মনের অনুভূতি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জীবন যেন একটা বহতা নদীর মতো। এখানে কেউ সাঁতার জেনেও ডুবে যায়। আবার কেউ আছে সাঁতার না জেনেও বেঁচে যায়। দেহ ও মন নিয়ে আমাদের এ মানবসত্তা। একটি অপরটির পরিপূরক। এ যেন মুদ্রার এপিঠ–ওপিঠ। শরীর খারাপ তো মনও খারাপ। আবার মন খারাপ তো শরীরও খারাপ। এ যেন মেঘ-বৃষ্টি-আলোর এক লুকোচুরি খেলা। মন যেন এক অদৃশ্য বস্তু। এর সঠিক অবস্থান আসলে কোথায়, তা বলা খানিকটা জটিলও বটে। তবে প্রতিটি মুহূর্তেই এর অস্তিত্ব, অনুভূতি টের পাই বা বুঝতে পারি। এ যেন আমাদের নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে মিশে আছে। যেন আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে আছে। আমাদের হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, আবেগ, অনুভূতি, আশা-ভরসা, প্রত্যাশা, প্রাপ্তি—সবই যেন মনের সঙ্গে বিরাজমান। মন কখনো অল্পেও তুষ্ট থাকে, আবার কখনো বেশি পেয়েও অসন্তুষ্ট থাকে। মন বোঝা বড় কঠিন। এ মন কখন যে কোন আকাশে কার হাতে রঙিন ঘুড়ি হয়ে উড়তে চায়, কার হাতের নাটাই–বা হয়ে থাকতে চায়, বোঝা বড় মুশকিল। বিচিত্র মানুষ, বিচিত্র ভাবনা। তার চেয়েও বড় বিচিত্র মানুষের মন। এর যেন কোনো কূলকিনারা নেই। উথালপাতাল অস্ফুট স্বরে চলা এ অস্থির মন যেন উড়ে উড়ে, ঘুরে ঘুরে কোনো স্বপ্নলোকে, অচিনপুরে হারিয়ে যায়। আবার মুহূর্তের মধ্যেই যেন ফিরে এসে স্থির হয়ে কোনো মগডালে বসে শিস বাজায়। এ যেন এক চিরন্তন প্রাকৃতিক নিয়মে শুধু ভাঙা-গড়ার খেলা। কতশত স্বপ্ন, আশা-ভরসার মিলনস্থলই যেন মন। মন যেন এক রঙিন প্রজাপতি। যেন কতশত কথা বলার, ভাবনার এক অদৃশ্য মালা। এ মালা যেন কত যত্নে গড়া। কত নিখুঁত কারুকার্যে ভরপুর। যে কারুকার্য ঘিরে আছে কষ্ট-ব্যথা ও সুখানুভূতি। ছোট এ মন চায় সাধের ঘোড়া দৌড়াইতে। চাইলেই কি তা করা যায়? মন যেন প্রশ্নবাণে বারবার জর্জরিত হয়। কেন মনকে ধমক দিয়ে বলা যায় না, মন তুই শান্ত হয়ে ঘরের এক কোণে বসে থাক। তোর এত চিন্তাভাবনা করার কোনো প্রয়োজন নেই, অস্থির হওয়ারও কোনো দরকার নেই। তুই নিশ্চিন্তে এক চমৎকার ঘুম দে। মন যেন কেঁদে ওঠে, গুমরে মরে। কেন যে মন কষ্ট পায়, হাজার ভাবনা ভাবে, কে দেবে এর উত্তর? সবাই তো বলে মনের সব দরজা-জানালা খুলে দাও, আলো-বাতাস ঢুকতে দাও। এ কথা শুনে তখন মনই মনকে প্রশ্ন করে—মনের দরজা-জানালা আছে নাকি? থাকলে কোথায়? দেখতে পাচ্ছি না তো? আর খুলে দিলে কী হবে?

পারবে কি নিঃশব্দে প্রাণভরে শান্তির নিশ্বাস নিতে? এ অক্সিজেন যে মহামূল্যবান। যেন উভয়সংকটে পড়ে গেল এ মন। মন যেন এক রঙিন ঘুড়ি। শৈশবে থাকে একরকম, কৈশোরে আরেক রকম। যৌবন ও বার্ধক্যে হয়ে যায় অন্য আরেক রকম। এ যেন নিত্য পরিবর্তনের খেলা ও মেলা। এ খেলা যেন সৃষ্টির শুরু থেকে শেষ অবধি বয়েই চলেছে। এ বয়ে চলার পথে কতশত জানা-অজানা নদী, মাঠ, খাল-বিল, ডোবা-নালা তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে, তা কে জানে? কেউ কি কখনো তার কোনো হিসাব লিখে রেখেছে? সে প্রশ্নের উত্তরেও সবাই বলবে—মনে রাখতে পারো না? আহা! মনের হয়েছে যত জ্বালা। এ মন বড় অভিমানী, বড় লাজুক, বড়ই স্পর্শকাতর। ক্ষণে ক্ষণে ভেঙে যায়। আবার নিজের মনই নিজেকে কখনো কখনো শান্ত হতে বলে। এ যেন একই অঙ্গে বহু কলা। কী বিচিত্র এ ভাবনা, কী বিচিত্র এ মন। মন যেন এক রঙিলা মাঝি। করুণ কণ্ঠে বাজে আবার সুরেলা ছন্দেও বাজে। আহা! মনে পড়ে যায় শৈশবের কত কথা।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফিরিয়ে দাও,

