যখন কল খুলে পানি আসবে না: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পানিসংকটের ভয়াবহতা
একটি দিন কল্পনা করুন, আপনি ঘুম থেকে উঠেছেন, মুখ ধুতে গেছেন, কল খুলেছেন, কিন্তু পানি নেই। আধা ঘণ্টা অপেক্ষা করলেন, তবু পানির কোনো সাড়া নেই। আপনার মা রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে; চাল ধোয়া তো দূরের কথা, সকালে চা-ই বানাতে পারছেন না। এমন দিন যদি প্রতিদিন হয়? অনেকেই ভাবতে পারেন, এটা তো আফ্রিকার সাহারার মতো দেশে ঘটে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই ভয়াবহ পানির অনিশ্চয়তা আমাদের বাংলাদেশেও দ্রুত এগিয়ে আসছে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় এখন যে পানি আমরা পাচ্ছি, তা হয়তো ১০-১৫ বছর পর আর সহজলভ্য থাকবে না। ভূগর্ভস্থ পানির ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী ঢাকায় বর্তমানে প্রায় দুই কোটি মানুষ বসবাস করছে, আর প্রতিদিনের পানির প্রয়োজন ২ দশমিক ৬ বিলিয়ন লিটার। ঢাকা ওয়াসা এর ৭৫-৮০ শতাংশ সরবরাহ করে ভূগর্ভস্থ পানি থেকে (DWASA, 2023)। কিন্তু প্রতিবছর এই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ২-৩ মিটার (৬.৫-১০ ফুট) করে নিচে নেমে যাচ্ছে (BADC, 2022)।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গত ৩০ বছর আগে যেই পানির স্তর ছিল মাত্র ২০ থেকে ৩০ ফুট নিচে, এখন সেটাই নেমে গেছে ২০০ ফুটের নিচে। উত্তরা ও মিরপুরের মতো এলাকায় কোথাও কোথাও ৩০০ ফুট গভীরেও পানির দেখা মেলে না। এর অন্যতম কারণ হলো, বার্ষিক পুনঃভরণ হারের তুলনায় বেশি হারে পানি উত্তোলন এবং শহরে খোলা মাঠ ও জলাভূমি হ্রাস পাওয়া। ঢাকা শহরের ৭০ শতাংশের বেশি এলাকা কংক্রিট ও পিচঢালা, যার ফলে বৃষ্টির পানি মাটির নিচে যেতে পারছে না (RAJUK, 2021)।
বরেন্দ্র ও উপকূল—
একদিকে খরা, অন্যদিকে লবণাক্ততা রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁর বরেন্দ্র অঞ্চল—এই এলাকাগুলোতে পানির স্তর এতটাই নিচে নেমে গেছে যে কৃষকেরা বৈশাখ মাস এলেই আতঙ্কে থাকেন। অনেক সময় গভীর নলকূপ চালু করেও পানি ওঠে না। এই অঞ্চলগুলোর মাটি শুষ্ক এবং পাথুরে, তাই বৃষ্টির পানি তেমন ধরে না। বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক স্থানে ৩৫০ ফুটের নিচে চলে গেছে (BMDA, 2022)। অন্যদিকে উপকূলীয় এলাকা সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটে ভূগর্ভস্থ পানি আছে ঠিকই, কিন্তু অধিকাংশই লবণাক্ত।
বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণা অনুযায়ী, খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার ৬৫ শতাংশ গভীর নলকূপে লবণাক্ততা গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি (World Bank, 2021)। আপনি চাইলে সেই পানি দিয়ে গাছের চারা ধুয়ে দেখুন, মরে যাবে। পানের মতো পানিও যখন বিষের মতো হয়ে দাঁড়ায়, তখন বোঝা যায় প্রকৃতি কতটা প্রতিশোধপরায়ণ হতে পারে।
জলবায়ু পরিবর্তন—
পানির রাজ্যে খরা ও বন্যার আগ্রাসন বাংলাদেশের পানি সমস্যা এখন আর কেবল একটি মৌসুমি সংকট নয়, এটি জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর প্রতিক্রিয়া। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্ষার সময়সীমা কমছে কিন্তু স্বল্প সময়ে অধিক বৃষ্টিপাত বাড়ছে। অন্যদিকে খরার সময় দীর্ঘায়িত হচ্ছে, যা ভূগর্ভস্থ পানির পুনঃভরণ ব্যাহত করছে (BMD, 2022)। অল্প সময়ে বেশি বৃষ্টি আর লম্বা সময় খরা—এই চক্রে আমাদের নদী, খাল, বিলগুলোর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ ভেঙে পড়ছে। পাশাপাশি প্রতিবছর ২০ হাজারের বেশি ছোট-বড় জলাশয় ও খাল ভরাট হয়ে যাচ্ছে (DoE, 2020)। নদী আর মাটি যখন পানি রাখতে পারবে না, তখন মানুষও আর নিজেকে টিকিয়ে রাখতে পারবে না।
নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
তরুণদের জন্য বার্তা—
