একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি
জোরালো আলোর নিচে ঘামে ভিজে দুজনে হাঁপায়। কোলবালিশকে পাশে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকে নিতা। মনের বিষ মিটিয়ে আলফাজ থামে।
তোমার সঙ্গে আমার কি শুধুই শারীরিক সম্পর্ক?
না, কেন?
তাহলে তুমি আমার মন বোঝো না কেন?
তোমার যা মনের অবস্থা, তাতে না বোঝাটাই মঙ্গল।
অই তো, তোমাদের পুরুষ মানুষের মন। চাওয়া পূরণ হলে সব ভুলে যাও।
না, ভুলে যাইনি প্রিয়া। বলো, তোমার কী চাই?
তুমি কথা দিয়েছিলে।
হ্যাঁ, দিয়েছিলাম।
ভাঙবে না।
না, ভাঙব না।
রাখবে তুমি কথা? রাখতে পারবে? এখন তো বললে বলবে, তোমার বউ ভালো না।
তুমি কি আমাকে আব্বার সম্পর্কে কিছু বলতে চাও?
হ্যাঁ, চাই।
সেটি না বলাই তোমার ভালো হবে।
না, বলব না কেন? আমি সাফ জানিয়ে দিচ্ছি, এই উটকো ঝামেলা আমার ভালো লাগে না।
তাহলে তুমি বাপের বাড়ি চলে যাও।
তড়াক করে বিছানা ছাড়ে আলফাজ। বাথরুমে গিয়ে কলটা ছেড়ে গোসল করে। জামা–প্যান্ট পাল্টে বেরিয়ে যায়।
পার্কের কোণায় গিয়ে বসে। একটা সিগারেট জালিয়ে হাওয়ায় ধোঁয়া ছাড়ে।
আব্বার বয়স হয়েছে। ছোট ভাইটা গ্রামে কোনো রকম টিকে আছে। তার এই স্বাচ্ছন্দ্য, এই আনন্দময় স্বচ্ছলতা, তা কি তার বাবার জন্যই নয়। তিনিই তো তাকে কোলে–পিঠে করে মানুষ করেছেন। করেছেন বড় হতে বড়। বড় হয়ে হয়ে এখন সে মানুষ হয়েছে। ভালো চাকরি করে। সেই প্রতিদান কি সে বাবাকে দেবে না? দেবে। নিতা যত ঝামেলাই করুক বাবাকে গ্রামের বাড়ি পাঠাবে না সে।
তিনটি সিগারেট পুড়ে আলফাজ বাসার পথ ধরে। পথ তার কাছে অচেনা হয়ে যায়।
দরজার কাছে এসে থমকে দাঁড়ায় আলফাজ। ভেতরে নিতার উচ্চকণ্ঠ শোনা যাচ্ছে। পিতাকে ধমকাচ্ছে সে। বুড়ো মানুষ, হয়তো কাশির ধমকে ঘুম ভেঙে গেছে। নিতার চোখে হয়তো ভুল করে ফেলেছে কোনো।
কলিংবেল টিপতে গিয়ে হাত থমকে যায়। কিন্তু আব্বাকে এই অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে হবে। একটানা কলিংবেল বাজাতে থাকে আলফাজ।
রুদ্রমূর্তি নিয়ে নিতা দরজা খোলে। তার থেকে হয়তো আলফাজের চোখে আগুন দেখে বেশি। চুপ করে যায়। আলফাজ দেখে, আব্বাও তড়িঘড়ি করে রুমের বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ছেন কম্বল টেনে। তিনিও আর এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চান না। আলফাজও বাতি নিভিয়ে দেয় তাদের রুমের। নিতার পাশে গিয়ে শোয়, তবে বিপরীত পাশ হয়ে।
এই মধ্যরাতেও বাবাকে না জ্বালালে হতো না?
তুমি কী বলতে চাও, আলফাজ?
যা বলতে চাই, তা পরিষ্কার।
তাহলে আমারও একটি পরিষ্কার কথা শুনে রাখো। আব্বা এ বাসাতেই থাকবেন।
রাত বাড়ে। আলফাজের চোখে ঘুম আসে না। ঘরিতে তিনটার ঘণ্টা পড়ে। ঢং ঢং ঢং করে তাকে মনে করিয়ে দেয় সকালে অফিস আছে। ঘুমোতেই হবে। ঘুমের রাজ্যে ছায়া হয়ে তার চোখ কিছুটা ঘুরে আসে। সকাল হলে দেখে, আবার সেই একই দৃশ্য। নাশতা বানাতে বানাতে নিতা আব্বার মাসরুমের সুপ বানানোর সময় ঘ্যানর ঘ্যানর শুরু করে। আব্বা তাঁর রুমে খবরের কাগজ পড়ছেন। আসলে খবরের কাগজে তিনি তাঁর মুখ আড়াল করে রাখছেন ওদের থেকে। তিনিও কি আজকাল নিজেকে বোঝা ভাবছেন? আলফাজের ইচ্ছা হয় নাশতা না করেই বেরিয়ে যায়। তবু আব্বা খাবে না জেনে নাশতার টেবিলে বসে। গলা দিয়ে পরোটা নামতে চায় না। তবু খায়। নিতা এর মধ্যে টিফিন গুছিয়ে ফেলে। অফিসের পথে পা বাড়ায়।
দুপুরে ফোন আসে বাসা থেকে।
তুমি এখনই একবার বাসায় আসতে পারবে?
