শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা, মেধাবীরা এ পেশায় যোগদানে কেন আগ্রহ হারাচ্ছে

শিক্ষকতাপ্রতীকী ছবি

‘The First Teacher’ (প্রথম শিক্ষক) চিঙ্গিজ আইত্মাতভ রচিত একটি মাস্টারপিস, যা কিরগিজ অঞ্চলের একটি ছোট গ্রামকে কেন্দ্র করে রচিত। উপন্যাসটির মূল উপজীব্য হলো শিক্ষার প্রভাব এবং একজন আদর্শ শিক্ষকের একজন শিক্ষার্থীর জীবনে আনা পরিবর্তন। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রে একজন তরুণ শিক্ষক, যিনি রাশিয়ান বিপ্লবের পরে কিরগিজস্তানের একটি দূরের গ্রামে কাজ করেন। তিনি গ্রামের শিশুদের শিক্ষিত করার জন্য সংগ্রাম করেন, বিশেষত একটি কিশোরী মেয়ে আলতিনাই-এর জীবন পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। আলতিনাই ধীরে ধীরে শিক্ষার মাধ্যমে তার জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে এবং একটি সফল ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যায়।

উপন্যাসটি মূলত একজন শিক্ষকের আত্মত্যাগ, শিক্ষার পরিবর্তনশীল শক্তি এবং সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিবন্ধকতাগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করার গল্প তুলে ধরে। গত শতাব্দীর গোড়া থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দুইশেনদের (শিক্ষকদের) প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাতে ‘শিক্ষক দিবস’ পালনের উদ্যোগ নেওয়া হতে থাকে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষক দিবস বিভিন্ন তারিখে পালিত হয় এবং প্রতিটি দেশের ঐতিহ্য ও ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে বিশেষ একটি দিন বেছে নেওয়া হয়। দিনটি কেন বেছে নেওয়া হয়, তার পেছনে রয়েছে দেশীয় প্রেক্ষাপট, মহান ব্যক্তিত্বের জন্মবার্ষিকী অথবা শিক্ষার ইতিহাসের বিশেষ দিন। যেমন প্রতিবেশী দেশ ভারত প্রথাগতভাবে হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে আষাঢ় (জুন–জুলাই) মাসের পূর্ণিমায় গুরুপূর্ণিমা (আধ্যাত্মিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকদের মঙ্গল কামনায় নিবেদিত) পালন করে, তবে দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি এবং একজন বিশিষ্ট দার্শনিক সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণাণের জন্মদিন (৫ সেপ্টেম্বর) উপলক্ষে ১৯৬২ সাল থেকে ৫ সেপ্টেম্বরে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়। রাধাকৃষ্ণাণ নিজেও শিক্ষক ছিলেন এবং তাঁর শিক্ষাদান পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

প্রতিবছরের ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হলেও শিক্ষকদের বেতন (গ্রেড), পদোন্নতি, বদলি, অর্জিত ছুটি, পেনশন, যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন কিংবা যৌক্তিক সংস্কার না হওয়া এবং সামাজিকভাবে মূল্যায়ন কমে যাওয়ায় মেধাবীরা এ পেশায় যোগদানে আগ্রহ হারাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৫৩ সালে প্রথমবারের মতো ‘শিক্ষক প্রশংসা দিবস’ (Teacher Appreciation Day) পালিত হয়। তবে ১৯৮৫ সালে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা সমিতি (NEA) মে মাসের প্রথম সপ্তাহকে শিক্ষক প্রশংসা সপ্তাহ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৮৫ সালে চীন শিক্ষকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্য ১০ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিনটি শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি এবং শিক্ষকদের মূল্যায়নের জন্য বেছে নেওয়া হয়। মালয়েশিয়ায় ১৯৫৬ সালের ১৬ মে মালয়েশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে ‘রাজা রিপোর্ট’ প্রকাশিত হয়, যা দেশটির শিক্ষাব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। সেই দিনটির স্মরণে ১৯৭২ সাল থেকে ১৬ মে শিক্ষক দিবস হিসেবে পালন করা হয়।

রাশিয়ায় ১৯৯৪ সালে ইউনেসকোর সঙ্গে সংগতি রেখে ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হতে শুরু করে। এর আগে সোভিয়েত ইউনিয়নে ১৯৬৫ সাল থেকে অক্টোবরের প্রথম রোববারে শিক্ষক দিবস পালিত হতো। দক্ষিণ কোরিয়ায় ১৫ মে পালিত হয় কোরিয়ার প্রখ্যাত রাজা সেজংয়ের জন্মদিন, যিনি কোরিয়ান বর্ণমালা হাংগুল প্রবর্তন করেছিলেন। তাঁর সম্মানে এবং শিক্ষার প্রতি তাঁর অবদানের জন্য দিনটি শিক্ষক দিবস হিসেবে পালিত হয়।

থাইল্যান্ডে ১৯৫৭ সালের ১৬ জানুয়ারি দিনটি শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়, কারণ এই দিনটি থাই শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো এবং তাদের কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য উপযুক্ত বলে মনে করা হয়েছিল।

১৯১৭ সালে মেক্সিকান সরকার ১৫ মে তারিখটি শিক্ষক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে। দিনটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বেছে নেওয়া হয়।

১১ সেপ্টেম্বর ডোমিনো ফসটিনো সার্মেন্তোর মৃত্যু দিবসে আর্জেন্টিনা শিক্ষক দিবস পালন করে।

