‘আন্দোলনের সময় প্রশ্ন ওঠে, এই সরকারের পতন হলে তাহলে বিকল্প কে? তখন শিক্ষার্থীরা বলে আমরাই বিকল্প। স্বৈরাচারের পতনের পর আমরা শিক্ষার্থীরাই রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে নেমেছিলাম। আর এখন যখন নিজ দেশের এত বড় ক্রান্তিকাল, বন্যায় যখন ঘরবাড়ি ভেসে যাচ্ছে, আমাদের মানুষগুলো যখন প্রচণ্ড কষ্টে আছে, তখন তো বিকল্প হিসেবে আমাদেরকেই কাজ করতে হবে, তাই না?’
গত রোববার (২৫ আগস্ট) রাত ৩টা ৫০ মিনিট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রে বন্ধুদের সঙ্গে কাজ করছিলেন সিনথিয়া। বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সিনথিয়া জানান, তাঁর কাজের স্পৃহা আসে, বিকল্প কে—এই প্রশ্ন থেকে।
সিনথিয়াসহ টিএসসিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করতে আসা আরও অসংখ্য শিক্ষার্থীরা নিজেদের বিকল্প হিসেবে ভাবেন। তাঁদের ভাবনা, ‘এত দিন আমরা যে বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখে এসেছি, আমরা শিক্ষার্থীরাই এখন তা বাস্তবায়ন করব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষক কেন্দ্রে গেলে দেখা যাবে অসংখ্য শিক্ষার্থী স্বেচ্ছাসেবীরা কাজ করছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি, ঢাকার অনেক পরিবার তাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে এসেছেন স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে সহযোগিতা করার জন্য।
তাঁদের একজন আল ইমরান, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও ব্যাংক কর্মকর্তা। আল ইমরানের বড় ছেলে, ইযাজ, বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ কলেজের ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থী। শুক্রবার রাত একটায় টিএসসির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, ইযাজ তার বাবার সাথে ভারী বস্তা বোঝাই করে নিয়ে যাচ্ছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। ইযাজ জানায়, সে কাজ করে আনন্দ পাচ্ছে, একটু কষ্ট হলেও তার ভালো লাগছে দেশের জন্য করতে। অন্যদিকে ইযাজের বাবা তাঁর ছেলেকে ছোট থেকেই দেশের জন্য কাজ করার শিক্ষা দিতে চান।
শিক্ষার্থীরা দলবদ্ধ কাজে আনন্দ পাচ্ছেন
বদরুন্নেসা কলেজের শিক্ষার্থী সিনথিয়া টিএসসি এসেছেন তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে। তাঁরা বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে একটি টিম হিসেবে এখানে কাজ করছেন। তাঁরা সন্ধ্যায় এসে সারা রাত কাজ করেছেন। তবে এই দলবব্ধ (টিম ওয়ার্ক) কাজ তারা উপভোগ করছেন বলে সিনথিয়া জানান। ‘আমরা আমাদের কলেজ থেকে কয়েকটি টিম হয়ে বিভিন্ন জায়গা থেকে আগে ফান্ড কালেক্ট করেছি। এখন বন্ধুরা মিলে এখানে অন্যদের সঙ্গে কাজ করছি। এটি একটি নতুন অভিজ্ঞতা’, সিনথিয়া উল্লেখ করেন।
টিএসসিতে স্বেচ্ছাসেবীরা মূলত কাজ করছেন কয়েকটি ভাগে। পুরো বিষয়গুলো দেখা, তদারকি ও সমন্বয়ের জন্য কয়েকজন সমন্বয়ক রয়েছেন। একজন সমন্বয়কের অধীনে কাজ করছেন কয়েকটি টিম লিডার বা দলনেতারা। আর প্রতিটি টিম লিডারের অধীনে আবার কাজ করছেন অন্তত ১০–১৫ জন স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষার্থী।
গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কিছুটা সমন্বয়হীনতা দেখা গেলেও গত শনিবার থেকে সেটি কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে বলে অনেকে জানান। তবে স্বেচ্ছাসেবীরা জানান, হুট করে এমন একটা কাজে কিছুটা সমন্বয়হীনতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
‘কারণ, আগে থেকে এমন একটি কাজের জন্য কেউই প্রস্তুত ছিল না, অনেকের কোনো অভিজ্ঞতাও নেই এ ধরনের কাজের; যে যার মতো করে এগিয়ে এসেছে এটিই অনেক’—স্বেচ্ছাসেবীদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মোস্তবা যুক্ত করেন।
রোববার টিএসএসি এসে স্বেচ্ছাসেবীদের সঙ্গে যুক্ত হন ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ তন্ময় জামান তাজ। তিনি বলেন, ‘আমি কখনো এ ধরনের কাজের সঙ্গে তেমন যুক্ত ছিলাম না। আজকেই প্রথম এসেছি, আমার তেমন অভিজ্ঞতাও নেই। তবে সবার সঙ্গে কাজ করে ভালো লাগছে।’
