পাগলির ছেলে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রাত প্রায় ১২টা বাজে। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়ও বইছে সমানতালে। মাঝেমধ্যে মেঘ গর্জন করে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। রেণুর একমাত্র মেয়ে ঝুমুকে নেওয়া হয়েছে ঢাকা রামপুরার এক বেসরকারি প্রাইভেট ক্লিনিকে। সে এখন ওটি রুমে। ক্লিনিকের বারান্দায় উদ্বিগ্ন হয়ে পায়চারি করছে বাবা রনজু মিয়া। আর মা রেণু বেগম দুশ্চিন্তা মুখে বারান্দার এক কোণে চেয়ারে বসে বারবার ওটি রুমের দরজার দিকে তাকাচ্ছে। হঠাৎ শিশুর কান্নার আওয়াজ। রেণু বেগম চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল। রনজু মিয়ারও হাঁটা থেমে গেল। একটু পরেই রুমের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এল গাইনি ডাক্তার নিলু।

রনজু মিয়া আর তাঁর স্ত্রী রেণু ছুটে গেল ডাক্তার নিলুর কাছে। ঝুমুর কথা জিজ্ঞাসা করতে। ডাক্তার নিলু হেসে উঠে বলল আপনাদের নাতি হয়েছে। এখন মা-ছেলে দুজনেই সুস্থ আছে।

কিন্তু ঝুমুর মা–বাবার মুখে হাসির লেশমাত্র নেই।

কী করে থাকবে? আজ যেখানে তাঁদের খুশি হওয়ার কথা। সেখানে লজ্জায় তাঁদের মাথা নুইয়ে আসছে। তাদের মেয়ে ঝুমুর যে এখনো বিয়েই হয়নি। লোকসমাজে মানুষের কাছে বাচ্চাটির তাঁরা কী পিতৃপরিচয় দেবে?

কী করে মানুষদের বলবে? এক কাপুরুষ তাঁদের মেয়ের সঙ্গে ভালোবাসার অভিনয় করে এমন সর্বনাশ করে পালিয়েছে। সেই লম্পটের লোভের ফসল এই শিশু। মেয়ে ঝুমু এখনো অচেতন।

এই সুযোগ বাচ্চাটাকে সরিয়ে তাঁদের মানসম্মান রক্ষা করার। রনজু মিয়া একজন ব্যবসায়ী। যথেষ্ট টাকার মালিক। রনজু ডাক্তারকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে মোটা অঙ্কের টাকা দিল যেন তাঁরা মুখটা বন্ধ রাখেন। আরও বলল, আমার মেয়ে জ্ঞান ফিরার পর জিজ্ঞাসা করলে বলবেন তাঁর মৃত বাচ্চা হয়েছে। ঝুমুর মা রেণু বেগমের সম্মতি না থাকলেও স্বামীর ওপরে সে কোনো কথাও বলতে পারছে না। ঝুমুর বাবা দ্রুত রুমে ঢুকে বাচ্চাটাকে কাপড়ের পোটলায় জড়িয়ে নিয়ে বেরিয়ে এল। তারপর এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুব দ্রুত গাড়িতে গিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মেয়ে ঝুমুকে একনজর দেখে সঙ্গে ঝুমুর মা-রেণু বেগমও গেল রনজুর সঙ্গে।

তারপর গাড়ি করে কিছুদূর নির্জন একটা ফাঁকা জায়গায় গিয়ে রাস্তার পাশে বাচ্চাটাকে ফেলে তাঁরা চলে এলেন। জ্ঞান ফেরার পর বাচ্চাকে দেখতে না পেয়ে অনেক কান্নাকাটি করল ঝুমু। তার মৃত বাচ্চা হয়েছে, এটা সে মানতে নারাজ। ঝুমু কাঁদছে আর বলছে। না আমি বিশ্বাস করিনে। আমার সন্তানের কান্না আমি নিজের কানে শুনেছি। তোমরা মিথ্যা বলছো। অনেক বোঝানো হলো ঝুমুকে। এই বলে, সে ভুল শুনেছে।

