নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তি খাত যেভাবে

আইসিটি খাতে রপ্তানি আয়প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছে এক নতুন বাংলাদেশ। বৈষম্যবিহীন বাংলাদেশ গড়তে শত-শত তরুণ তাঁদের জীবন দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন, এই তরুণরাই চাইলে পরির্বতন সম্ভব। এই তরুণেরাই বাংলাদেশের চালিকাশক্তি। এখন সময় ছাত্র-জনতার চূড়ান্ত আকাঙ্খাকে পূরণ করে সকল অন্যায়-অবিচারকে দূরে ঠেলে একটি বৈষম্যবিহীন, উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার। আর এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত।

বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তথ্যপ্রযুক্তি খাত তুলনামূলকভাবে নতুন। জাতীয় অর্থনীতিতে বর্তমানে ১ শতাংশের কিছুটা বেশি অবদান রাখলেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বর্ধনশীল খাত হিসেবে বিবেচিত। ১৯৯৭ সালে সফটওয়্যার এবং তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা শিল্পের জাতীয় সংগঠন হিসেবে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে কেবল ১৭টি সদস্য কোম্পানি থাকলেও বর্তমানে বেসিসের সদস্যসংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। শুধু বেসিস নয়, বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অপর চারটি জাতীয় বাণিজ্য সংগঠন বিসিএস, বাক্কো, আইএসপিএবি এবং ই-ক্যাবের সদস্যসংখ্যাও কয়েক হাজার। এই পাঁচটি সংগঠনের সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৩ লাখসহ দেশে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ১০ লাখের অধিক কর্মসংস্থান রয়েছে।

বর্তমানে সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তি পরিষেবা খাতের বার্ষিক অভ্যন্তরীণ বাজারের আকার প্রায় দেড় শ কোটি মার্কিন ডলারের সমপরিমাণ, পাশাপাশি ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে এই খাতে রফতানি আয় হয়েছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার।

এই খাতের উন্নয়ন, উৎকর্ষ ও ভবিষ্যত সম্ভাবনার উদ্রেকে বেসরকারি খাতের এক বিশাল অবদান রয়েছে। এদেশের বেসরকারি খাতের অংশীদার ও বিশেষজ্ঞরা বরাবরের মতোই এই খাতের আপামর টেকসই ও উৎকর্ষময় উন্নয়নের জন্য তৎপর। এর জন্য পরস্পরের সঙ্গে মিলে এবং সরকারের সঙ্গে অংশীদারিত্বে তারা কাজ করতে, এই উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় প্রভাবকের ভূমিকা পালন করতে আগ্রহী ও সদা তৎপর। বেসরকারি খাতের অ্যাসোসিয়েশন, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো কারিগরি, বুদ্ধিবৃত্তিক, ও আর্থিক বিনিয়োগ দিয়ে এই খাতের প্রকৃত সম্ভাবনা অর্জনে কাজ করতে আগ্রহী। নীতিগত পরিবর্তন ও নবায়নের জন্য অন্তবর্তীকালীন সরকারের যেকোনো ধরনের সহায়তা ও কাজ করতে খাতের সদস্যদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতিনিধিদের সংলাপের আহ্বান জানায় তারা।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সফলতার পেছনে দেশের বেসরকারি খাত পরিচালিত সফটওয়্যার ও তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা খাত বৃহৎ ভূমিকা পালন করেছে, যা দেশের নাগরিকদের জীবনযাত্রা, গভর্ন্যান্স, শিল্পোৎপাদন ও সেবায় উল্লেখজনক পরিবর্তন এনেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতই পারে দেশের সব খাতে তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগের মাধ্যমে ডিজিটাল বৈষম্য দূরীকরণ এবং একটি সম্মিলিত, বৈষম্যবিহীন সমাজ গঠনের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ করতে।

