ছাত্ররাজনীতিমুক্ত খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ফাইল ছবি

সম্প্রতি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় ঘুরে এসেছি। ১০৬ একরের ক্যাম্পাসটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মোড়া। জাতীয় কবির নামে কাজী নজরুল ইসলাম কেন্দ্রীয় লাইব্রেরিটিকে সবচেয়ে আকর্ষণীয় লেগেছে। এই লাইব্রেরি ভরা প্রাণ। যেখানে গিয়েছি অনেক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ একটি দিক হলো, এখানে ছাত্ররাজনীতি নেই। শিক্ষার্থীদের এ জন্য খুশি হতেই দেখেছি। তাঁরা এটাও বলছেন, র‍্যাগিংয়ের ঘটনাগুলো আগে যা ছিল, বর্তমানে তা নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক সমিতির অফিসে গিয়ে এসব তথ্যও তাঁদের মুখ থেকে শুনেছি। তবে যা যা চোখে দেখেছি, সেগুলো নিয়ে কিছু লিখব।

পাঁচ থেকে সাত বছর আগে কোথাও যেন পড়েছিলাম বাংলাদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় যাকে মডেল হিসেবে ধরা যায়, তার নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। হয়তো সেটা ছাত্ররাজনীতি না থাকার জন্যই হবে। কারণ, বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় কেবল এটিই। এ ছাড়া অনেক বিষয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গর্ব করার জায়গা আছে। তা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে না হয়তো। এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ৩৪ বছরে পদার্পণ করেছে, সুদীর্ঘ এই সময়ে রক্তপাতের কোনো ঘটনা ঘটেনি। উপরোক্ত এ বাক্যটি শুধু শিক্ষার্থীদের জন্য স্বস্তির তা নয়, অভিভাবকদের জন্য কতটা স্বস্তির ব্যাপার, তা অনুমেয়। কারণ, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্রসংগঠনগুলো দুই দশক ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অধিকাংশই নেতিবাচক শিরোনাম হয়ে একটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে। সেই জায়গা থেকে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই অনন্য মডেল।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আরেকটি গর্বের জায়গা সেশনজটমুক্ত থাকা। যেখানে হানাহানি, কোন্দল থাকবে না, সেখানে কোনো জট না থাকাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এটাই তো প্রাপ্তির ছিল, যা দিতে পেরেছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। তবে এখানেই প্রাপ্তির খাতার পৃষ্ঠা শেষ নয়। আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংসমৃদ্ধ এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। আন্তর্জাতিকভাবে কিউএস র‍্যাঙ্কিং, টাইমস হায়ার এডুকেশন র‍্যাঙ্কিং ও এশিয়া ইউনিভার্সিটি র‍্যাঙ্কিংয়ে স্থান করে নিয়েছে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। এসবের মূলে গবেষণাই যে মুখ্য ভূমিকা রাখে এবং শিক্ষার পরিবেশ যে অনুকূল, তারই প্রমাণ এই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। সে জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষ না মানার সুযোগ নেই।

বিকেলের সোনালি রোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যমুখী বাগানে পড়ছে আর তারই পাশের রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে কত কিছুই চোখে পড়ার মতো এই বিশ্ববিদ্যালয়ের। কিন্তু কোথাও কোনো রাজনৈতিক ব্যানার ও পোস্টার নেই, লেখা নেই স্লোগান। শুধু রাজনৈতিক নয়, অরাজনৈতিক কিছুও নেই গাছে পেরেক মারা, নেই প্রাণপ্রকৃতি নষ্ট করার মতো কিছু। এ জন্য খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের থেকে শিক্ষা নেওয়াও যায়। জাতীয় কবির নামে যেভাবে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির নামকরণ করা, তেমনই প্রতিটি স্থাপনার নাম খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের নামে বিধৃত করেছে, যাতে সৌন্দর্যের মাত্রাকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘদিনের আন্দোলন–সংগ্রামের ফল। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিক দিয়ে নবম। এ স্থানটি মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের বধ্যভূমি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই চোখ আটকাবে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চত্বরে। চোখ আটকাবে শহীদ মিনারে, মুক্তমঞ্চে, লেকে ও পথে-প্রান্তরে। আছে গোলপাতার ক্যাফেটেরিয়া, আছে বিশাল আয়তনের খেলার মাঠ।

বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হয়েছে। তাঁদের কাছে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস প্রসঙ্গে প্রশ্নই বোধ করি কয়েকবার করা হয়েছিল। তাঁদের ভাষ্য, এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রাজনীতি–সচেতন। কাগজ-কলমে ছাত্ররাজনীতি না থাকলেও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাঁরা বলীয়ান। এ জন্য ছাত্ররাজনীতিই যে প্রযোজ্য নয়, এ ব্যাপারে তাঁদের যুক্তি আছে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন যেসব তথ্য দেয়, সেসব জায়গায়ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় অনন্য মডেল হিসেবে পরিচিতি পাওয়ার যোগ্য, বিশেষ করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর আদর্শ অনুপাত। এ ছাড়া তাঁদের নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সমাবর্তন আয়োজন, ইউজিসির বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী র‍্যাঙ্কিংগুলোয় এগিয়ে থাকা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উজ্জীবিত করে।

দেশে ছাত্ররাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে, সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাস হিসেবে ও শিক্ষা গবেষণায় অনন্য হওয়ার গৌরব নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদযাত্রা চলছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে উচ্চশিক্ষাপ্রার্থী শিক্ষার্থীদের জন্য আগ্রহের জায়গাসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র তৈরি করতে পেরেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এই কৃত্বিতের সমান দাবিদার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসমাজও।

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]