তিতুনির রংধনু দেখা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘তিতুনি দেরি হয়ে যাচ্ছে তো, তাড়াতাড়ি আয় মা। তোকে স্কুলে নামিয়ে আমাকে আবার অফিস যেতে হবে।’

আসছি আব্বু, একটু দাঁড়াও—
ঘরের ভেতর থেকে একটা মেয়ের কণ্ঠস্বর শোনা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুই বেণি দোলাতে দোলাতে পাঁচ বছরের একটা ছোট মেয়ে আফজাল হোসেনের সামনে চলে আসে। আফজাল হোসেন মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। কী সুন্দর, দুরন্তপনা মেয়ে হয়েছে তার, দেখতে ঠিক তার মায়ের মতো।
এসব ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার অনুভূত হয় কারও ঠান্ডা হাতের স্পর্শ—
‘এই কী ভাবছ তুমি?’ আফজাল হোসেন চমকে উঠে দেখেন পেছনে তার স্ত্রী আসমা দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মুচকি হেসে বলেন উঁহু বউ, তেমন কিছু না। দীপু স্কুলে গিয়েছে?
সে তো অনেকক্ষণ হলো। তুমি অফিস যাবে না?
যাব তো।

আফজাল হোসেন ভালোবেসে আসমা হোসেনকে বউ বলে ডাকেন। বউ ডাকটা কেমন জানি তার মিষ্টতামিশ্রিত সুর মনে হয়।

তাদের আদরের দুই বাচ্চা আছে। দীপু আর তিতুনি।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দীপু হলো তিতুনির বড় ভাই। এক স্কুলেই পড়াশোনা করে তারা। কিন্তু তিতুনির থেকে বয়সে ৪ বছরের বড় সে। তারা দুজনই যেন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। তিতুনি অনেক দুষ্ট। কিন্তু দীপু তিতুনির মতো এত চঞ্চল নয়। সবাই তাদের দুজনকে অনেক পছন্দ করে। কেন পছন্দ করে, যারা করে তারাই জানে। যা-ই হোক, আসমা হোসেন বাবা-মেয়ের খাবারের টিফিন আলাদা করে গুছিয়ে তাদের ব্যাগে দিয়ে দিল।

‘শুন টিফিন তোমার ব্যাগে। মনে করে খেয়ে নিয়ো। ভুলে যেয়ো না কেমন। তোমার তো আবার ভুলো মন। তিতুনি তুই কিন্তু খেয়ে নিস। খাবার যাতে রয়ে না যায়। একদম খাবার নষ্ট করবি না। সবাই মিলে ভাগ করে খেয়ে নিস।’

আফজাল হোসেন বউয়ের কাছে এসে তার কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল, ‘আমরা খেয়ে নিব, তুমিও ঠিকমতো খেয়ে নিয়ো কেমন। আসি, আল্লাহ হাফেজ।’

এই বলে বিদায় নিয়ে তিতুনিকে নিয়ে তিনি বেরিয়ে যান তাদের গন্তব্যের পথে।

‘সাবধানে যেয়ো’ বলে আসমা হোসেন তাদের পথপানে ততক্ষণ চেয়ে থাকেন, যতক্ষণ না তাদের ছায়া মিলিয়ে না যায়। এ যেন তার নিত্যদিনের কাজ। আফজাল হোসেনের একটা প্রিয় সাইকেল আছে। সাইকেলটা যদিও খুব দামী না তারপরও তিনি সাইকেলটাকে বেশ যত্নে রাখতে পছন্দ করেন। অফিস বা সর্বত্র বিচরণের সঙ্গী তার এই পুরোনো দিনের সাইকেলটা। এই সাইকেলে কেন জানি তিনি কখনোই ক্লান্ত বোধ করেন না। মেয়েও যেন বাবার স্বভাব পেয়েছে খানিকটা। সেও সাইকেলে চড়তে খুব পছন্দ করে। আব্বু সাইকেলে চড়ব, এখানে নিয়ে যাও, ওখানে নিয়ে চলো, কতশত বায়না তার। সাইকেলের পেছনের সিটে বসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে স্কুলে যাওয়া যেন তার একটা অভ্যাস, তাকে সেটা করতেই হবে আর নয়তো সে স্কুলেই যাবে না। সাইকেলে বসে কত রকমের কথা তার, এক একটা কথায় কি আছে সেই জানে, বলে আর ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে হাসে। আর আফজাল হোসেনও হাসিমুখে মেয়ের ক্লান্তিহীন বেগবান ঝরনার মতো কথাগুলো মন দিয়ে শোনেন। ভালোই লাগে শুনতে মেয়ের এসব কথার ফুলঝুরি। স্কুলের সামনে মেয়েকে নামিয়ে দিয়ে আফজাল হোসেন চলে যান তার অফিস যাত্রার পথে। যাওয়ার সময় বলে যান—
‘স্কুলে একদম দুষ্টুমি করবি না তিতুনি। মন দিয়ে পড়বি কেমন? কোনো বদমায়েশি যাতে আমার কানে না আসে।’
‘জি আব্বু।’

