দূরে কোথাও
পুকুরটা কত বড় হবে, তা বুঝতে না পারলেও অনুমান, এ রকম পুকুর জীবনে এই প্রথম, পুকুরের পাড়গুলো যেন অন্ধকারের রাজ্য, দিনের বেলায়ও নিজের শরীর দেখতেও চোখ বড় বড় করতে হয়, ওই যে আমাদের মহারাজার দীঘি অথবা রামসাগর, ওরাও লজ্জা পাবে পুকুরটার বিশালতায়! তবে সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েও এর পুরোটা দেখার সৌভাগ্য হয়নি আমার। আমার গিন্নিসহ বেড়ানোর এক ফাঁকে এই রকম বিশাল পুকুরের সন্ধান পাব, তা কল্পনায় আসেনি কখনো। হেঁটে চলছি আমরা, মাঝেমধ্যেই সূর্যের আলোর হাতছানিতে চোখে পড়ছে পুকুর পাড়ের অপরূপ সৌন্দর্যের সমারোহ। এ রকম উঁচু সারি সারি গাছ টিভিতে দেখেছিলাম বহুবার, আজ স্বচক্ষে।
হঠাৎই পায়ের জুতায় কিছু একটা আটকানো অনুভব করতে জুতাটা খুলতে খুলতেই হাত থেকে ছিটকে কোথায় যেন হারিয়ে গেল, ঠাওর করতে পারছিলাম না, অগত্যা জুতার অভাবে বউকে বললাম, ‘তুমি ঠিক আছো তো? আমি তো আর হাঁটতে পারছি না!’ পায়ে কোনো কিছু একটা বিঁধবে এই ভয়ে, এভাবে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমূঢ় দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎই এক অপরূপা ষোড়শী এসে আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল, আমার ভ্রম ধরেনি তো! নিজের চোখগুলোকে পরীক্ষা করছিলাম, না ঠিকই দেখছি; মেয়েটি আসলেই সামনে দাঁড়িয়ে, হাতে সেই আমার হারিয়ে যাওয়া জুতাটা। জুতাটা নেওয়ার কথা ভুলে গিয়ে তাঁকিয়ে আছি অপলক দৃষ্টিতে, জীর্ণশীর্ণ পোশাকে আর মুখমণ্ডলে ঘামের সঙ্গে কালো দাগে মিশে গেলেও আলতো দুধে মেশানো রংটি কিন্তু ঠিকই ফুটে উঠেছে! মেয়েটি আংকেল বলে ডাকতেই যেন আমার হুঁশ হলো, দেখলাম, এক হাতে গাছের শুকনা ডালপালার একটি ছোট বোঝা, অন্য হাতে আমার জুতাটা, ‘আংকেল, এটা মনে হয় আপনার? খড়ি কুড়াতে গিয়ে পেলাম, তাই এদিক–ওদিক খুঁজতে খুঁজতেই আপনাদের পেয়ে গেলাম।’ আমার বউ শুধু মেয়েটির দিকেই তাকিয়ে আছে, কোনো কিছুই বলছে না। আমি জুতাটা পায়ে দিয়েই মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার নাম ও বাড়ি। মেয়েটি বলল, ‘চৈতী, থাকি ওই যে নিচে, একটা ছোট ঘরে, মামা–মামির সঙ্গে।’
‘খড়ির বোঝাটা রাখো তো বেটি, চলো, আমাদের একটু পথ দেখাও।’ মেয়েটি সাঁয় দিয়েই আমাদের সঙ্গে খুব ধীরগতিতে হেঁটে চলল, আমরাও চারপাশ অবলোকন করতে করতে চলছি, হঠাৎই দেখি আমার স্ত্রী অনেক পেছনে, আর সে চিৎকার করে বলছে, ‘দেখো তো, এই মহিলাটা আমার পথ আটকিয়ে ধরছে, যেতে দিচ্ছে না!’ আমি মহিলাটার কাছে গিয়ে খুবই চড়া গলায় গালি দিচ্ছি আর তখনই চৈতী গিয়ে মহিলাটিকে ধাক্কা দিয়ে তাঁর আন্টিকে আগলিয়ে নিল, মহিলাটি এবার খুব অদ্ভুত স্বরে কাকে যেন ডাকতেই অদ্ভুত রকমের এক বিদঘুটে লোক ধাঁরালো অস্ত্রসহ আমাদের পথরোধ করল, আমি ভয় না পাওয়ার ভান করে তাদের সামনে থেকে সরিয়ে যেতে বলাতেই ওই বিদঘুটে চেহারার লোকটি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল, আমিও সাহসের সঙ্গেই মোকাবিলা করার জন্য প্রস্তুত, জানি এ রকম পরিস্থিতিতে মনের সাহসটাই বড় কথা, তাই লোকটার থেকে আমিই একটু এগিয়ে গেলাম। বিদঘুটে লোকটা তার বিশাল ধাঁরালো অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসতেই নিমিষেই কে যেন তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল