কলাবিজ্ঞানী
চুলে চিরুনি করতে করতে দেয়ালঘড়ির দিকে তাকালাম। সকাল ৭টা বেজে ৪৩ মিনিট। ৮টায় পরীক্ষার হলে থাকার কথা। হাতে একদমই সময় নেই। চেয়ারে না বসে বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নজর বোলাচ্ছি। বইয়ের ভেতর মুখ রেখে আম্মাকে চিৎকার করে বললাম, ‘মা, ডিম সেদ্ধ হয়েছে? দ্রুত নিয়ে এসো। হাতে একদমই সময় নেই।’
মা রান্নাঘর থেকে বলল, ‘আসতেছি বাপ। একটু সবুর কর।’
পাশের ঘর থেকে দাদি চেঁচিয়ে বলল, ‘সাতসকালে ঘুম থেকে উঠে গাধার মতো চিৎকার করতেছিস ক্যান?’
আমি বললাম, ‘ডিম খাওয়ার জন্য।’
‘আইতেছি দাঁড়া, তোরে ডিম খাওয়াইতাছি। জানস না পরীক্ষার হলে যাওয়ার সময় ডিম খাইয়ে গেলে পরীক্ষার খাতায় মস্ত বড় আন্ডা পাওয়া যায়?’
আম্মা ডিম আর এক গ্লাস জল টেবিলে রাখতে রাখতে বলল, ‘আম্মাজান, এসব কুসংস্কার কথাবার্তা বইলেন না তো। সারা রাত পোলাটা কিচ্ছু খায় নাই। ডিমটা একটু খেতে দেন। আর এসব কুসংস্কার মার্কা কথাবার্তা বাদ দেন।’
দাদি কপাল ভাঁজ করে বলল, ‘কী, আমি মুখ খুললেই কুসংস্কার মার্কা কথাবার্তা? আর তোমরা খুললেই সুসংস্কার, না? আমারে সংস্কার শিখাইতে আইছ? দুনিয়াতে আমি আগে আইছি না তুমি আগে আইছ হে? কত্ত বড় সাহস তোমার! তোমার সাহস দেখে তো আমি বাঁচি না।’
‘আম্মাজান, আমার ভুল হয়ে গেছে। মাফ করে দেন। আর আপনাকে কিছু বলব না।’
‘দ্যাখ, তোর মায়ের কত বড় সাহস। মুখের ওপর কথা বলে।’
‘দাদি থামো তো। অসহ্য লাগছে তোমাদের কথাবার্তা শুনে।’
‘আমার কথা তোর কাছে অসহ্য লাগে? আমি এই জীবনই আর রাখমু না। আজই আমার মেয়ের বাড়ি চলে যামু৷ এই বাসা থেকে চলে যাইতেছি। আমারে কেউ দেখতে পারে না। আমার পোলাটাও না। মিলি, এই মিলি? আমার ব্যাগটা গুছিয়ে দে তো। আমি আজই চলে যামু এহান থেইক্যা।’
‘দাদি, আমি গুছিয়ে দিই?’
‘না, তোর সঙ্গে আমার কোনো কথা নাই।’
আমি হাসি-হাসি মুখ করে বললাম, ‘যার কথা নাই, তার মাথাও নাই।’
আজ পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করছে না। পরীক্ষা দিতে বোরিং লাগে। তিন ঘণ্টা এক জায়গায় চুপচাপ বসে থাকা কষ্টকর। সময় নষ্ট, খাতা নষ্ট, কলমের কালিও নষ্ট। দুনিয়ায় পরীক্ষাটা কে যে আবিষ্কার করল? তাকে পেলে আচ্ছামতো..!