এ বলে তিতুনি নাচতে নাচতে স্কুলে চলে যায়। স্কুলে পৌঁছেই শুরু হয় তার খুনসুটি, মারামারি। কেন জানি মারামারি করতে সে খুব পছন্দ করে। কার স্বভাব পেয়েছে, কে জানে। এই কাউকে গুঁতো দিচ্ছে, কাউকে খোঁচাচ্ছে, চিমটি কাটছে, খামছি দিচ্ছে, ঘুষি দিচ্ছে। একবার তো সে তার এক বান্ধবীর মাথা ফাটিয়ে কি এক যাচ্ছেতাই কাণ্ড করেছিল। কোলে তুলে তাকে ঠুস করে নিচে ফেলে দিয়েছিল। তিনটা সেলাইও নাকি লেগেছিল সেই মেয়ের। সেই দিন বাসায় গিয়ে তাকে আর কে পায়। কোনো কথা না বলে তার আব্বুর বকার ভয়ে ঘুমের ভান করে সারা দিন বিছানায় পরে ছিল। বকা যাতে খেতে না হয় তার। আর ওই দিকে আফজাল হোসেন তো রেগে আগুন—
‘ওকে ঘুম থেকে ওঠাও। স্কুলে কি ও এই সব করতে যায়, একটা মেয়ের মাথা ফাটিয়ে এসেছে বুঝতে পারো তুমি।’

আসমা হোসেন কি বলবেন বুঝতে পারছিলেন না। তা-ও বোঝানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছিলেন—
‘মাফ করে দাও ছোট মানুষ বুঝতে পারেনি। আর করবে না।’

সেই দিন কি ভয়টাই না পেয়েছিল তিতুনি। যেন কিছুক্ষণের জন্য কেও তার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল। বুকের ধড়ফড়ানি বেড়ে কি একাকার অবস্থা। পড়াশোনায় ভালো বলে সবার অনেক প্রিয় আর অনেক আদরের ছিল সে। তাই বাঁদরামিটাও ছিল অত্যধিক। ক্লাসে একদিন সে কোন কারণে পড়া পারেনি, বকা খেয়েছিল, কেন পাড়ল না, এই হলো যা। কান্নাকাটি করে নাশ-বিনাশ। পারবে না কেন, কেন বকা খাবে, জেদ চেপে যায় তার মাথায়। পরের দিন ক্লাসে সবচেয়ে বেশি পড়া পেরে ম্যাম এর শাবাশি ছিনিয়ে নেয় সে। যে ম্যাম তাকে বকেছিলেন তিনিই তাকে শাবাশি দেন। বলেন—
‘বাহ্ আজকে তো সব পড়া পারলিরে তিতুনি, জেদ করে পড়েছিলি নিশ্চয়ই। এভাবেই সব সময় পড়াশোনা করবি বুঝলি। তাহলে আর কেউ বকবে না। জেদটাকে ধরে রাখ। তবেই ভালো কিছু হবে। আর তিতুনি তো লক্ষ্মী মেয়ে, কথা শোনে, তাই না?’
হ্যাঁ তো ম্যাম। তিতুনি খুশিতে গদগদ হয়ে যায়।