তারুণ্যনির্ভরতাকে কাজে লাগানো

বাংলাদেশের ৩৮.৯১ শতাংশ অর্থাৎ ৬ কোটি ৪৩ লাখ মানুষের বয়স ২০ থেকে ৪০ বছর। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশ বিগত সময়ে তাদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হয়েছে। এ ব্যর্থতার দায়ভার সবার। আশার বিষয় হচ্ছে, এই তরুণেরাই এখন পথ দেখিয়ে দিয়েছে। এমন সময়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতই পারে এই বৃহৎ জনশক্তিকে সর্বাপেক্ষা কাজে লাগাতে। কারণ, দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত সরাসরি তরুণদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই ইন্ডাস্ট্রিতেই তরুণদের অংশগ্রহণ সবচাইতে বেশি। এই খাতে বর্তমানে আড়াই হাজারের অধিক কোম্পানিতে তিন লাখের অধিক তরুণদের অংশগ্রহণ রয়েছে, যার মধ্যে নারীদের অংশগ্রহণ প্রায় ২০ শতাংশ। এ ছাড়া ফ্রিল্যান্সিং পেশায় জড়িত আছেন প্রায় ৬ লাখ তরুণ।

 কিছু কৌশলগত উদ্যোগ নিয়ে তরুণদের সম্ভাবনাকে পুরোপুরিভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে।

১. প্রযুক্তিতে দক্ষতার মানোন্নয়ন: দেশের তরুণদের প্রথমে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে আগ্রহী করে তুলতে হবে। এরপর তাঁদের প্রযুক্তি দক্ষতায় মানোন্নয়ন করতে হবে।

 ২. আইসিটি স্টার্টআপে উদ্বুদ্ধকরণ: বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা দূরীকরণে তরুণেরা যাতে উদ্ভাবনীমূলক স্টার্টআপ শুরু করতে পারেন, সেই বিষয়ে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করা উচিত। তাঁরা যাতে তাঁদের স্টার্টআপকে সফল করতে ও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারে সে জন্য বেসরকারি খাত ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সমন্বয়ে যথাযথ মেন্টরশিপ ও দিকনির্দেশনা দিতে হবে।

 ৩. মেধা সংরক্ষণ: তথ্যপ্রযুক্তি খাতই বাংলাদেশের অন্যতম বেশি বেতনের খাত, যেখানে প্রতিবছর ২৫ হাজারের অধিক গ্র্যাজুয়েট যুক্ত হয়। দেশব্যাপী এই খাতের প্রচারণা ও ক্যারিয়ার সম্ভাবনাকে জনপ্রিয় করার মাধ্যমে মেধাবীদের দেশের বাইরে চলেও যাওয়া রোধ করে তাঁদেরকে দেশেই রাখা যেতে পারে।

৪. ফ্রিল্যান্সারদের মানোন্নয়ন: ফ্রিল্যান্সিংয়ে বাংলাদেশের তরুণদের সফলতা ঈর্ষনীয়। তবে বৈশ্বিক ফ্রিল্যান্সিং খাতের তুলনায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ খুবই কম। আন্তর্জাতিক বাজারে আইসিটি ফ্রিল্যান্সিংয়ে তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে একদিকে যেমন বেকারত্ব দূর হতে পারে, একইসঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার যে সঙ্কট রয়েছে, সেটি লাঘব করা যেতে পারে। যদি দেশে বর্তমানে সক্রিয় থাকা অন্তত ৫ লাখ ফ্রিল্যান্সার মাসে গড়ে ২০০ ডলার আয় করতে পারে, তবে তাঁদের মাধ্যমেই বাড়তি বার্ষিক ১.২ বিলিয়ন ডলার দেশে আনা সম্ভব।

দীর্ঘমেয়াদী সরকারি সদিচ্ছা

স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা না থাকার কারণে দুর্নীতি, অর্থপাচার, ট্যাক্স-ভ্যাট ফাঁকির মহোৎসব দেখা গেছে। সরকারের সব ক্ষেত্রে অটোমেশন নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। স্থানীয় কোম্পানিগুলোই অটোমেশনের মাধ্যমে সরকারের কেনাকাটা, মনিটরিং ও ট্র্যাকিং সিস্টেম, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে সক্ষম। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে অটোমেশন সম্পন্ন করতে পারলে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এগিয়ে যাবে দেশ।

টেকসই প্রবৃদ্ধিতে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্যমাত্রা

বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদী অর্জনকে সহায়তা করতে একটি দীর্ঘমেয়াদী টেকসই পরিকল্পনা দরকার। এক্ষেত্রে কয়েকটি উদ্যোগ নেয়া জরুরি।

১. প্রাথমিকেই কোডিং শিক্ষা: প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কোডিংয়ের বেসিক শিক্ষা দিতে পারলে শিশুদের প্রোগ্রামিংয়ের প্রতি তাদের সৃজনশীলতা ও আগ্রহ তৈরি করা যাবে।