আমি নাশতার টেবিল থেকে কলা নিয়ে দাদির ঘরে এলাম। বললাম, ‘আচ্ছা দাদি, কলা আর ডিম খাচ্ছি। শুধু ডিম খাইলে পরীক্ষার খাতায় আন্ডা পাওয়া যায়, তাই না? তাই কলা দিয়ে ডিম খাচ্ছি। কলার মান এক আর একটা ডিমের মান হচ্ছে দুইটা আন্ডার সমান। তাহলে কী বোঝা গেল, একটি কলা ও একটি ডিম সমান সমান ১০০ নম্বর। দ্যাখো তো, হিসাব ঠিকাছে না?’
‘তোগোর লগে আমার কোনো কথা নাই। কথাই কথাই খালি যুক্তি দেস। যুক্তি দেওয়া শয়তানের কাজ।’
‘যুক্তি দেওয়া যে শয়তানের কাজ, এটা তোমাকে কে বলল? খামাখা শয়তানের নামে মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ কেন? শয়তান শুনলে মন খারাপ করবে না?’
‘তুই আমার সামনে থেকে যাবি না মাইর খাবি?’
‘মিলি, এই মিলি, কই গেলি? আমার ব্যাগটা গুছিয়ে দে না।’
‘দাদি, সত্যি সত্যি যাবা?’
‘হ, এইবার সত্যি সত্যি যামু।’
‘তোমার কথা আমার বিশ্বাস হয় না। এর আগেও তুমি কয়েকবার বলেছ। কিন্তু কথা দিয়ে কথা রাখোনি।’
‘তুই আমারে সত্যি সত্যি যাইতে কস?’
‘না, সত্যি সত্যি না। কিন্তু তুমি গেলে তোমার সঙ্গে আমিও যেতাম।’
‘তুই আমার সঙ্গে মজা করবি না কইলাম। আমি তোর বউ না!’
নাশতা খাওয়ার জন্য টেবিলে বসলাম। কলার দিকে তাকিয়ে আছি। আম্মা বলল, ‘ওভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি খা। খেয়ে আমাকে মুক্তি দে।’
‘আচ্ছা আম্মা, কলার মান কত হতে পারে কও তো?’
আম্মা যে গতিতে আমার কাছে এসেছিল সেই গতিতেই রান্নাঘরে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘আমার রুটি পুইড়ে ছাই হয়ে যাইতেছে এর কোনো খবর নাই। আর তুই পড়ে আছোস কলা নিয়ে। হায় রে আমার কলাবিজ্ঞানী!’
দরজায় দাঁড়িয়ে বললাম, ‘দাদি, ও দাদি। কাঁদছ কেন? দরজা খোলো।’
‘তুই সামনে থেকে যা। তোর লগে কথা নাই।’
‘তোমার কথা না থাকতে পারে, আমার তো কথা আছে। কলার মান কত, তুমি জানো?’
‘তুই সামনে থেকে যাবি নাকি বউমার কাছে বিচার দিমু।’
ধুর বুড়ি। সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠছি। মরিয়মের মার সঙ্গে দেখা। বললাম, ‘ও মরিয়মের মা, বলো তো, একটা কলার মান কত?’
মরিয়মের মা মুখে আঁচল চেপে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘এই তো আপনি খালি মরিয়মের বাপের কথা মনে করিয়ে দেন।’
বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘আহা, কলার মানের লগে মরিয়মের বাপের কী সম্পর্ক?’
‘ওনার মাথায় বেজায় বুদ্ধি ছিল। সব জিনিসের মানমর্যাদা বুঝত। কলার মান কত, এটা বের করতে ওনার ওয়ান-টুর ব্যাপার। আজ যদি মরিয়মের বাপ বাঁইচে থাকত।’
‘আরে রাখো তোমার মরিয়মের বাপ!’
দাদি মিলি আপাকে চিৎকার করে বলল, ‘মিলি, ব্যাগ গুছানো বাদ দে। আমার শইলডে ভালা লাগতাছে না। আইজকে আর যামু না।’
মিলি আপু, কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘তাহলে আমি এত কষ্ট করে ব্যাগ গুছাইলাম কেন? আ আ আ...’