এর কয়েক মাস পর ঝুমুর প্রেমিক রাতুল ফিরে এল। ঝুমুদের বাড়িতে এলে ঝুমুর মা-বাবা তাঁকে অনেক অপমান–অপদস্ত আর কটু কথার টর্চার করল। রাতুল সব বুঝিয়ে বলল, তাঁর মায়ের হঠাৎ ক্যানসার ধরা পড়ায়, সে দ্রুত পাসপোর্ট ভিসা করে তাঁর মাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর গিয়েছিল। ঝুমুর সঙ্গে দেখা করার বা যোগাযোগ করার মতো অবস্থা তখন তাঁর ছিল না। তবু মাকে বাঁচাতে পারিনি। তিন মাস পর গত পরশু সে তার মায়ের লাশ নিয়ে বাড়িতে এসেছে। গতকাল মায়ের দাফন করা হয়েছে। আর আজ এখানে এসেছে ঝুমুর সঙ্গে দেখা করতে। সে সত্যি ঝুমুকে ঠকাতে চাইনি। তার ভালোবাসা কোনো মিথ্যা না। ঝুমুকে সে রীতিমতো রেজিস্ট্রেশন করে শরিয়ত মতে বিয়ে করেছে। ঝুমু রাতুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল, সেই তো এলে। তবে আমাদের সব স্বপ্ন শেষ হওয়ার পর এলে রাতুল। ওদের বিয়ের কথা শুনে ঝুমুর মা-বাবা, রনজু আর রেণু দুজন দুজনার দিকে তাকাতাকি করতে লাগল। বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলল। তোমাদের বিয়ে হয়েছে, এ কথা আমাদের আগে জানাওনি কেন? রনজু বলল, আমাদের বিয়েটা গোপন রেখে ছিলাম। ভেবেছিলাম আমার ব্যারিস্টারি পড়া আর ঝুমুর মেডিকেল পড়া শেষ হলে দুই পরিবারের সবাইকে জানাব। ঝুমুকে আমার ঘরের বউ করে তুলে নিয়ে যাব। কিন্তু, এরই মধ্যে...
ওরা বিয়ে করেছে! তার মানে বাচ্চাটা অবৈধ নয়।
রনজু মনে মনে বিড়বিড় করে বলে উঠল এ আমি কী করেছি? আমি বাপ হয়ে আমার মেয়ের...

না, আর ভাবতে পারছে না রনজু।

‘তারা যে অপরাধ করেছে, তা-না পারছে তাদের সঙ্গে বলতে আর না পারছে সইতে। অপরাধ আর অনুশোচনায় ভুগতে লাগল ঝুমুর মা–বাবা দুজনেই। নিষ্পাপ শিশু হত্যার কারণে অপরাধবোধ যেন ঝুমুর মা-বাবাকে পিছু তাড়া করে ফিরতে লাগল।’ এর কয়েক দিন পর আবার দুই পরিবার মিলে ধুমধাম করে বিয়ে দিল ঝুমুর সঙ্গে রাতুলের। রাতুল ব্যারিস্টারি শেষ করে হাইকোর্টে প্রাকটিস করছে। আর ঝুমু এখন ঢাকা মেডিকেলের ডাক্তার।

এই ঘটনার বছর দশেক পরে...

ছোটকু নামের ১০ বছরের একটা ছেলে। ঢাকা মেডিকেলের বারান্দায় সে তার মাকে রক্তাক্ত দেহে রেখে এসে। মায়ের চিকিৎসার টাকার জন্য উদাসীনভাবে আনমনা হয়ে বাংলাদেশের রাজধানী ব্যস্ত শহর ঢাকা কাওরান বাজারের এফডিসির সম্মুখের রোড ধরে খালি পায়ে হেঁটে যাচ্ছে। তেলহীন, ধুলো–উড়া, কুঁকড়ানো, মাথাভর্তি উষ্কখুষ্ক চুল। সে চুলে কত দিন যে চিরুনির ছোঁয়া লাগেনি, তার কোনো ঠিক নেই।

পরনে ছেঁড়া ছুটো ময়লা নেভি ব্লু রঙের একটা হাফপ্যান্ট। আর গায়ে কমলা রঙের একটা ছেঁড়া গেঞ্জি। কয়েক বেলা ক্ষুদার্ত থাকার কারণে মুখটাও একেবারে শুকিয়ে গেছে।

ছোটকু হাঁটছে... আশপাশে কোনদিকে তার খেয়াল নেই। মনটা একদম ভালো নেই ছোটকুর আজ।

কী করে ভালো থাকবে?