ফিরিয়ে দাও আমার শৈশব

অলস মধ্যাহ্ন, দুরন্তপনা যৌবন—

ফিরিয়ে দাও আমার স্কুলব্যাগ, টিফিন বক্স,

স্কুল মাঠ আর বাড়ির প্রশস্ত আঙিনা।

আমার আমিকে ফিরিয়ে দাও

ফিরিয়ে দাও—

আলপথ, নদী-মাঠ-ঘাটে

ফেলে আসা প্রিয় দিনগুলো।

উল্কার মতো—

অক্লান্ত আমিকে আবার ছুটতে দাও

আমাকে আমার দিনগুলো ফিরিয়ে দাও—

ঝড়ের রাত, আম কুড়ানো ভোর

শিউলিতলা, বকুলের মালা

শিশির ভেজা দূর্বাঘাস, বৃষ্টিস্নাত পথ

কোথায় গেল? আহা!

অলস দুপুরে কোকিলের সুরে সুরে

আবার পিছু পিছু ছুটতে চাই—

প্রজাপতি ডানায় চড়ে।

ফিরিয়ে দাও আমার পুতুল সংসার

সাঁঝের ঘরে ফেরা পাখির জীবন,

মায়ের কোলে ফিরতে চাই

খেতে চাই লুকিয়ে কুল-তেঁতুল

শুনতে চাই মায়ের বকুনি।

প্রদীপ জ্বালিয়ে পড়তে চাই

না বুঝে পড়া শব্দগুলো।

দিদিমার সাথে রাতের খুনসুটি করে

রাজা-রানি, ইউসুফ-জুলেখার কাহিনি

বিষাদ–সিন্ধুর মর্মকথা বুঝতে চাই।

দিদিমা

আর সেই ফেলে আসা দিনগুলো

কোথায় খুঁজি তারে—

কেউ কি তা বলতে পারে?

রাতের অন্ধকারে মন কেঁদে ওঠে। দুই চোখ গড়িয়ে অশ্রু নামে। বিছানার চাদর-বালিশ যায় ভিজে। একাকিত্বের বিরহে চোখের দুই পাতা আর এক হয় না। কী ভীষণ দুর্বিষহ সেই রাত। এপাশ–ওপাশ করে কিছুতেই যেন ঘুম আসে না। মন যেন অস্থির থেকে অস্থির হয়ে ওঠে, কী যেন এক অজানা ব্যথায় মনটা গুমরে মরে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে কতশত মধুর স্মৃতি, বিরহ-মিলন কথা। আহা! কোথায় গেল আমার সেই সোনালি দিনগুলো, বিকেলগুলো। স্মৃতিগুলো আয়নার মতো চোখে ভাসে আর মন যেন অঝোরে কাঁদে। কাঁদতে চায় না মন, তবু কেন কাঁদে?

আজ মানুষের বিবেক, মনুষ্যত্ব কোন সীমানায় পৌঁছেছে, ভাবতে সত্যিই অবাক লাগে। ঘরে-বাইরে সর্বত্র যেন আজ প্রতারণার প্রথা চলছে। আমরা যারা সহজ-সরল, নিরীহ ও ভালো-সুন্দর মনের মানুষ, তারা যেন এই ধারার সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারছি না। আবার বিদ্রোহও করতে পারছি না। এ যেন কুল রাখি না শ্যাম রাখির মতো হয়ে গেল। বড় নিষ্ঠুর এই পৃথিবী, নিষ্ঠুর তার আচরণ।

মন তুমি কোথায়? কেন এত দুঃখ পাও? আমার মনের কোণে আজ যেন কালবৈশাখী জমেছে। মনের দরজা-জানালায় যেন ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায়? যেন ক্রমেই অন্ধকারে নিমজ্জিত হচ্ছে এ মন। মনে হচ্ছে এখনই সবকিছু ভেঙে তছনছ হয়ে যাবে। যেন ক্রমেই অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছে সব আশা-ভরসা। স্বপ্নগুলো যেন প্রতিনিয়ত দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত হচ্ছে। তাই বলে কি বিবেকের দায় এড়ানো যায়?

মাথার ওপরে আকাশটাও যেন ক্রমেই খুব কাছে চলে আসছে। মনে হচ্ছে, এই বুঝি মাথায় ভেঙে পড়বে।

আশা-হতাশার দোলায় দুলে আবার যেন স্বপ্ন দেখে এই মন। ঘুমপাড়ানি গান গুনগুনিয়ে গেয়ে এ যেন স্বপ্নের জাল বুনে। শত দুঃখ-কষ্ট ভুলে সামনে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্নে মশগুল হয়ে ওঠে। এ যেন কালবৈশাখীর দমকা হাওয়ায় লন্ডভন্ড হয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো।

*লেখক: শিক্ষিকা, জলসিঁড়ি ক্যান্টনমেন্ট স্কুল ও কলেজ, ঢাকা।

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: ns@prothomalo. com