দুর্বিষহ সময়ে আমার পাশে মা
১২ মে মা দিবস হিসেবে পালিত হয়। প্রবাস থেকে পাঠানো পাঠকের লেখা থেকে বাছাই করা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।
সালটা ছিল ২০১৮। আমি তখন একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। পড়াশোনা তেমন একটা করতাম না। তাই আম্মু সব সময় আমাকে বলত, ‘এখন পড়তেছ না, পরীক্ষার হলে গিয়ে যখন কিছু পারবা না, তখন এ সময় নষ্ট করার কথা ভেবে তুমি আফসোস করবা।’ এরপরও আমি পড়াশোনা নিয়ে কখনোই তেমন সিরিয়াস ছিলাম না।
হঠাৎ একদিন বাসা থেকে আমার বড় বোনের একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা জানতে পারে। এর জন্য পরিবারে অনেক সমস্যা হয়, আমার নানুবাড়ির দিকের সবাই আমাকেই দোষারোপ করছিল এটা বলে যে, আমি বোনকে এ ব্যাপারে সাহায্য করেছি। এ জন্যই এই বখাটে ছেলের সঙ্গে আমার বোনের সম্পর্ক হয়েছে। এ সময় আমার বড় বোন নানুবাড়িতে থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য কোচিং করছিল। এ রকম অবস্থায় তখন মামা, খালা, নানু, নানি—সবাই আম্মুকে বলে তোমার মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দাও, ওরা জীবনে কখনোই ভালো কিছু করতে পারবে না। পড়াশোনাও তো ঠিকমতো করে না, ওদের আর পড়াশোনা করায়ে লাভ নেই।
আমার আম্মু সেই মুহূর্তে সবার বিপক্ষে গিয়ে রাত ১১টায় নানুবাড়ি থেকে আমাদের তিন বোনকে নিয়ে থেকে চলে আসে। বলা বাহুল্য, আমার একটা ছোট বোনও আছে। সেদিন সবাই আমার বিপক্ষে আজেবাজে কথা বললেও একমাত্র আম্মু আমাকে সমর্থন করে বলেছিল, ‘যদি তোমার আব্বুও পড়াশোনা না করাতে চায়, আমি নিজের গয়না বিক্রি করে হলেও তোমাকে আর তোমার বোনকে পড়াব।’ এর পর থেকে আমার আম্মুর মুখের দিকে তাকালেই আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ত। প্রতিমুহূর্তে মনে হতো, আমাকে ভালো ফল করতেই হবে, আমি সসম্মানে আমার আম্মুকে নানুবাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাব, ইনশা আল্লাহ। তখন থেকে আমি অনেক পরিশ্রম করতাম পড়াশোনার জন্য। হাতে সময় ছিল মাত্র এক বছর, এরপরই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। দিনরাত এক করে পড়াশোনা করলাম। এরপর পরীক্ষা শুরু হলো, পরীক্ষার হলে যখন যেতাম, আমার বন্ধুরা আমাকে দেখেই বলত, ‘তোকে দেখে মনে হচ্ছে এই বুঝি তোর চোখ দিয়ে পানি পড়বে, এত বেশি টেনশন করিস না, অসুস্থ হয়ে পড়বি।’ কিন্তু আমি তারপরও স্বাভাবিক হতে পারতাম না। ভয়ে ভয়ে পরীক্ষাগুলো শেষ করলাম।
মনে অনেক আশা, কিন্তু বুকের মধ্যে রয়েছে ভয়, যেটা প্রকাশ করতে পারতাম না বলে ফলাফলের আগে আম্মুকে প্রায়ই ফোন দিয়ে শুধু কান্নাকাটি করতাম আর বলতাম, ‘আম্মু, আমি এ প্লাস পাব তো?’ আম্মু সব সময় আমাকে সাহস দিত, ভরসা দিত আর বলত, ‘আমার বিশ্বাস, তুমি পারবা।’
যেদিন আমার রেজাল্ট দেবে, ওই দিন আব্বু ফোন করলে শুনি, আমি এ প্লাস পেয়েছি, বাংলায় ২ নম্বর কম পাওয়ায় গোল্ডেন এ প্লাস পাইনি। আমার ফল শুনে আম্মুর সে কী কান্না, দিনটির কথা আজও মনে পড়লে চোখ ভিজে যায়। আমিও তখন দীর্ঘশ্বাস ফেলে নফল নামাজ পড়ে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেছিলাম এটা বলে, আল্লাহ আমার কষ্টের ফল দিয়েছেন এবং আমার ওপর করা আম্মুর বিশ্বাসের মর্যাদা আমি রাখতে পেরেছি।
*লেখক: জান্নাতুল নাঈমা মুন, শিক্ষার্থী, চতুর্থ বর্ষ, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]