জাপানে নির্দিষ্টভাবে কোনো শিক্ষক দিবস পালিত হয় না, তবে বিভিন্ন উৎসবের সময় শিক্ষকদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করা হয়।শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের কৃতিত্ব এবং অবদানকে স্বীকৃতি দিতে বিশেষ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিক্ষক দিবস পালনের তারিখ এবং পদ্ধতি ভিন্ন হলেও সব দেশেই শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা প্রদর্শনই মূল লক্ষ্য। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এসব দিন বেছে নেওয়া হয়েছে, যা শিক্ষকদের অমূল্য অবদানের প্রতি সম্মান জানায়। অন্য আন্তর্জাতিক দিবসগুলোর মতো একই সঙ্গে সারা বিশ্বে পালিত না হয়ে বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে শিক্ষক দিবস পালিত হওয়ার এটি একটি মুখ্য কারণ।

শিক্ষকতা

বিশ্ব শিক্ষক দিবস (World Teachers' Day) ১৯৯৫ সালের ৫ অক্টোবর থেকে পালিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ( The United Nations Educational, Scientific and Cultural Organization) বা ইউনেসকো (UNESCO) জাতিসংঘের একটি বিশেষ সংস্থা। এই ইউনেসকো প্রথম আবেদন করে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপন করার জন্য। তবে ইউনেসকোর সঙ্গে এই প্রস্তাবে অংশগ্রহণ করেছিল আন্তর্জাতিক শ্রম সংগঠন (International Labour Organization)। ইউনেসকো ও আইএলও যৌথভাবে এই বিশেষ দিন উদ্‌যাপন করার প্রস্তাব রেখেছিল জাতিসংঘে।

আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপন করার প্রস্তাবের পেছনে একটি বড় কারণ হলো, শিক্ষকদের শ্রমকে স্বীকৃতি দেওয়া। শিক্ষক একটি সুশিক্ষিত সমাজ গঠনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তাই মানুষ গড়ার এই কারিগরদের শ্রমের মর্যাদা দেওয়ার জন্যই আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস পালন করার আবেদন করা হয়েছিল। রাষ্ট্রসংঘে ১৯৯৪ সালে শিক্ষক দিবস পালন করার আবেদন গৃহীত হয়। এর পর থেকেই প্রতিবছর পালন করা হচ্ছে আন্তর্জাতিক শিক্ষক দিবস। ১৯৬৬ সালের একটি প্রস্তাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিক্ষকদের কাজের পরিবেশ, অধিকার এবং সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে দিনটি পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর প্যারিসে শিক্ষকদের কর্মপরিসর ও অধিকার–সংক্রান্ত একটি সুপারিশ পাস হয়েছিল। এরই স্মরণে বিশ্ব শিক্ষক দিবসকে আন্তর্জাতিকভাবে ৫ অক্টোবর পালনের দিন হিসেবে বেছে নেওয়া হয়। বিশ্বব্যাপী শিক্ষক দিবস বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে উদ্‌যাপন করা হয়; তন্মধ্যে প্রধান কর্মকাণ্ডগুলো হলো—শিক্ষকদের সম্মান জানিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থা পুরস্কার প্রদান করে। শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষকদের অবদান এবং ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিশেষ সেমিনার ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। শিক্ষার্থীরা শিক্ষক দিবসে বিশেষ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নাটক, গান বা কবিতা পাঠের মাধ্যমে শিক্ষকদের সম্মান জানায়; শুধু তা–ই নয়, সামাজিক মিডিয়ায় শিক্ষকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে পোস্ট করা হয়। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষকদের গুরুত্ব তুলে ধরে প্রচারণা চালায়, শিক্ষার্থীরা তাদের প্রিয় শিক্ষকদের চিঠি, কার্ড বা উপহার দিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে; আবার কিছু দেশে শিক্ষক দিবসে শিক্ষা–সম্পর্কিত নতুন নীতি বা প্রকল্পের ঘোষণা করা হয়। এ ছাড়া ইউনেসকোর উদ্যোগে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপিত হয়, যেখানে শিক্ষকদের বৈশ্বিক অবদান এবং শিক্ষার উন্নয়নে তাঁদের ভূমিকা গুরুত্বসহকারে আলোচনা করা হয়।

বাংলাদেশেও শিক্ষকসমাজকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার অঙ্গীকার নিয়ে ২০০৩ সালে তৎকালীন সরকার ১৯ জানুয়ারি ‘জাতীয় শিক্ষক দিবস’ চালু করে। বর্তমানে জাতীয় শিক্ষক দিবসের পরিবর্তে প্রতিবছরের ৫ অক্টোবর ‘বিশ্ব শিক্ষক দিবস’ পালিত হলেও শিক্ষকদের বেতন (গ্রেড), পদোন্নতি, বদলি, অর্জিত ছুটি, পেনশন, যাতায়াতব্যবস্থার উন্নয়ন কিংবা যৌক্তিক সংস্কার না হওয়া এবং সামাজিকভাবে মূল্যায়ন কমে যাওয়ায় মেধাবীরা এ পেশায় যোগদানে আগ্রহ হারাচ্ছে। আধুনিক রাষ্ট্র বিনির্মাণে শিক্ষকতাকে আকর্ষণীয় পেশায় রূপান্তরের আশু পদক্ষেপের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন বাংলার শিক্ষক সমাজ।

জ্ঞান আর আদর্শের প্রদীপ হাতে নিয়ে, অন্ধকার জীবনে যেসব জীবিত ও লোকান্তরিত শিক্ষক দিয়েছেন আলোর দিশা, আজকের এই লেখাটি তাঁদের উৎসর্গ করে গীতিকার জুলফিকার রাসেলের মতো বলতে চাই—
‘সহস্রবার সালাম জানাই আমার যারা গুরু,  
যাদের সাহচর্যে শিক্ষাজীবন হয়েছিল শুরু।

*লেখক: প্রভাষক, রসায়ন

নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]