কল্পনা করুন, ২০৪০ সাল, আপনি হয়তো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন বা চাকরি করেন। আপনার এলাকার সুপেয় পানির উৎস শুকিয়ে গেছে। জলের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি, আপনার বোন আর মা। পানি কিনে খেতে হচ্ছে, দাম প্রতি লিটার ২০ টাকা। এখনকার ২০ টাকার মতো না বরং হয়তো ১০০ টাকার সমান দামে। আপনার বাচ্চার স্কুলের মাঠে খেলা বন্ধ হয়ে গেছে, কারণ মাঠে পানি দেওয়ার সুযোগ নেই। পানি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাড়ছে গ্রামে গ্রামে, শহরে শহরে। এই দৃশ্য কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি নয়। জাতিসংঘ বলছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বিশ্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষ পানির প্রবল সংকটে পড়বে (UNICEF, 2021)। এই ভবিষ্যৎকে সামনে রেখেই এখন পদক্ষেপ না নিলে, পরিস্থিতি আর আমাদের হাতে থাকবে না।
সমাধানের পথ কী হতে পারে
সঠিক নীতি, টেকসই প্রযুক্তি ও জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পানিসংকট মোকাবিলায় আমাদেরকে একযোগে প্রযুক্তিগত, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সামাজিক পদক্ষেপ নিতে হবে। এই বিপদ থেকে দেশকে রক্ষা করতে হলে এখনই কিছু কাজ করতে হবে, যেগুলো সহজ, ব্যবহারযোগ্য এবং সবার জন্য উপকারী।
প্রথম কাজ হলো, বৃষ্টির পানি ধরে রাখা। শহরের প্রতিটি নতুন বাড়ি বানানোর সময় ছাদে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে করে গরমকালে যখন পানি কম থাকে, তখন এই জমানো পানি ব্যবহার করা যাবে। একটি পরিবার বৃষ্টির দিনে ২০ থেকে ২৫ হাজার লিটার পর্যন্ত পানি ধরে রাখতে পারে, যা অনেক দিনের চাহিদা মেটাতে পারে। রাজশাহীতে এই পদ্ধতি শুরু হয়েছে এবং খুব ভালো ফল দিচ্ছে।
আরেকটি দরকারি কাজ হলো, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আবার ওপরে তুলতে হবে। এখন আমরা যত পানি মাটির নিচ থেকে তুলে নিচ্ছি, তত পানি আর নিচে যাচ্ছে না। তাই শহরের খালি মাঠ, পার্ক বা সরকারি জায়গায় এমন ব্যবস্থা করতে হবে, যেন বৃষ্টির পানি আবার মাটির নিচে ঢুকে যায়। এতে করে কূপ, নলকূপ বা ডিপ টিউবওয়েল আবার পানি দেবে।
পুকুর, দিঘি, খাল—এসব জলাশয় রক্ষা করা এখন খুব জরুরি। অনেক জায়গায় এই জলাধারগুলো মাটি ফেলে ভরাট করে ফেলা হচ্ছে। প্রতিটি ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডে একটি পুকুর বা দিঘি বাধ্যতামূলকভাবে সংরক্ষণ করতে হবে। এতে করে শুধু পানি জমে থাকবে না, বর্ষাকালে যখন বেশি পানি হয়, তখন জলাবদ্ধতাও কমবে।
চাষাবাদেও পরিবর্তন আনতে হবে। এখনো অনেক জায়গায় পানি ঢেলে ঢেলে ধান চাষ হয়, যেখানে কম পানি দিয়েও চাষ করা যায়। ‘বিকল্প ভেজানো ও শুকনা রাখা’ নামে একটি পদ্ধতি আছে, যেটা বরেন্দ্র এলাকায় ব্যবহার হচ্ছে, এতে ধান চাষে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত পানি কম লাগে। এমনভাবে পানি বাঁচিয়ে চাষ করতে হবে।
ছাত্রছাত্রী ও তরুণদের এই কাজে যুক্ত করা দরকার। প্রতিটি স্কুলে পানিসচেতনতা ক্লাব গঠন করা যেতে পারে, যেখানে ছোটরা শিখবে কীভাবে পানি রক্ষা করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পানির ওপরে নতুন চিন্তা, পরীক্ষা ও উদ্যোগে তরুণেরা অংশ নিতে পারবে।
শুধু কাজ করলেই হবে না, নিয়মকানুনও মানতে হবে। কেউ যদি বেশি পানি অপচয় করে বা কল খোলা রেখে দেয়, তাকে জরিমানা দিতে হবে। পানির ব্যবহার যেন সঠিকভাবে হয়, সেই জন্য সঠিক পরিমাপের ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেমন বিদ্যুৎ বেশি ব্যবহার করলে বেশি বিল আসে, তেমনি পানি অপচয় করলেও বিল বাড়বে—এমন ব্যবস্থা নিতে হবে।
সবশেষে, সরকার নয়, সাধারণ মানুষ, দোকানদার, স্কুল, হাসপাতাল—সবার অংশগ্রহণ দরকার। যারা ভালোভাবে পানি ব্যবহার করবে, যেমন বৃষ্টির পানি ধরে রাখবে, ফিল্টার ব্যবহার করবে, তাদের জন্য কর (ট্যাক্স) কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য পানি সংরক্ষণের সহজ যন্ত্র বানাতে উৎসাহ দিতে হবে।
এই সবকিছু যদি আমরা এখন থেকেই ধীরে ধীরে শুরু করি, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।
লেখক: মোহাম্মদ আনিসুর রহমান রানা, ভূতত্ত্ববিদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়