তার নিত্যদিনের একটা কাজ ছিল সে প্রতিদিন স্কুল শেষ করে বাসায় এসে ব্যাগ ফেলে খেলতে চলে যেত। এইটা তার একটা নেশার মতো। কত রকমের খেলা জানে মেয়েটা, তাকে যদি বলা হয় সবকিছু বাদ দিয়ে সারা দিন খেলো সে সানন্দে তাই করবে। তার খেলায় কোনোটা বৌছি, কোনোটা গোল্লাছুট, কোনোটা কানামাছি, মাংসচোর, জুতাচোর, সাতপাতা আবার নাকি চোখ পালান্তি। তবে সে যা-ই করুক বাবার ভয়ে পড়ায় ফাঁকি দিতে পারত না কখনো। তিতুনি তার আম্মুর চেয়ে আব্বুকে কেন জানি ভয় পেত। অনেক না তবে পেত।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আফজাল হোসেন তিতুনি, দীপুকে অফিস শেষ করে এসে নিজেই পড়াতেন। পড়ানো শেষ করে একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করার সময় তার আহ্লাদী মেয়েকে নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়া লাগত। উনি খাইয়ে দিতে পছন্দও করতেন। খাওয়া শেষ করে সবাই মিলে টিভি দেখে তিতুনি বাবাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে যেত। কী সুন্দর সুখী পরিবার তারা।
বাসার সামনের অংশটা অনেক সুন্দর করে করেছেন আফজাল হোসেন। অনেকটা খোলা জায়গা সেখানে। তার পাশেই একটা বড় পুকুর। একদিন পুকুরপাড়ের খালি জায়গায় বসে তিতুনি আর দীপুকে অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন তিনি। তিতুনির অঙ্কপ্রিয়তা ছিল অনেক। কঠিন অঙ্কও ছুমন্ত ছোঁ বলে করে ফেলতে পারত বলে তাকে ভালোবেসে তিনি অঙ্কের জাহাজ বলে ডাকতেন।। অঙ্ক করতে করতে হঠাৎ আকাশে সাত রঙের রংধনু ভেসে ওঠে। তিতুনি চিৎকার দিয়ে তার আব্বু, ভাইয়াকে হাত দিয়ে ইশারা কী করবে না তার আগেই ‘আব্বু আকাশে রংধনু। দেখো দেখো রংধনু। ওই, ভাইয়া; দেখো কি সুন্দর লাগছে আকাশটা!’

আফজাল হোসেন হেসে বলল, আকাশের মাঝে কয়টা রং দেখতে পাচ্ছিস বলত তিতুনি।

তিতুনি গুনে বলল সাতটি আব্বু। সাতটি।
‘সাতটি রঙের নাম বল তো দেখি।’
তিতুনি চিল্লায় বলল, এটা তো অনেক সহজ আব্বু।
বে নী আ স হ ক লা
বে-তে বেগুনি, নী-তে নীল, আ-তে আসমানী, স-তে সবুজ, হ-তে হলুদ, ক-তে কমলা আর লা-তে লাল।
হয়েছে আব্বু?

আফজাল হোসেন মুচকি হেসে বললেন, হ্যাঁ আম্মু হয়েছে। পেরেছিস তুই।
তিতুনি তার আব্বুর হাসি দেখে নিজেও যখন হাসতে যাবে তখনই তার মা আসমা হোসেনের ধাক্কায় তার হুঁশ আসে।
ক্লাসে যাবি না তিতুনি?

যাব তো আম্মু, এই তো বের হব এই বলে অবাক হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় সে। নিজেকে দেখে আর ভাবে, দেখতে দেখতে কতটা সময় চলে গেল। সেই ছোট্ট তিতুনি আর ছোট্টটি নেই। অতীত থেকে এক ধাক্কায় যেন বর্তমানে এসে পড়েছে সে। এখন তার বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ গণ্ডিতে ছুঁই ছুঁই অবস্থা। কয়েক মিনিটের জন্য সে ভুলেই গিয়েছিল তার বাবা আফজাল হোসেন আর বেঁচে নেই। তিনি ১৮ বছর আগে সবকিছুর মায়ামোহ ত্যাগ করে, বিদায়পর্ব শেষ না করেই পৃথিবী থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন।

তিতুনির মনে পড়ে যায় সেই রংধনুর কথা।

আহা!! সেই রংধনু, সেই প্রথম দেখা প্রথমই হয়ে রইল এখনো। এরপর আর কখনই সেই রংধনু কেন জানি তাকে আর দেখা দেয়নি। হয়তো তার জীবনে নতুন কারও আগমনে দ্বিতীয়বারের মতো সেই রংধনু তাকে দেখা দিলেও দিতে পারে। তিতুনি মনে মনে ভাবে কবে সেই মুহূর্ত আসবে...সে আবার রংধনু দেখতে পাবে। অপেক্ষায় থাকে সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, আসবে অবশ্যই আসবে সেই সময়।

কিন্তু কবে? অপেক্ষার প্রহর গুনে সে। জানে এইটা শুধু শুধু। তারপরও সে দেখতে চায়, আকাশের সেই সাত রং, যেখানে সাত রঙের পেছনে আসলে সে খুঁজে ফিরবে একটা প্রিয় মুখ। এখন শুধু অপেক্ষা....

*লেখক: ইল্লিন জাহান উর্মি, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]