বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস: আমাদের প্রাপ্য আর প্রাপ্তি
২৫ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস ২০২৪।
ওষুধ কিনতে ফার্মেসিতে গিয়েছি, হঠাৎ এক ভদ্রলোক রোগী এসে উপস্থিত।
ভদ্রলোক: ভাই, কাল থেকে ১০৪ ডিগ্রি জ্বর, ওষুধ দেন...।
দোকানদার: ভাই, আর কোনো সমস্যা আছে?
ভদ্রলোক: খুব শুকনা কাশি, গলাব্যথা আর ঠান্ডা/সঙ্গে শ্বাসকষ্ট আছে। বমি হইছে অনেকবার। কিছুদিন আগেও জ্বর আসছিল, অই যে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েছিলেন, মনে আছে!
দোকানদার: ভাই, ব্যাপার না। এটা সিজনাল। ওষুধ দিচ্ছি, ঠিক হয়ে যাবে। এই যে অ্যান্টিবায়োটিক দিলাম, পাঁচ দিন দুই বেলা খাবেন। আর সঙ্গে কাশি আর ঠান্ডার ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। সমস্যা হলে জানায়েন।
ভদ্রলোক: অনেক ধন্যবাদ। খুব উপকার করলেন।
কিছু সময়ের জন্য চুপ থেকে অনেক কথা আরও শুনলাম। ভদ্রলোক বিনা পয়সায় ডাক্তারের কাছে প্রেসক্রিপশন পেয়ে অনেক আনন্দে বাসায় ফিরে গেলেন।
এবার আমি ওই দোকানদারকে বললাম, ভাই, ডাক্তার বা কোনো প্রকার টেস্ট না করে সরাসরি এত উপসর্গ থাকার পরও আপনি কীভাবে সব ঔষধ দিয়ে দিলেন? কিছুদিন আগেও নাকি অ্যান্টিবায়োটিক নিয়েছে। এত ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক নেওয়া তো ঠিক নয়।
দোকানদার: ভাই, কী করব বলেন, এরা আছে বলেই তো আমরা কিছু করে খাই। সবার কি আর ডাক্তার দেখানোর সময় আছে? আর এই রাতবিরাতে ডাক্তার পাইব কই।
আমি বুঝলাম! তবে আপনার দোকান তো মডেল ফার্মেসি, কিন্তু ফার্মাসিস্ট কোথায়? সে দিলেও আমার কোনো আপত্তি থাকত না।
দোকানদার: আছে তো। কিন্তু সব সময় ডাকি না, সরকারি লোকজন এলে দেখাইয়া দিই। আর কিছু বলার না থাকলে ভাই আসতে পারেন, দেখছেন তো, দোকানে অনেক কাস্টমার।
অপরাধী ভাব নিয়ে ফার্মেসি থেকে বের হয়ে ভাবলাম, এখানে দোষ কার! দোকানদার, রোগী, ফার্মাসিস্ট আমার নাকি দেশের? একজন দোকানদার আজ ফার্মাসিস্টের কাজ করে যাচ্ছে, তাহলে এত পড়াশোনা করে কী লাভ! হাজারো প্রশ্ন; কিন্তু উত্তর দেবে কে?
ফার্মাসিস্ট তাঁরাই, যাঁরা শুধু ওষুধ নিয়ে পড়াশোনা করেন না, তাঁরা ওষুধের গুণাগুণ, মান যাচাই, কোয়ালিটি নিশ্চিত করাসহ ওষুধের ডোজ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, ভালো-মন্দ—সবকিছু বিচার করার ক্ষমতা রাখেন। আমরা ফার্মাসিস্ট মানেই বুঝি, তাঁরা সবাই শুধু ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করবে, এটা ভাবা খুব সহজ এই কারণে যে দেশের ৯০-৯৫ ভাগ ফার্মাসিস্ট এই ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করে থাকেন। অথচ এই বাইরেও বিশাল এক কর্মক্ষেত্র রয়েছে, যা কিনা এখনো আমাদের নাগালের বাইরে।
কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট এবং হসপিটাল ফার্মাসিস্ট এগুলো এখনো তেমন একটা আলোর মুখ দেখেনি। শুরু হলেও বারবার কেন জানি হোঁচট খেয়ে যাচ্ছে। এটার পরিব্যাপ্তি এতটাই হওয়া উচিত যে মানুষ যেন ওষুধের দোকানে, হাসপাতালে ফার্মাসিস্ট খুঁজে বেড়ায়, শুধু সঠিক ওষুধের ব্যবহার আর তার সামগ্রিক তথ্য-উপাত্ত জানার জন্য।
ফার্মেসি থেকে যখন দুই টাকা সমমূল্যের ওষুধ কিনে খাই, ভেবে দেখেছি কি কখনো, এর পেছনে কতশত মানুষের শ্রম রয়েছে! কতশত সিগনেচারের মাধ্যমে একটা ব্যাচ রিলিজ হয় আর তার পরেই সে ওষুধ বাজারে আসে।
কাজেই ঘটা করে শুধু ২৫ সেপ্টেম্বর, বিশ্ব ফার্মাসিস্ট দিবস পালন করলেই হবে না, সারা দেশে কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট, হসপিটাল ফার্মাসিস্টসহ সব ফার্মেসিতে স্থায়ীভাবে ফার্মাসিস্ট নিয়োগ না দিলে অসীম সম্ভাবনার এই দুয়ার কখনোই উন্মোচিত হবে না।
অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট, ভেজাল ওষুধ, ওষুধের সঠিক ডোজ, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয়ে জনসাধারণের নাগালে না আনলে অনেক বড় বঞ্ছিত করা হবে আমাদের দেশের সব ফার্মাসিস্টকে। তাঁরা সবাই কাজ করতে প্রস্তুত, দেশসেবায় তাঁরা নিজেদের অনেক আগে থেকেই ৯৮ ভাগ ওষুধের জোগান দিয়ে দেশবাসীকে আগলে রেখেছে, শুধু সুযোগের অপেক্ষায়। কমিউনিটি ফার্মাসিস্ট, হসপিটাল ফার্মাসিস্টের জায়গা থেকে তাদের পুরোদমে কাজ না করালে নিজেরাই অপরাধী থেকে যাচ্ছি। অবশ্যই ভালো দিন আসবে, আসতে হবেই। শুভ হোক।
পরিশেষে, প্রায় ৯৮ ভাগ ওষুধের জোগানদাতা ফার্মাসিস্টদের শুধু ওষুধ সেক্টরে নয়, পরিধি আরও বাড়িয়ে সমগ্র ক্ষেত্রে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য দরকার উদ্যোগ, অনুপ্রেরণা, উৎসাহ আর মনোবল।
*লেখক: মনোজিৎ কুমার রায়, দেশীয় ঔষধ প্রতিষ্ঠানে কর্মরত
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]