২. সরকারি কেনাকাটায় স্থানীয় কোম্পানিকে প্রাধান্য দেওয়া: স্থানীয় কোম্পানির সফটওয়্যার ও সেবা ক্রয়ের মাধ্যমে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের আরও উদ্যোগী হতে হবে। যদি স্থানীয়ভাবে কোনো সফটওয়্যার ও সেবা তৈরি না হয়ে থাকে তাহলে বিদেশি কোম্পানিগুলোকেই অবশ্যই স্থানীয় কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারিত্বে ও প্রযুক্তি ট্রান্সফার করতে হবে।

৩. সফটওয়্যার আমদানিতে কঠোরতা: স্থানীয়ভাবে উন্নয়ন ও উদ্ভাবনে উৎসাহিত করতে সফটওয়্যার আমদানিতে কঠোরতা আনা প্রয়োজন। যেসব সফটওয়্যার দেশে তৈরি হয়, সেগুলো যেনো কোনোভাবেই আমদানি না করা হয়, সেটি নিশ্চিত করা ভীষণ প্রয়োজন।

৪. স্থানীয় কেনাকাটায় প্রণোদনা: বাংলাদেশি পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে যেসব কোম্পানি বিদেশি কোম্পানির পরিবর্তে স্থানীয় কোম্পানির সফটওয়্যার ও সেবা গ্রহণ করতে, তাদেরকে ট্যাক্স ও ভ্যাট ছাড়ের মাধ্যমে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে।

এমন কল সেন্টারের মাধ্যমে বিদেশের আউটসোর্সিংয়ের কাজ করা হয় দেশে
ফাইল ছবি

ব্র্যান্ডিংয়ে নজর দেওয়া

২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশ তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রায় ১.৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় করেছে আর দেশের জিডিপিতে এই শিল্পের অবদান মাত্র ১.২৫ শতাংশ। এই খাতে তিন লাখের অধিক মানুষের সরাসরি কর্মসংস্থান হয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রযুক্তি সেবার রপ্তানি বৃদ্ধি ও বাজার সম্প্রসারণের সম্ভাবনা অনেক। আমাদের তৈরি পোশাক খাত বৈদেশিক মুদ্রার ৮৪ শতাংশই আয় করে থাকে। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের সব সম্ভাবনা রয়েছে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান রপ্তানি খাত হিসেবে পরিণত হওয়ার।

একটি শক্তিশালী তথ্যপ্রযুক্তি খাত বাংলাদেশকে গ্লোবাল আইসিটি হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে, যেখানে সমাজ এবং নাগরিকরা সমানভাবে এর সফলতা ভোগ করতে পারবেন। এখন আমাদেরকে আমাদের সক্ষমতা, সফলতার গল্পগুলো আমাদের সম্ভাবনাময় বাজারগুলোতে তুলে ধরতে হবে। বর্তমান প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশ্বব্যাপী যে ব্র্যান্ড ইমেজ রয়েছে, সেটির যথাযথ ব্যবহার ও সরকারের সহযোগিতার মাধ্যমে ইউরোপসহ বিভিন্ন বাজারে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ব্যবসায় সম্প্রসারণ সম্ভব। যার মাধ্যমে স্থানীয় কোম্পানিগুলো আরও অধিক পরিসরে ব্যবসায় সমৃদ্ধি ঘটাতে পারে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসায় কৌশল ও মডেল আয়ত্ত করে বাংলাদেশে উদ্যোক্তাদের মধ্যে সেই জ্ঞান ছড়িয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের যেহেতু উদ্ভাবনের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে, সেগুলো যথাযথ বাজারের সামনে তুলে ধরা আবশ্যক।

আইসিটি খাতকে এগিয়ে নিতে হলে বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আইসিটি খাতকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসতে হবে।

সর্বোপরি, তথ্যপ্রযুক্তিকে সব খাতে প্রয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশকে শীর্ষস্থানীয় আইসিটি হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠার এখনই সময়। কৌশলগত পরিকল্পনার মাধ্যমে বাংলাদেশ তার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে এবং একটি তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ও আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধির ভবিষ্যৎ উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।

*লেখক: সাইমন মোহসিন,আন্তর্জাতিক বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও নূর খান, সিইও, রাইট ব্রেইন সল্যুশন লিমিটেড

*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]