যে পাগলি মাকে অবলম্বন করে তার এই সুন্দর পৃথিবীতে দৈনন্দিন সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা। সেই মা-যে, রোড এক্সিডেন্ট করে ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের বারান্দায় শুয়ে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। যদিও পাগলিটা তার আপন গর্ভধারিণী মা নন।

‘তবুও, সেই পাগলি মা-টাই তো, নিজে খেয়ে না খেয়ে, তার মুখের ভাত ছটকুর মুখে তুলে দেছে।  ফুটপাতে রৌদ্র, বৃষ্টি, ঝড়, তুফানে তারই মায়ার আঁচল তলে বুক দিয়ে আগলে রেখে সব ঝড়ঝঞ্ঝা থেকে ছটকুকে বাঁচিয়ে রেখেছে। এতটুকুও কষ্টের আঁচ লাগতে দেয়নি ছটকুকে।’

ছোটকুর একটু বুদ্ধি জ্ঞান হওয়ার পর সে একদিন তার পাগলি মায়ের মুখে শুনেছিল। সেদিনের কথা আজও ছটকুর স্পষ্ট মনে আছে। ছটকু জিজ্ঞাসা করেছিল? আচ্ছা মা, লোকজন বলাবলি করে তুমি নাকি আমার গর্ভধারিণী আপন মা না?

এ কথা কী সত্যি? তুমি নাকি আমাকে পথের ধারে কুড়িয়ে পেয়েছিলে?

‘ছটকুর মুখে ওই কথা শুনে পাগলি মা, মমতার চোখ দুটো জলে ছলছল করে উঠেছিল। মাতৃ স্নেহে ছুটকুকে বুকে টেনে নেয় সে।

আবারও ছটকু জিজ্ঞাসা করল বলো না মা, তুমি কি আমায় কুড়িয়ে পেয়েছিলে?

‘পাগলি কাঁদতে কাঁদতে ছটকুকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে বলে হ রে বাজান হ। মানষে তোকে ঠিকই বলে বাজান। আমি তোর গর্ভধারিণী আপন মা-না। আমি তোকে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম-রে বাজান. কুড়িয়ে পেয়েছিলাম।’

তারপর চোখের জল মুছে কল্পনা করে সেদিনের সে ঘটনা বলতে থাকে ছটকুকে....
বলে, শোন তাহলে বাজান...এক ঝড়বৃষ্টির গভীর রাতে আমি রামপুরা টেলিভিশন ভবনের সামনের পথ ধরে ভিজতে ভিজতে আসছিলাম...কিছুদূর আসার পর হঠাৎ!
পথের ধারের ময়লা আবর্জনার স্তূপের মধ্য থেকে একটা ছোট্ট শিশুর কান্নার আওয়াজ শুনে থমকে দাঁড়ায়! ভাবি, আশেপাশে তো কোথাও কোনো লোকজন নেই। তাহলে এখানে শিশুর কান্নার শব্দ কেনো? ময়লা আবর্জনা সব তন্নতন্ন করে খুঁজতে থাকি আমি। খুঁজতে খুঁজতে অবশেষে সেই ময়লা আবর্জনার স্তূপের একটা কাপড়-চোপড়ের পুটলার মধ্যে তোকে পাই। আমি যেই তোকে বুকে তুলে নিই। আর অমনি তোর কান্না থেমে যায়। কি সুন্দর মায়াবী দুটি চোখে তুই পিটির-পিটির করে তাকাচ্ছিলি আমার মুখের দিকে। মনে মনে বলতে থাকি আহারে! এমন সুন্দর নিষ্পাপ ফুটফুটে দুধের শিশুটিকে এভাবে নিষ্ঠুর পাষাণের মতো কে ফেলে রেখে গেছে? তার কি এই নিষ্পাপ অবুঝ মুখটা দেখেও একটু মায়া লাগেনি?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
কিন্তু সেদিন যে বলেছিলে...? রনজু বললো, ভুল করেছিলাম মা। ভেবেছিলাম তোদের বিয়ে হয়নি. . তাই লোক লজ্জার ভয়ে...।