আর আমি তৎক্ষণাৎ লোকটার দুইপা ধরে, দুটো ঘুরানি দিয়ে বনভোজনের জন্য রান্না করার বড় একটি পরিত্যক্ত চুলার মধ্যে তার মাথাটা ঢুকিয়ে দিলাম ঠান্ডা ছাইয়ে। বিদঘুটে লোকটার কাতরানি দেখার মতো! ঠিক ওই মুহূর্তে দেখতে পেলাম তিরিশোর্ধো ফর্সা রঙের হালকা–পাতলা গড়নের এক যুবক যে ওই বিদঘুটে লোকটিকে বিদ্যুতের গতিতে এসেই ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিল। আর ওই যে মহিলাটা, তার চুলের মুঠি ধরে আমার স্ত্রী আর চৈতী মাটিতে ফেলে দিয়ে খড়ি দিয়ে বেধড়ক পেটাতে শুরু করে দিয়েছে, আর আমার হাতে তখনো ধরা আছে বিদঘুটে লোকটার পা দুটো যার মাথাটা চুলোর ছাইয়ে ঢুকিয়ে দিয়েছি। বেশ কিছুক্ষণ পর ওই মহিলা ও লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে একখানে বসিয়ে তাদের মুখ থেকে কথা নিলাম আর কখনো কারও সঙ্গে যেন ও রকম আচরণ না করে, তারা আমাকে বাপ ডেকে তওবা করে বলল, ‘যত দিন বেঁচে আছি, এই পাহাড়ে যারা আসবে, তাদের সেবা করে যাব’ তাদের ছেড়ে দিয়ে যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলাম, তার নাম ও বাসা। ‘থারুপা কুমার, নেপালি, থাকি ওই যে দূরে পুকুরের অপর কোনের নিচে।’
‘তুমি এ দেশে কীভাবে এলে? কবেই–বা এসেছ?’ ‘এখন আর মনে নেই স্যার, তবে আমার বাড়ি নেপাল এটা মনে পড়ে, অনেক বছর হলো তো!’
‘চৈতী’ আর ‘থারু’-র ও রকম অসহায়ত্ব জীবনের কথা শুনে মুখ থেকে আর কোনো কিছু উচ্চারণ করতে পারছিলাম না আমি, আমার স্ত্রীরও মুখে কোনো কথা নেই। আমাদের কিছু খাবার ছিল সঙ্গে, একখানে বসে চৈতী আর থারুকে বললাম খেতে, তাঁরা চুপচাপ খেতে লাগল। চৈতীকে শুধু জিজ্ঞাসা করলাম, ‘তুমি খড়ি কুড়াতে আসো কেন? তোমার মামা মামি তো আছে?’ সে এমনভাবে কেঁদে দিলো হাউমাউ করে, যেন কোনোদিন এভাবে কান্না করেনি কখনো। আর থারু দেখি খাওয়া বন্ধ করে চেয়ে আছে চৈতীর দিকে, হয়তো ভালোবাসা জেগে উঠেছে মনে!
ধ্যাত! এতক্ষণ তবে স্বপ্ন দেখছিলাম!
হ্যাঁ, স্বপ্নেই এসব দেখা কিন্তু তবে তারপর কি হলো তা না শুনে যাবেন কি করে!
‘থারু....’ ‘ও থারু.....’ খুবই মৃদু স্বরে ডাকছিলাম আমি।
এবার যেন হুশ ফিরে এলো থারুর, ‘জী স্যার! হ্যাঁ স্যার! বলেন স্যার!’
‘আরে কি দেখছিলে অমন করে? ওর নাম চৈতী, থাকে ওই খানে নিচে, তার মামা–মামির সঙ্গে। যতটুকু দেখলাম, সে খুব ভালো মেয়ে।’ আমার এ রকম কথা শুনে থারু যেন লজ্জা পেয়ে গেল, একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে গেছে বেচারা! আর কথা বের হয় না। আমিই তাকে সাহস যুগিয়ে বললাম, ‘নাও, তারাতারি খেয়ে নাও। কোনো একদিন তোমাকে নিয়ে চৈতীদের বাড়িতে যাব।’ এবার বেচারার খাওয়া আটকে গেছে গলায়, কথাই বলতে পারছে না দেখে চৈতীকে বললাম, ‘থারুকে ওই পানির বোতলটা দাও তো বেটি।’ বলা মাত্রই চৈতী পানির বোতলের ছিপিটা খুলে, খুবই যত্নসহকারে থারুর হাতে এগিয়ে দিয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘নাও, পানি খাও। ঠিক হয়ে যাবে।’ থারু পানি পান করছে ঠিকই, কিন্তু চোখগুলো নিবিষ্ট হয়ে আছে আবারও সেই চৈতীর দিকে। সে হয়তো অবাক হয়ে চৈতীর এমনভাবে কথা বলা ভাবতেই পারেনি।
হ্যাঁ, এই সেই মেয়ে চৈতী, থাকে মামা–মামির সঙ্গে ছোট এই সাগর পাড়ের নিচে, ওই ছোট ঝুপড়িতে।
‘আংকেল, তোমরা যাবে আমাদের বাড়িতে?’
