরে বসবাস করার কারণে আন্তরিকতা বেড়েছে। গ্রামের বাড়িতে গেলে তার বাড়িতে একবার ঢুঁ না মারলে সে প্রচণ্ড মনে খারাপ করে। কেন যেন মনে হয়, আমার অন্য ভাই-বোনদের চেয়ে আমাকে একটু বেশি যত্ন করে, নিয়মিত খোঁজখবরও রাখে।
মেজ বোন রোজী আমার থেকে ৪–৫ বছরের ছোট। ছোটবেলা থেকেই একটি নিরিবিলি চুপচাপ স্বভাবের। শৈশব থেকে নানির কাছে মানুষ হওয়ার কারণে অন্যান্য ভাই-বোনের সঙ্গে ওর সম্পর্ক অনেক শীতল। তবে মামা-খালাদের আদর-যত্ন সে সবচেয়ে বেশি পেয়েছে। কম কথা, কম চাহিদা এবং অভিমান যেন তার নিত্যসঙ্গী। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষার কেন্দ্র পার্শ্ববর্তী স্কুলে হওয়ায় আমার ওপর তার আনা-নেওয়ার দায়িত্ব পড়ে। মূলত এ পরীক্ষার সময় ওর সঙ্গে কথাবার্তা শুরু হয়। এর আগে সে আমার সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলত না। এরপর রাজশাহী কলেজে ভর্তি হওয়ার পর ওর সঙ্গে আমার প্রথম ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। বিয়ের পর সে দুই যমজ পুত্রসন্তানের মা হয়। বর্তমানে স্বামীহারা বোনটি আমার দুই পুত্রসন্তান নিয়ে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সক্রিয় না হলেও আমার প্রতি তার অগাধ আস্থা ও শ্রদ্ধা, তা সহজেই অনুমেয়।
আমাদের পরিবারের ছোট ও সবচেয়ে আদরের বোন লাভলী। ছোট হওয়ার কারণে আমাদের সব ভাই-বোনের আদর সে একটু বেশি পেয়েছে। ছোটবেলা থেকেই সে আমার অনেক কাছাকাছি থেকেছে। আমার বিয়ের পরপরই সে আমার কাছে খুলনা চলে আসে। খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করে একটি স্কুলে শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। স্বামী-সন্তান নিয়ে খুলনা শহরে বসবাস করে। বর্তমানে সে দুই সন্তানের মা, স্বামী খুলনা শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি কলেজে অর্থনীতির শিক্ষক। প্রায় সারা দিনই বোনটির ব্যস্ততায় কাটে। তারপরও প্রায় প্রতিদিন কোনো না কোনো সময় প্রয়োজনে–অপ্রয়োজনে আমাদের কথা হয়। ওর দুই সন্তানের টানেই সপ্তাহে কমপক্ষে ২ দিন বাসায় যাওয়া হয়। আমার কোনো সমস্যা বা অসুস্থতায় তাৎক্ষণিক ছুটে আসে। সব সময়ই আমার খোঁজখবর রাখে। আমার প্রতি তার টান একটু বেশি অনুভব করি।
মূলত বোনদের সঙ্গে ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার সময় প্রতিটি মানুষই আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। বোনদের সঙ্গে এমন এক বন্ধন তৈরি হয়, যা আগামী দিনে চলার পথকে আরও সুন্দর এবং মসৃণ করে তোলে। এই সবকিছু মাথায় রেখেই পালন করা হয় বোন দিবস। বর্তমান যুগে যেখানে মানুষের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে চলেছে, সেখানে ভাই-বোনের বন্ধন আমাদের জীবনে এক অপরিহার্য স্থান দখল করে আছে। এই বন্ধন আমাদের শক্তি দেয়, আমাদের সাহস দেয়, আমাদের ভরসা দেয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, ভাই-বোনদের মধ্যে সম্পর্ক যত দৃঢ় হয়, মানসিক সুস্থতা ও পারিবারিক স্থিতিশীলতাও তত বেশি বাড়ে। তাই আসুন, আমরা সবাই মিলে ভাই-বোনের এই অমূল্য বন্ধনকে আরও দৃঢ় ও সুন্দর করে তুলি। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই বন্ধনকে চিরস্থায়ী করে তুলতে পারলে আমাদের জীবন হয়ে উঠবে আরও সুন্দর, আরও পরিপূর্ণ।
আধুনিক যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হোক ভাই-বোনদের আবেগঘন মুহূর্তের ছবি ও বার্তা। ‘তুই আমার সবচেয়ে বড় বন্ধু’, ‘ভাই-বোন মানেই নিরাপত্তার আশ্রয়’— এমন নানা ক্যাপশনে মুখর আজকের দিন। ভাই-বোনের ভালোবাসার সম্পর্ক দৃঢ় হোক এবং অটুট থাকুক আজীবন।
*লেখক; সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর।
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]