‘আমি যে পাগলি মানুষ। ঘরবাড়ি বলতে আমার কোনো কিছু নেই। ফুটপথে পড়ে থাকি। ভিক্ষা করে খাই। কোথায় রাখব তোকে? কি-বা তোকে খেতে দেব? এসব নানা সাতপাঁচ ভাবতে থাকি। অবশেষে ভাবলাম এই রাতে এভাবে যদি তোকে রেখে যায়। তাহলে শিয়াল–কুকুর তোকে ছিঁড়ে  ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। তারচেয়ে আমার সঙ্গে নিয়ে যায়। যে মা-বাপ তোকে জন্ম দিল। তাদের কাছে যখন তোর ঠাঁই হলো না। আমিই তোকে ঠাঁই দেব। মায়ের আদর স্নেহ দিয়ে বড় করে তুলব। তুই এই পাগলি মায়ের ছেলের পরিচয় নিয়েই বড় হবি। তারপর আমি মানষের কাছে হাত পেতে চায়ের দোকান থেকে দুধ কিনে তোকে খাওয়াতে থাকি। তারপর তুই একটু খাওয়ার মতো হলে। কলা রুটি কিনতাম দুধের সঙ্গে ভিজিয়ে তোকে খাওয়ানোর জন্য। সব শুনে ছটকুর দুই চোখ জলে ভরে গেল। বলল, মা, লোকে তোমাকে পাগলি বললেও, তুমিই আমার মা। আমি তোমার মতো পাগলি মায়ের ছেলে পরিচয় নিয়েই এই সমাজে বড় হতে চাই মা। পাগলি ছটকুর মুখে এমন কথা শুনে ছটকুর চোখের জল মুছে সারা মুখে চুমু খেতে লাগল। আর বলতে লাগল, হরে বাজান তুই আমারই ছেলে বাজান। আর অন্য কারও নয়। শুধু, আমিই তোর মা-রে বাজান, আমিই তোর মা।

সেদিনের সেসব কথা ভাবতে ভাবতে ছটকুর দুটি চোখ ঝাপসা হয়ে এল। কি করে বাঁচাবে এখন তার সেই মাকে? ছটকুর গানের গলা বেশ ভালো। সে ভাবল ভিক্ষা চাইলে মানুষ বেশি টাকা দেবে না। তারচেয়ে সে তার পাগলি মায়ের জন্য গান গেয়ে মানুষের কাছে হাত পেতে সাহায্য চাইবে। তাহলে নিশ্চয়ই মানুষের দয়া হবে।

সে কচি মায়াবি গলায় মধুর কণ্ঠে গান গাইতে লাগল। আর দোকান্দার থেকে শুরু করে পথের সব মানুষজনদের কছে দুই হাত পেতে সাহায্য চাইতে লাগল। ছটকু যখন গান গাওয়া শুরু করল। ওই পথ দিয়ে দামি প্রাইভেটে যাচ্ছে ঝুমুর মা-বাবা, রনজু আর রেণু বেগম। ছটকুর গান শুনে আর তাদের মেয়ে ঝুমুর চেহারার সঙ্গে ওর হুবহু মিল দেখে মনে খটকা লাগল। গাড়ি রাস্তার একপাশে রেখে ওরা ছটকুর পিছু পিছু যেতে লাগল।
সে গানটা হলো...

