বিদায় আর্জেন্টাইন ধ্রুবতারা, বিদায় আনসাং হিরো

দি মারিয়ার বিদায়ের মঞ্চ প্রস্তুতএএফপি

তিনি আর্জেন্টাইন ফুটবল দলের আনসাং হিরো, আরও সহজ করে বললে, যেকোনো ফাইনাল ম্যাচের রাজা বনে যান তিনি। শুধু বিশ্বমঞ্চেই তাঁর ফুটবল শৈলী নয়, দলের প্রয়োজনে নিজেকে সব সময় শতভাগ উজাড় করে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলেছেন প্রায় দেড় যুগ। বলছি আর্জেন্টাইন অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার দি মারিয়ার কথা। ৩৬ বছরে এসে বর্ণাঢ্য ফুটবল ক্যারিয়ারকে বিদায় জানালেন কিংবদন্তি এই উইঙ্গার। ক্যারিয়ারের শেষ ম্যাচটাও ছিল মনে রাখার মতো। গোল না পেলেও বিদায়ক্ষণে পেলেন আরেকটা আন্তর্জাতিক ট্রফির স্বাদ। চলতি বছরের কোপা আমেরিকার ফাইনাল খেলেই নিজের বুটজোড়া তুলে রাখলেন আর্জেন্টিনা ফুটবলের ‘ফিনিক্স পাখি’। আর কখনোই আকাশি-নীল জার্সিতে দেখা যাবে না দি মারিয়াকে। আর্জেন্টিনার অন্যতম সফল এ মিডফিল্ডারকে শুধু আর্জেন্টিনা সমর্থকেরাই নন, গোটা ফুটবল–বিশ্ব মিস করবে।

তবে বিদায় যে এত সহজ নয়। কোপা জয়ের স্বাদ পেলেও খেলা শেষে আমেরিকার হার্ড রক স্টেডিয়ামে কেঁদেছেন মারিয়া, কাঁদিয়েছেন তাঁর অগণিত ভক্তদের। এ যেন আনন্দের অশ্রু, ফুটবলীয় আবেগ। উই মিস ইউ দি মারিয়া। আন্তর্জাতিক জার্সিতে দি মারিয়ার যাত্রা শুরু সেই ২০০৮ সালে বেইজিং অলিম্পিকের মধ্য দিয়ে।

সেই অলিম্পিকের কোয়ার্টার ফাইনালে মেসি-দি মারিয়ার গোলেই নেদারল্যান্ডসকে হারায় আর্জেন্টিনা। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আকাশি–নীল জার্সিতে প্রায় দেড় যুগ ধরে দি মারিয়া তাঁর বাঁ পায়ের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন কোটি ভক্তকে। সবুজ ক্যানভাসে যখনই খেলতে নেমেছেন, বাঁ পায়ের ভেলকিবাজি, সৃজনশীল দৃষ্টিভঙ্গি, সেট-পিস ডেলিভারি, পাসিং ও ক্রসিং–ক্ষমতা দিয়ে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের বোকা বানিয়ে অসংখ্য গোল করেছেন চতুর ও প্রতিভাবান এই মিডফিল্ডার। দি মারিয়ার বিদায়ে চিরচেনা ট্রেডমার্ক হার্ট শেপের উদ্‌যাপন মিস করবে গোটা ফুটবল–বিশ্ব। ১৬ বছরের ফুটবল ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনার হয়ে শুধু খেলেননি, মহাকাব্য রচনা করেছেন দি মারিয়া।

