আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বিশ্ব’ কই
‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি শুনলে প্রথমেই আমাদের মনে আসে একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যেখানে বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের উচ্চতর শিক্ষা প্রদান করা হয়। পাশাপাশি গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টির একটি অনন্য সুযোগ সৃষ্টি হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপিত হয়, যা বিভিন্ন সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিতি এবং শিক্ষার মান বৃদ্ধিতে সহায়ক। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতায়, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কি সত্যিই সেই আদর্শ অনুযায়ী চলছে? এখানে আমরা দুটি প্রেক্ষাপট উল্লেখ করতে চাই।
১. বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের বাস্তবতায় বিশ্ববিদ্যালয় বলতে সাধারণত একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান বোঝায়, যেখানে ‘মুখস্থ বিদ্যা’ শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেও পরীক্ষার মূল্যায়নের বিষয়টি মূলত মুখস্থ বিদ্যার ওপর ভিত্তি করেই হয়। আমাদের শিক্ষাজীবন মূলত মুখস্থ পড়াশোনার ওপর নির্ভর করে গড়ে ওঠে। এখানে এমন পরিবেশ বিরাজ করছে যে শিট মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে পারলেই ভালো ফল অর্জন করা সম্ভব। দেখা যায়, ফলাফলের ভিত্তিতে অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকও হয়ে যান এবং তাঁরা একই পদ্ধতিতে আমাদের শেখাতে থাকেন।
অন্যদিকে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় দেখা যায়, শিক্ষকেরা শিক্ষাগত যোগ্যতার চেয়ে অন্য উপায়ে চাকরি পেতে বেশি আগ্রহী। এ জন্য অর্থের বিনিময়ে নিয়োগ পাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতির মাধ্যমে এ ধরনের নিয়োগপ্রক্রিয়া আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মান নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। ফলে সত্যিকারের মেধাবী শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন বঞ্চিত। ফলস্বরূপ দেখা যায়, দক্ষ শিক্ষক ও গবেষণার অভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীও তৈরি হচ্ছে না।
২. বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট
বিশ্ববিদ্যালয় মানে হলো, যেখানে জ্ঞানচর্চার পাশাপাশি জ্ঞানের উৎপত্তিও ঘটে থাকে। যেখানে গবেষণা কার্যক্রম, আন্তর্জাতিক যোগাযোগের মাধ্যমে শিক্ষার্থী বিনিময় প্রোগ্রাম এবং বৈশ্বিক গবেষণার সুযোগ তৈরি হয় এবং এ সবকিছু পরিচালিত হবে একদল গবেষক দ্বারা। বিশ্ববিদ্যালয় শুধু শিক্ষার কেন্দ্র নয়, এটি গবেষণা ও জ্ঞানের উৎপত্তির কেন্দ্র হিসেবেও বিবেচিত হওয়া উচিত। উন্নত বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক অংশগ্রহণ এবং বৈশ্বিক শিক্ষা আদান-প্রদানের মাধ্যমে জ্ঞান বৃদ্ধি এবং উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ ঘটে। গবেষণার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিনিময় প্রোগ্রাম শিক্ষার্থীদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষম করে তোলে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এই বৈশ্বিক মানদণ্ড নেই বললেই চলে। গবেষণা কার্যক্রমের অভাব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বিনিয়োগের ঘাটতি সব মিলিয়ে আমাদের উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বিশ্বমানের থেকে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। গ্লোবাল র্যাঙ্কিংয়ে আমাদের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় উল্লেখযোগ্য অবস্থানে নেই। কারণ, এখানে গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ ও বিনিয়োগের অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য প্রয়োজন আন্তর্জাতিক মানের সিলেবাস এবং দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখনো মুখস্থনির্ভর। আমরা সৃজনশীল চিন্তাভাবনা, উদ্ভাবনী শক্তি ও প্রযুক্তির ব্যবহার শেখানোর পরিবেশ গড়ে তুলতে পারিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত দুর্বলতাও শিক্ষার মান নিচে নামিয়ে দিচ্ছে। আধুনিক ল্যাব সুবিধা, ভার্চ্যুয়াল ক্লাসরুম এবং উদ্ভাবনী শিক্ষণ পদ্ধতির অভাব তো আছেই। এমনকি পর্যাপ্ত ক্লাসরুমেরও অভাব রয়েছে। এর ফলে আমরা বৈশ্বিক মানের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে চুক্তি ও বিনিময় প্রোগ্রাম নেই বললেই চলে, যা আছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। যাকে আমরা ব্যতিক্রম বলতে পারি, উদাহরণ নয়। ফলে আমাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সুযোগ কমে যাচ্ছে।
প্রকৃতপক্ষে শিক্ষার মান ও পরিবেশ তৈরি করে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। অন্যথায়, ‘বিশ্ব’ শব্দটি শুধু নামের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে, যার কোনো কার্যকর অর্থ থাকবে না। একটি বিদ্যালয়ের পূর্বে ‘বিশ্ব’ শব্দটি ব্যবহার করার জন্য যেসব যোগ্যতা প্রয়োজন, সেসব যোগ্যতা এখনো আমরা অর্জন করতে পারিনি।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব বড়ই তীব্র। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু টেকনিক্যাল বিষয়ের ওপর উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হলেও বাস্তব জীবনে এসব বিষয়ের ভিত্তিতে চাকরির সুযোগ সীমিত। অধিকাংশ শিক্ষার্থী শেষ পর্যন্ত সরকারি প্রশাসনিক চাকরিতে প্রবেশ করে, যা তাঁদের অর্জিত টেকনিক্যাল জ্ঞান ও দক্ষতাকে কাজে লাগানোর সুযোগ কমায়। এর ফলে সরকারের তরফ থেকে যে বিনিয়োগ করা হয়, তা দেশের জন্য অনেকাংশে লস প্রোজেক্টে পরিণত হয়। একে আমরা ‘অপরিকল্পিত উচ্চশিক্ষা’ বলতে পারি, যেখানে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। সরকারের উচিত উচ্চশিক্ষার পরিকল্পনা এমনভাবে করা, যাতে আমরা আমাদের দক্ষতাকে যথাযথ ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে পারি এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম হই।
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উন্নতির জন্য শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন, গবেষণা ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক মানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করা জরুরি। অন্যথায়, ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ নামটি শুধু নামেই থাকবে, প্রকৃত বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারবে না।
-মো: সাইদুর রহমান শিক্ষার্থী, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়