তোমাদের মধ্যে কেউ কি এমন
নেই, কোনো দয়াবান?
যে একটু, করবে মেহেরবান...
মৃত্যু এক, পথযাত্রী মায়ের জন্য
করবে, কয়টা টাকা দান?
তবে যে টাকা পেলে বাঁচবে আমার
পাগলি মায়ের প্রাণ।।
একদিন, যে মা, আমার কান্না দেখে
রাস্তার, আবর্জনার মধ্য থেকে...
তুলে, বুকে দিল ঠাঁই,
আমার, সেই মায়ের বাঁচাতে জীবন
আজ, তোমাদেরই কাছে আমি
দুটি, সাহায্যেরও হাতটি বাড়ায়
চাই, একটু অনুদান।।
একদিন, যে-মা আমার কুড়িয়ে পেয়ে
নিজের, বুকে তুলে নিলো...
যে-মা, নিজে খাবার না খেয়ে সে
আমার, মুখে তুলে দিল।।
আজ আমার, সেই মা মৃত্যু যন্ত্রণাতে
কাতরায়, হাসপাতালের বারান্দায়....
আমার, সেই মাকে বাঁচাতে যে
গাই আমি এ গান।।

ছটকুর কান্না জড়িত করুণ কণ্ঠে অমন মায়া জড়ানো গান শুনে যে যার সাধ্যমতো টাকা দিতে লাগল। গান শেষে ছটকু কাঁদতে কাঁদতে সবার দেওয়া টাকাগুলো কুড়িয়ে একজায়গায় করতে লাগল। ছটকুর কাছে ছুটে গেল রনজু রেণু। বলল, তোমার নাম কী? ছটকু চোখের জল মুছে বলল ছটকু। রনজু বলল, তুমি যে গান গাচ্ছিলে তোমায় কুড়িয়ে পেয়েছে। কোথায়, কে কুড়িয়ে পেয়েছিল তোমাকে? আমাদের জানা দরকার সবকিছু আমাদের বলো? ছটকু বলল, আমি এরচেয়ে বেশি জানিনে।

আমার পাগলি মা জানে। আপনারা কে? রেণু বলল, আমরা কে ভাই সবি জানবে। ছটকু বলল সরুন আমাকে এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে। আমার মায়ের অবস্থা খুব খারাপ। মায়ের জন্য ওষুধ কিনতে হবে। রনজু বলল, কোন হাসপাতালে ভাই ছটকু? ছটকু বলল ঢাকা মেডিকেলে। রনজু বলল, চলো আমরাও তোমার সঙ্গে যাব। তুমি গাড়িতে ওঠো। ছটকু গাড়িতে উঠতেই রনজু গাড়ি চালিয়ে সোজা ঢাকা মেডিকেলে গেল। ছটকুর পাগলি মা, মমতার অবস্থা খুবই সংকটপূর্ণ। ঝুমুই চিকিৎসা দিচ্ছে। পাগলি মমতা ক্ষতদেহে মৃত্যুর যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আর এদিক–ওদিক তাকিয়ে চারদিকে শুধু ছটুকুকে খুঁজছে। বারবার বলছে ছটকু...আমার ছেলে ছটকু কই? ছটকু গাড়ি থেকে নেমে দৌড়ে হাসপাতালের ভেতর তার পাগলি মায়ের কাছে গেল। গিয়ে মমতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, এই তো আমি মা। তোমার কিচ্ছু হবে না। এই দ্যাখো তোমার চিকিৎসা আর ওষুধ কেনার জন্য আমি অনেক টাকা এনেছি। তুমি ভালো হয়ে যাবে মা, তুমি ভালো হয়ে যাবে।

পাগলি মমতা বলল, আমি আর বাঁচুম নারে বাবা ছটকু। রাতুল কিছুক্ষণ আগে ঝুমুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সেও হাসপাতালে আছে। ছটকুর পেছনে ঝুমু ওর মা-বাবাকে দেখে বলল, কী ব্যাপার আম্মু, আব্বু তোমরা এখানে? ঝুমুর বাবা রনজু বলল সব পরে বলছি মা। মমতাকে দেখিয়ে বলল আগে উনাকে ভালো চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ কর মা ঝুমু। পাগলি মমতা খুব কষ্টে ছটকুকে বলল উ...না...রা...কে-রে বাবা ছটকু? ছটকু বলল, উনারা তোমার কাছে কি যেন জানতে চায় মা। মমতা নিশ্বাস নিতে পারছে না।