২০২১ সালে ২৮ বছর পর কোপা আমেরিকার ট্রফি–খড়া কেটেছিল তাঁর একমাত্র গোলে। শুধু কি তা–ই? ২০২২ সালে লা ফিনালিসিমা আর কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালেও করেছেন দুটি গোল। ৩৬ বছর পর দি মারিয়ার গোলে বিশ্বকাপে জয় পায় আর্জেন্টিনা। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় দলের প্রয়োজনীয় সময়ে কত গোল করেছেন তারকা এই উইঙ্গার! মাঝমাঠ থেকে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়কে বোকা বানিয়ে বল কেড়ে নিয়ে দিতেন ভোঁ–দৌড়, শৈল্পিক ড্রিবলিং, পাসিং, ফ্রি–কিকে বছরজুড়েই তাঁর ফুটবলীয় নান্দনিকতা আর সেলিব্রেশিনে মাতিয়ে রাখতেন ফুটবলপ্রেমীদের। বিশ্বমঞ্চে দি মারিয়া সব সময় ছিলেন আর্জেন্টিনার লাকি ম্যান। দি মারিয়ার গোলেই বিশ্বকাপে রূপকথার জন্ম দিয়েছে আর্জেন্টিনা। তবে কেন যেন তেমন একটা আলোচনা হতো না এই ফুটবল তারকাকে নিয়ে। তিনি যেন ফুটবলের সাইলেন্ট কিলার। ১১ নম্বর জার্সিতে খেলতে নেমে সব সময়ই ছিলেন একজন সত্যিকারের যোদ্ধা। গোটা ফুটবল ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনার হয়ে এখন পর্যন্ত ১৪৫টি ম্যাচ খেলেছেন দি মারিয়া, গোল করেছেন ৩১টি।

আর্জেন্টিনার বেশির ভাগ ফাইনাল ম্যাচেই গোল এনে দিয়েছেন কিংবদন্তি এই খেলোয়াড়। সে জন্যই আর্জেন্টিনার ভক্তরা মনে করেন, ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে দি মারিয়া খেলতে পারলে ফলাফল অন্য রকম হতে পারত। ক্লাব ফুটবলেও দ্যুতি ছড়িয়েছেন দি মারিয়া। ক্যারিয়ারের শুরু থেকে ছয়টি ক্লাবে খেলেছেন তিনি। ক্লাব পর্যায়ে ৭৯৫ ম্যাচ খেলে গোল করেছেন ১৮২টি, অ্যাসিস্ট ছিল ২৬৮টি। সর্বোচ্চ গোল করেছেন ফ্রান্সের ক্লাব প্যারেন্ট সেন্ট জার্মেইর হয়ে ৯৩টি। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, জুভেন্টাসের মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সব ক্লাবে খেলেছেন এই ফুটবল তারকা।

ক্যারিয়ারজুড়ে এত গোল আর সফলতা পেলেও দি মারিয়া যেন থেকেছেন সব সময় আন্ডারেটেড। বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারজুড়ে বারবার সম্মানিত হয়েছেন ঠিকই, কিন্তু আলোচনায় আসেনি এই ফুটবল ইশ্বরের নাম। এর কারণ হিসেবে ভক্তরা দেখছেন লিওনেল মেসিকে। দলের দুই প্রাণভোমরাই আর্জেন্টিনার আক্রমণভাগকে সব সময় আগলে রেখেছেন ঠিকই, তবে আলোচিত ছিলেন মেসি। আলবিসেলেস্তে জার্সিতে দি মারিয়া প্রতিপক্ষসহ সবার কাছেই সব সময় ছিলেন সম্মানিত। শুধু নিজে গোল করেননি, দ্য ডার্ক হর্সখ্যাত দি মারিয়ার গোল করানোর মুনসিয়ানাও দেখিয়েছেন বারবার।

তবে ক্যারিয়ারজুড়ে দি মারিয়ার ইনজুরি ভুগিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময়ে। ইনজুরির কারণে খেলতে পারেননি ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনাল, ২০১৫ কোপা আমেরিকায় হ্যামস্ট্রিংয়ের ইনজুরিতে ফাইনাল হাতছাড়া করেন তিনি। ২০১৬ কোপায় গ্রুপ পর্বেই তিনি ইনজুরিতে পড়েন। ফাইনালের একাদশে ফিরলেও দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে আবারও হানা দেয় ইনজুরি। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আর্জেন্টিনার ফুটবল ইতিহাসে কৃতী খেলোয়াড় হয়েই ফুটবলপ্রেমীদের কাছে বেঁচে থাকবেন দি মারিয়া। দি মারিয়াকে যে মনে রাখতেই হবে।

  • লেখক: আরিফুল ইসলাম তামিম, শিক্ষার্থী, পোর্ট সিটি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রাম