বেসরকারি প্রাইম ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রিদওয়ান এসেছিলেন তাঁর বন্ধু নাজমুল হোসেনের সঙ্গে, যিনি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী। তাঁরা দুজনই মিরপুর থেকে এসেছেন। এই দুই বন্ধু জানান, দেশের জন্য যেহেতু কাজ করা শুরু করেছি, সবকিছু ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কাজ করেই যাব। তাঁরা ছাত্রলীগের সমালোচনাও করেন।
দুই বন্ধু বলেন, ‘ছাত্রলীগের কাজই ছিল ছোট একটা কাজ করে, সেটা দেখিয়ে অনেক টাকা খরচ করা; তারা যতটুকু না কাজ করত, তার চেয়ে দশ গুণ বেশি প্রচার করত, আর আমরা দশ গুণ কাজ করে তার ২ শতাংশও করছি না। কারণ, আমরা করি দেশের জন্য, তারা করত তাদের জন্য।’
নাজমুল আরও উল্লেখ করেন, বন্যার্ত মানুষের কথা ভেবে সেই বৃহস্পতিবার রাত থেকে ঘুমাতে পারি না। সকাল দশটা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত দুই দিন ননস্টপ কাজ করি। সেদিকের কাজ শেষ করে আজ টিএসসি এসেছি। আমার পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে। ‘আন্দোলনের সময় টিউশনি চলে গেছে, অবশিষ্ট অন্য একটা ছিল, এখন কাজের জন্য সেখানেও যেতে পারব না কয়েক দিন বলে দিছি। এটা চলে গেলেও চলে যাবে, কিন্তু দেশ আগে।’ তিনি যুক্ত করেন।
কেউ কাউকে জোর করছে না, সবাই কাজ করছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে; ক্লান্ত হলে দেওয়া হচ্ছে স্লোগান, গাইছে গান।
এ প্রতিবেদনটি লেখার জন্য প্রতিবেদক রাতে যখন স্বেচ্ছাসেবকদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছিলেন, তখন অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবী ‘সরি, অনেক কাজের চাপ, কথা বলার সময় পাচ্ছি না ভাই’ বলে কাজে মনোযোগ দিচ্ছিলেন। তাঁরা তাঁদের কাজে এতটাই ব্যস্ত ছিলেন যে তাঁদের কাজের মধ্যে মন্তব্য জিজ্ঞেস করতেও বিব্রত বোধ করছিলাম। এভাবে ননস্টপ কাজের মধ্যে তাঁরা কেউ কেউ যখন হাঁপিয়ে উঠছিলেন, অন্যরা স্লোগান দিচ্ছিলেন যেন আবার পুরোদমে শুরু করা যায়। পাশে দু–একজন বসে দেশাত্মবোধক গান গেয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁদের গানগুলো ছিল, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকে তুমি, সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্ম ভূমি’, ‘মুক্তির মন্দির সোপান তলে, কত প্রাণ হলো বলিদান’সহ এ ধরনের অনেক গান।
কিছু স্লোগানের মাধ্যমে তাঁরা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে কাজ করতেন, যেমন ‘বন্যায় যখন মানুষ মরে, আবরার তোমায় মনে পড়ে’, ‘আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে’, ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার’সহ আরও অনেক স্লোগান।
স্বেচ্ছাসেবকেরা ভাগে ভাগে কাজ করেন। তাঁদের একদল চিড়ামুড়িসহ বিভিন্ন জিনিস প্যাকিংয়ের কাজে, কেউ বাঁধার কাজে, কেউ চিকিৎসা সরঞ্জাম আলাদা করার কাজে, কেউ জামাকাপড় আলাদা করার কাজে যুক্ত। সবকিছু গুছিয়ে কেউ কেউ সেগুলো ট্রাকেও তুলে দিচ্ছিলেন রাতে। আর সেই ট্রাকগুলো বন্যাদুর্গত এলাকার দিকে রওনা হয়।
তবে স্বেচ্ছাসেবকদের কয়েকটি টিম ফেনী, কুমিল্লাসহ বন্যাদুর্গত কয়েকটি এলাকায় গিয়ে সেখানেও স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকা পালন করছেন। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা সেই এলাকার স্বেচ্ছাসেবকদের কাজ বুঝিয়ে দিচ্ছেন, আবার নিজেরাও কাজ করছেন। তাঁরা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে ও প্রয়োজনে কিছু জায়গায় সেনাবাহিনীর মাধ্যমে ত্রাণ পৌঁছে দিচ্ছেন বন্যার্ত মানুষের মধ্যে।
তবে সাংগঠনিকভাবে কাজটি করা গেলে আরও সুশৃঙ্খল হতো বলে উল্লেখ করেন স্বেচ্ছাসেবকদের একজন সমন্বয়ক নাদিম শুভ। তিনি বলেন, ‘আমরা এই ত্রাণ কর্মসূচি চালিয়ে যাব।’ যত দিন পর্যন্ত সবকিছু ঠিক না হবে, তত দিন পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন কাজ করে যাবে বলে তিনি জানান।
নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]