রনজু পাগলি মমতাকে উদ্দেশ্য করে বলল, হ্যাঁ, বলুন, ১০ বছর আগে এক ঝড়বৃষ্টির রাতে ছটকুকে আপনি কোথায় পেয়েছিলেন? মমতার মৃত্যুশ্বাস উঠে গেছে। খুব কষ্টে কল্পনায় সব বলল। সেদিন শুক্রবারের রাত ছিল। একটা কালো চকরাফকরা রঙের কাপড়ে জড়ানো ছিল ছটকুকে।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

অনেক কষ্টে পাগলি মমতা তার টোপলা থেকে সে কাপড়টা বের করে বলল এই কাপড়টিতে। রনজু ছোঁ মেরে সে কাপড়টা নিল। চিনতে কষ্ট হলো না। সে এই কাপড়ে জড়িয়েই সে রাতে ঝুমুর শিশুপুত্রটিকে ফেলে রেখে এসেছিল। রেণু, রনজু, একইসঙ্গে বলে উঠল হ্যাঁ, এই তো সেই কাপড়। তার মানে এই ছটকুই আমাদের নাতি, ঝুমুর ছেলে। রাতুল ঝুমু বলল, ছটকু...ছটকু আমাদের ছেলে?

কিন্তু সেদিন যে বলেছিলে...? রনজু বললো, ভুল করেছিলাম মা। ভেবেছিলাম তোদের বিয়ে হয়নি. . তাই লোক লজ্জার ভয়ে...।

আমাদের তুই ক্ষমা করে দে, মা। রাতুল তুমিও আমাদের ক্ষমা করো বাবা। ঝুমু, কাঁদতে কাঁদতে ছটকুকে বুকে টেনে গায় মাথায় হাত বুলিয়ে সারা মুখে চুমু খেতে খেতে বলতে লাগল ছটকু... তুই আমার ছেলে বাবা। এত দিন তুই কোথায় ছিলি সোনা। আমার বুকের ধন দুই নয়নের মণি। রাতুলও উবু হয়ে ছটকুকে বুকে টেনে চুমু দিতে লাগল। ছটকু পাগলি মমতাকে ধরে বলল না, আমি শুধু আমার পাগলি মায়ের ছেলে। পাগলি মমতা কথা বলতে পারছে না। খুব কষ্টে বলল, আমার আর সময় নেইরে বাবা। তুই আমার ছেলে, এটা ঠিক। কিন্তু ওরাই যে তোর সত্যিকারের জন্মদাতা আর গর্ভধারিণী মা-বাবা। তারপর ছটকুর কপালে একটা চুমু দিতেই মমতা চিরতরে নিস্তেজ হয়ে গেল। হাত দুটি ছটকুর মাথা থেকে নিচে পড়ে গেল। ঝুমু তাঁর হাত দিয়ে মমতার চোখ দুটো বন্ধ করে দিয়ে বলল, উনি মারা গেছেন বাবা ছটকু। ওই কথা শুনে ছটকু চিৎকার করে কেঁদে ওঠে তার পাগলি মা মমতাকে ধরে বলতে লাগল।

না...আমার মা আমাকে ছেড়ে মরতে পারে না। ও মা.... মা...কথা বলো মা...তুমি কথা বলো। এভাবে তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারো না মা, কথা বলো মা...কথা বলো। শুধু একবার তুমি আমাকে ছটকু বলে ডাকো মা... শুধু একবার...। তারপর বলল, এখন আমি কার কাছে থাকব মা, কার কাছে...। ঝুমু আর রাতুল দুজন ছটকুকে বুকে টেনে বলল, তুই আমাদের কাছে থাকবি বাবা। তুই যে আমাদের ছেলে। তবু ছটকু তার পালিত পাগলি মা মমতার দিকে তাকিয়ে মা...

আমার মা... বলে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগল...।

*লেখক: ফারুক আহম্মেদ জীবন, নারাংগালী, ঝিকরগাছা, যশোর

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]