‘অবশ্যই বেটি! তোমার আন্টিসহ যাব দু–এক দিনের মধ্যে। থারু, তুমিও যাবে আমাদের সঙ্গে।’
আমার এ রকম আপনভাবে কথা বলা শুনে, দেখলাম, চৈতীর চোখগুলো থেকে যেন হঠাতই আবার বৃষ্টি নেমে এলো কিন্তু এটা কান্না না আনন্দাশ্রু তা পরে বুঝতে অসুবিধা হয়নি।
তবে চৈতী কিন্তু চেষ্টা করল তার চোখের পানি আড়াল করতে চোখে কিছু একটা পরেছে সেই অজুহাতে। তবে মুহূর্তেই মেঘের আড়ালে সূর্যের হাসির মতই চমৎকার ফুটে উঠল চৈতীর চোখে মুখে সুখের সাগরে ভেসে বেড়ানো অফুরন্ত হাসির ফোয়ারা! এ যেন স্বর্গসুখ তার কাছে! আর সেই হাসিমাখা মুখখানা দেখতে দেখতে কখন যে চৈতী এসে আমাদের পা ছুঁয়ে সালাম করল বুঝতেই পারিনি। এবং আমাদের কাছে এসে এমনভাবে ঘেঁষে দাড়ালো যেন সে মনে করছে, সেই রাজ্যের সে এখন রাজকুমারী আর রাজকন্যার তদারকিতে নিয়োজিত আছি আমরা দুই রাজারানী।
কী আর করা! এমন মায়াবী মেয়েটাকে পেয়ে আমরাও দুজনেই আনন্দে জড়িয়ে ধরলাম চৈতীকে। এ রকম সুখও যে পৃথিবীতে আছে চৈতী হয়তো এবারই প্রথম অনুভব করলো কারণটা অন্য কোনো এক সময় বলব আপনাদের।
থারু কিন্তু এবার কথা বলতে শুরু করল,
‘স্যার, আমি এত বছর থেকেই এখানে আছি, পাড়গুলো আমার খুবই চেনা কিন্তু চৈতীকে কোনো দিন চোখে পড়েনি, আপনাদের সঙ্গে কেমন করে পরিচয় হলো তার? বুঝতেই পারছি, আপনারা আজকেই প্রথম এসেছেন এই বিশাল পুকুর আর এর পাড়ের শোভা উপভোগ করতে।’
‘আরে থারু! তোমার কথা বলো, চৈতীকে নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না। ধরে নাও, সে আমাদেরই মেয়ে!, এবার হলো তো?’
‘জি স্যার! তো আমি যেখানে থাকি সেখানেও কিন্তু যেতে হবে স্যার।’
‘কেন? চৈতীর বাড়িতে যাব, তাই তোমার হিংসে হয় নাকি? আচ্ছা, তোমার আন্টিসহ চৈতীকে নিয়ে একদিন তোমার বাড়িতেও যাবো, ঠিক আছে?’
‘জি স্যার, আমাকে কিন্তু দু’এক দিন আগেই বলবেন স্যার যখন যাবেন।’
‘আচ্ছা, জানিয়ে যাব।’
চৈতী কিন্তু এবার অভিমানের সুরে থারুর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘যাওয়ার আগে তাকে জানিয়ে যেতে হবে! তার মানে সে বাড়িতেই থাকে না! বুঝেছ আংকেল? এই, তোমাকে জানিয়ে যেতে হবে কেন?’ এবার সরাসরি থারুর দিকে কড়া গলায় ধমকের স্বরে বলেই ফেলল চৈতী।
থারু ও চৈতীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎই আবার সেই মহিলা আর বিদঘুটে লোকটা এসে আমাদের সামনে বসে পেয়ারাভর্তি একটা ঝুড়ি রেখে মহিলাটি বলল, ‘বাপজান, তোমাদের জন্য এনেছি, এগুলো তোমরা বাড়িতে নিয়ে যেও।’ তাদের এ রকম পরিবর্তন দেখে আমি কি বলব আর ভাষা খুঁজে পেলাম না! চৈতীকে শুধু বললাম, ‘নাও চৈতী, পেয়ারা খাও, থারুকেও দাও।’ চৈতী কিন্তু পেয়ারাগুলো বোতলের পানি দিয়ে ধুইয়ে আগে আমাকে ও তার আন্টিকে দিল, তারপর থারুকে দিয়ে বলল, ‘খাও, এবার যেন আবার গলায় আটকে না যায়!’
হাতে পেয়ে আমি পেয়ারাটাতে কামড় বসাতে যাব, ঠিক ওই মুহূর্তে আমার স্ত্রীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল, নিজেকে আবিষ্কার করলাম, সেই প্রতিদিনের মতোই বিছানায়! ঘড়িতে দেখি সকাল আটটা। সত্যি, এতক্ষণ তবে স্বপ্নেই হারিয়ে গিয়েছিলাম ‘দূরে কোথাও’।
*লেখক: মো. আজহারুল ইসলাম জুয়েল, সিনিয়র শিক্ষক (ইংরেজি), ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার কলেজিয়েট ইনস্টিটিউট, পঞ্চগড়