প্রাথমিকে আবার বৃত্তি পরীক্ষা চালু হোক
মৃৎশিল্প তৈরির আগে মাটিকে মৃৎশিল্পের উপযোগী করে নিতে হয়। তারপর একটা ছাঁচে পরিণত করতে হয়। তেমনি শিশুদের আত্মোন্নয়নে শৈশব ও কৈশোর থেকেই বাড়তি নজর রাখতে হয়। পড়াশোনা, খেলাধুলা ও চলাফেরায় ইতিবাচক প্রতিযোগিতা রাখতে হয়। ইতিবাচক প্রতিযোগিতা শিশুর মানসিক বিকাশ করে। তন্মধ্যে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা একটি ইতিবাচক প্রতিযোগিতা। কিন্তু কয়েক বছর ধরে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। শিশুদের ইতিবাচক প্রতিযোগিতার দিকে দৃষ্টিপাত করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আবার বৃত্তি পরীক্ষা চালু করা হোক। যখন একটি শিশু বৃত্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে, তখন তার পড়াশোনার প্রতি মনোবল দ্বিগুণ হারে বেড়ে যায়। নিজের প্রতি একটা বোধ তৈরি হয়, ‘আমাকেও পারতে হবে’।
শিশুরা তাদের রোল মডেলকে অনুসরণ করে সামনের দিকে চলতে থাকে। যেমন একটি শিশুকে যদি একটি ফুল বা ফলের ছবি এঁকে দিই এবং অনুরূপ একটা আঁকতে বলি, তাহলে সে সহজেই তা আঁকতে পারবে, কারণ তার সামনে একটি মডেল থাকবে। তেমনি তাদের স্কুলে অথবা বাসায় যদি সাফল্যের কোনো রোল মডেল থাকে, তাকেও শিশু সহজেই অনুসরণ করে চলে। ইতিবাচক প্রতিযোগিতা শিশুকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে। স্যার ডার ভেন ডার লিনডেনের মতে, প্রতিযোগিতা মানুষের অনুপ্রেরণার প্রধান উৎস, প্রতিযোগিতা শেষ হলে তারা আর অনুপ্রেরণা পায় না।
আমরা সবাই জানি যে শিশুদের মন থাকে সাদা কাগজের মতো। সাদা কাগজে চাইলেই যেমন যেকোনো কিছু অঙ্কন করা যায় এবং সহজে তা ফুটে ওঠে, তেমনি শিশুকে শৈশব ও কৈশোরে যা শেখানো হবে,তা–ই তারা পরবর্তী জীবনে লালন করবে। শিশুর প্রথম জীবনের সামাজিকীকরণ সঠিক হলে পরবর্তী সময়ে বিরাট প্রভাব রাখবে।
শিশুরা অনুকরণপ্রিয়। তারা যখন আশপাশে সাফল্য দেখে, সেভাবেই নিজেকেও কল্পনা করে এবং কল্পনাকে বাস্তবে প্রস্ফুটিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টায় রত হয়। সাফল্যের স্বাদ পেলে তারা আনন্দিত হয়, আবার ব্যর্থ হলে নিজেকে শুধরে নিতে পারে। তা ছাড়া শিশুরা প্রতিযোগিতার মাধ্যমে আত্মসমালোচনা করার সুযোগ পায়। আত্মসমালোচনা শিশুর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখে। ফলে তারা নিজের ভালো-মন্দ, সঠিক-ভুল অনুধাবন করতে পারে।
বৃত্তি পরীক্ষা ঘিরে কতশত স্মৃতি জমা থাকে পরতে পরতে। পুরোনো বইয়ের সঙ্গে নতুন বইয়ের সংযোজন, জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার সাহস শিশুর মনোবল বৃদ্ধি করে, নতুন নতুন নিয়মশৃঙ্খলা শেখায়, সময়ানুবর্তিতা ইত্যাদি অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হয়। এ ছাড়া সাফল্যের পরবর্তী সময় সবার অনুপ্রেরণা নিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। শৈশবের আবেগঘন এমন সব স্মৃতি শিশুর মনে অঙ্কিত থাকে।
অনেকেই পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষার নেতিবাচক দিক সম্পর্কে আলোকপাত করে বলবে, এটি শিশুর মনে চাপ ফেলে, শিশুর জন্য বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। কিন্তু আমি মনে করি, এটি তার চেয়ে বেশি ইতিবাচক প্রভাব ফেলে শিশুর মনে। তারা পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে শেখে, অধিক চাপ নিতে সক্ষম হয়, সময়ানুবর্তিতা শৈশব থেকেই রপ্ত হয়, আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে অভিযোজন করতে পারে। সর্বোপরি শিশুর মনোবৃত্তি বিকাশে সহায়তা করে। হাজারো নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির ভিড়ে পঞ্চম শ্রেণির বৃত্তি পরীক্ষা শিক্ষার্থীর জন্য ইতিবাচক হোক। আমরা নেতিবাচক চিন্তাভাবনা বর্জন করে ইতিবাচক ভাবনা শুরু করি। শিক্ষার্থীর মনস্তাত্ত্বিক বিকাশ বা সঠিক সামাজিকীকরণের কথা ভেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বৃত্তি পরীক্ষা আবার শুরু হোক, এটাই প্রত্যাশা। সঠিক সামাজিকীকরণে শিশুর জীবন হোক পুষ্পের মতো কোমল ও সুবাসিত।
*লেখক: বিথী হোসাইন, শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
*নাগরিক সংবাদ–এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]