মেসের জীবনে প্রতি পদে পদে সংগ্রাম, ত্যাগ ও স্বপ্ন জড়িয়ে আছে

মেসজীবন মানেই যেন কিছু বাস্তবতাকে সামনে থেকে দেখে জীবনের লক্ষ্যে ছুটে চলা। মেসজীবনটা অনেকটা পাহাড়চূড়ায় ওঠার মতো যদি আপনার মানসিকতা দৃঢ় থাকে, তবে উঠতে পারবেন, না হলে পারবেন না। যখন কেউ নিজের প্রিয় শহর প্রিয় মানুষগুলো ছেড়ে মেসে ওঠেন, তখন হয়তোবা তাঁর মনে হাজারটা প্রশ্ন ওঠে। সারা দিন অফিসের কাজে ব্যস্ত বা ছাত্র হলে কলেজ-প্রাইভেটে সারা দিন ব্যস্ত সময় পার করলেও এই হাজার ব্যস্ততার মধ্যে মনে পড়ে তাঁর প্রিয় সেই বাড়ির কথা, বাবা-মা ও ভাইবোনের কথা, কিন্তু কিছু করার নেই, বাস্তবতা মানতে বাধ্য। তবু সারা দিন কেটে যায় নানা ব্যস্ততায়। কিন্তু যখনই সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামে আর যত রাত যায়, তাঁর মনের ভেতর একাকিত্বের পাহাড়টা যেন বড় হতে থাকে। মনে হতে থাকে আব্বু কী করছেন, আম্মু কী করছেন—হয়তো টিভি দেখছেন বা ঘুমিয়ে গেছেন। ছোট ভাইটা হয়তো পড়া শেষে বিছানা প্রস্তুত করে ঘুমানোর আয়োজন করছে। তখন মনে হতে থাকে আমিও তো একসময় এমন সময়ে পড়া শেষে ভাইটার সঙ্গে একসঙ্গে ঘুমাতে যেতাম, আমিও তো সবার সঙ্গে বসে টিভি দেখতাম। মাঝেমধ্যে মা এসে দেখতেন পড়ছি কি না। কখনো পড়া বাদে মোবাইল হাতে দেখলে বকা দিতেন। এখন কই সেই বকা, সারাক্ষণ পড়া বাদে মোবাইল নিয়ে থাকলেও কেউ আর বলেন না, ‘কি রে পড়া রেখে মোবাইল দেখছিস কেন’, কেউ বলেন না, ‘পড়া বাদ দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে গল্প করছিস কেন?’ কেউ বলেন না। তবু কেন জানি মাঝরাতে হঠাৎ করেই শুনতে পাই আম্মুর সেই বকা, শুনতে পাই, ‘কি রে পড়া রেখে মোবাইল টিপিস কেন?’
রাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়, তখন ঘুমের ঘোরে মাঝেমধ্যে মনে হয় আমার নিজ বাড়িতেই আছি আবার মাঝেমধ্যে তো আম্মু বলে ডেকেই উঠি; কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যে আম্মু আমার থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে।

রান্না খারাপ হলেও কিছু বলা যাবে না, বললে হয়তো খালা রাগ করে আর আসবেন না। বুয়া একদিন এলে দুই দিন আসেন না। ‘কাল দুপুরে আসব, মামা’, এটা বলে এর পরের দিন সকালে এসে নানা অজুহাত দিতে শুরু করেন। যার সব কটাই শুধু শুধু, যা তিনিও বোঝেন, আমিও বুঝি। কিন্তু কিছুই বলা যাবে না। সব চাকরিতেই সবাই বসকে বা পরিচালককে দেখে ভয় পান, কিন্তু এই দিকে মেসে আমাদের ভয় পেতে হয় বুয়াকেই।

বুয়া যখন আসেন না, তখন একবেলা না খেয়েই কাটিয়ে দিই অনেক সময়। আবার যখন দেখি পরের বেলাতেও আসছেন না তখন জীবন বাঁচানোর জন্য হলেও রান্না করতে হয়। যে আমি বা আমরা কখনো রান্নাঘরেই যাইনি এর আগে কখনো, পরিস্থিতির ঠেলায় মানুষ সব শিখে যায়। মেসলাইফে মাসের প্রথম ২০ দিন যেন মেসের ছেলেরা রাজার হালে চলে, এদের মাসের বাকি দিনের যাবতীয় চাহিদা এরা এই ২০ দিনে বাড়ি থেকে পাঠানো টাকা দিয়ে মেটায়। বাকি দিনগুলো রুমে বসে কাটিয়ে দেয়। কারণ, কাছে টাকা থাকে না, অপেক্ষা সেই পরের মাসের টাকার।

মেসজীবনে বাজার করতে গেছে, কিন্তু বাজারের টাকা বাঁচিয়ে নিজের পকেটে ঢোকায়নি, এই রকম ছেলে খুব কম পাওয়া যায়। আমার কাছে মনে হয়, মেসের ছেলেরা পারে না এই রকম কাজ নেই, এরা বাজার করা থেকে শুরু করা রান্না করা, কাপড় কাচা, সব কাজই পারে। মেসের ছেলেরা গরুর মাংসের থেকে পোলট্রির মুরগি খেতে বেশি অভ্যস্ত। এদের পানি খেতে কোনো গ্লাস লাগে না। এদের যদি গ্লাসেও পানি দেওয়া হয়, তবু এরা সেটা বোতলে ঢেলে তারপর বোতল দিয়ে পানি খেতে ভালোবাসে। মেসের ছেলেরা কখনো অহংকারী হয় না, এরা যেকোনো পরিবেশে অন্য কারও সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

মেসজীবনে কথা বগুড়ার দুপচাঁচিয়া উপজেলার সাকিব আহমেদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, মেসজীবন অনেক কষ্টের। এখানে থাকা-খাওয়ার সমস্যা। তা ছাড়া আপনজনদের ছেড়ে একা এক থাকতে হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নতুন রূপে মানুষ চেনা যায়। নিজের পরিবার রেখে মেসের বড় ভাই, বন্ধু, ছোট ভাইদের নিয়ে মেস পরিবার, তবু মেসে থাকার আনন্দটাই অন্য রকম, রোমাঞ্চকর। সংগ্রাম করে, কষ্ট করে বেঁচে থাকতে হয়। এ জন্য মেসে থাকা ছেলেরা দৃঢ় চিত্তের, সাহসী, সংগ্রামী, বাস্তববাদী হয়।

দুপচাঁচিয়া উপজেলার এম এ বাতেন খান বলেন, ‘এটাই মেসের জীবন। কিছু করার নেই। মধ্যবিত্ত পরিবারে যখন জন্ম নিয়েছি, তখন স্বপ্ন পূরণ করতে এমন যুদ্ধ বাধ্যতামূলক। মেসের জীবনে নিজ দায়িত্বেই সব কাজ করতে হয়।’

মেসের জীবনে প্রতি পদে পদে সংগ্রাম, ত্যাগ ও স্বপ্ন জড়িয়ে আছে। তাই মেসজীবন প্রত্যেক মেধাবী শিক্ষার্থীর জন্য অধিক গুরুত্বপূর্ণ। স্বপ্নপূরণের বড় ভূমিকা রাখবে মেসজীবন।

*লেখক: শিক্ষার্থী