না। কী জন্য?
তোমার আব্বা আমার ফ্লাওয়ার ভেসটি ভেঙে ফেলেছে।
এ জন্য আমাকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসতে হবে?
তুমি জানো, এটি আমার কত প্রিয় ছিল? এটি আমার বাবার দেওয়া শেষ উপহার।
কিন্তু তাই বলে বস্তু তো আর মানুষের থেকে বেশি দামি হয় না, নিতা। দয়া করে সামলাও নিজেকে।
কী বললে? আমি সামলাব নিজেকে? ঠিক আছে। আমি চললাম বাবার বাড়ি। বাসায় এসে আমাকে খুঁজো না।
লাইনটা কেটে গেছে। আলফাজ আবার চেষ্টা করে কল দিতে। কল বিজি। আবার চেষ্টা করে। নিতা ও পাশ থেকে কেটে দেয়। কিছুক্ষণ চেষ্টা করে বিরক্ত হয়ে আলফাজও ফোন রেখে দেয়।
নিতা গিয়ে সোজা তার বাবার বাড়িতে উঠে। কিন্তু উঠবে কোথায়? বাবা বেঁচে নেই। ভাবির সংসারে মাও এক নিতান্ত বোঝা। সে দেখে, তার মা বাসন মাজে শীর্ণ হাতে। ভাবির কটমটে দৃষ্টির সামনে মা কেমন কাচুমাচু হয়ে থাকে। ভাই তার থাকে বিদেশে।
মায়ের সঙ্গে ভাবির আচরণ রুক্ষ। পান থেকে চুন খসলেই খড়্গহস্ত হয়ে যায় একদম। নিতা জবাব না দিয়ে থাকতে পারে না।
ভাবি তার সাফ সাফ উত্তর জানিয়ে দেয়। মেহমান হয়ে এসেছে, নিতা যেন এখানে মেহমান হয়েই থাকে। তার সংসারে অযথা নাক গলানোর দরকার নেই।
উত্তরে নিতা কিছু বলতে পারে না। প্রচণ্ড ক্রোধ আর ঘৃণা থাকা সত্ত্বেও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ঠিক তার মায়ের মতো।
সপ্তাহ না পেরোতেই নিতা বাসায় চলে আসে। আলফাজ অবশ্য প্রতিদিনই ফোন করে অনুনয় করেছে। বাসায় এসে কয়েক দিন খুব ভালোই কাটে। এক দিন নিতা জানতে পারে, অফিসের কাজে কয়েক দিনের জন্য খাগড়াছড়ি যাচ্ছে আলফাজ। সুযোগটি সে কাজে লাগাবে ভাবে।
শ্বশুরকে এক রকম জোর করেই গাড়িতে উঠায়। টানা ১২ ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে দূরে কোথাও ঘাতকদের হাতে দিয়ে আসে। ফেরার পথে পত্রিকা অফিসে একটি হারানো বিজ্ঞপ্তি লেখায়।
পরদিন ইজি চেয়ারে বসে পত্রিকাটির পাতা খুলে আর মুচকি মুচকি হাসে নিতা। আলফাজকে সব জানানো হয়েছে। সে বিশ্বাস করেনি, ঢাকায় ফিরছে। কিন্তু কোনো লাভ হবে না। শ্বশুর যে অচিন দেশে হারিয়ে গেছে, সেখান থেকে কেউ কোনো দিন ফিরে আসেনি।
পাতা উল্টায় নিতা। শ্রেণিভুক্ত বিজ্ঞাপনে দুটো হারানো বিজ্ঞপ্তি পাশাপাশি ছাপা হয়েছে। প্রথমটা তার শ্বশুরের, তবু দ্বিতীয় বিজ্ঞাপনে চোখ গেঁথে যায়। সাদা–কালো ছবিটি তার মায়ের।
হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে নিতা। সে বুঝতে পারে, তার মায়ের সঙ্গেও হয়তো একই ব্যাপার ঘটেছে, যা সে ঘটিয়েছে তার শ্বশুরের সঙ্গে। তার চোখের কোণে জলবিন্দুগুলো পাথর হয়ে যায়।