ফেরদৌসির সাহিত্যকর্মে ছিল মানবপ্রেম
জগতে যে কজন কবি জন্মগ্রহণ করেছেন, তাঁদের মধ্যে মহাকবি মোহাম্মদ আবুল কাশেম ফেরদৌসির নামটি অন্যতম। তাঁর চিন্তাচেতনায় ছিল গভীর মানবপ্রেম। তখনকার দিনে সৃষ্টিশীল লেখনীতে ছিল আল্লাহর প্রেম। মানুষকে খুশি করার জন্য লিখতেন না। তিনি একাদশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। আজও মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হয় তাঁর লেখা কবিতা। এটি যেন মানুষের অন্তর ও বাইরে খোরাক। তাঁর লেখা কবিতা এখনো বারবার পড়তে ইচ্ছা জাগে।
মহাকবি ফেরদৌসির প্রায় এক শতাব্দী পরও ইরানের বিখ্যাত কবি নিজামি আরজি কবির সম্পর্কে ‘দিবাচায়’লিপিবদ্ধ করেছেন, তা থেকে জানা যায়, মহাকবি ৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের সমরখন্দের অন্তর্গত তুস নগরীর বাঝ নামের গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মোহাম্মদ আবুল কাশেম। গজনির সুলতান মাহমুদ তাঁকে উপাধি দিয়েছেন ‘ফেরদৌসি’। সেই থেকে ফেরদৌসি নামের খ্যাতি ও যশ দেশ থেকে দেশান্তরে ছড়িয়ে পড়ে। কবির বাবা মোহাম্মদ ইসহাক ইবনে শরফ শাহ তুস নগরের রাজকীয় উদ্যানের একজন তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। তিনি জন্মসূত্রে অনেক সম্পত্তির মালিক ছিলেন। তা থেকে প্রতিবছর প্রচুর অর্থ আয় হতো।
বাল্যকাল থেকেই কবিতা লিখতে পছন্দ করতেন এবং অল্প বয়সে সংসারজীবনও শুরু করেছিলেন ফেরদৌসি। যৌবনে রাজকীয় উদ্যানের পার্শ্ববর্তী ছোট্ট নদীর তীরে বসে কাব্য লিখতে বেশ পছন্দ করতেন। তুসের শাসনকর্তার শ্যেনদৃষ্টির কারণে সুখের সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। একমাত্র কন্যাসন্তানকে সৎপাত্রে বিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর বড় আশা। তারপর তিনি কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে নিজ গৃহ থেকে অজানা এক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন।
মহাকবি মোহাম্মদ আবুল কাশেম ফেরদৌসি গজনির বাদশাহ সুলতান মাহমুদের কাছে যথাযথ কদর পাবেন, এ ভাবনা নিয়ে গজনীর উদ্দেশে রওনাও দেন। এরপর গজনির বাদশাহ সুলতান মাহমুদের সঙ্গে দেখা মেলে। ৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ গজনির সিংহাসন আহরণের পর দেশ-বিদেশের কবিদের নিয়ে নিজ দরবারে কবিতা আবৃত্তির আসরও বসাতেন। গজনির রাজদরবারে প্রবেশ করা ছিল তখন কঠিন এক ব্যাপার। ফেরদৌসি দরবারের অন্য কবিদের ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হতেন। অবশেষে সুলতান মাহমুদের উজির বাহাদুরের সহযোগিতায় তিনি রাজদরবারে প্রবেশ করেছিলেন।
দরবারে ফেরদৌসি যখন সুলতান মাহমুদকে কয়েকটি কবিতা আবৃত্তি করে শোনান, এতে তিনি দারুণভাবে মুগ্ধ হন। এতে আস্তে আস্তে কবি ফেরদৌসির সঙ্গে সুলতান মাহমুদের সম্পর্কের গভীরতা অনেক গুণ বেড়ে যায়। কিন্তু এখানেও সুলতানের সঙ্গে কবির গভীর সম্পর্ক আজীবন জন্য স্থায়ী হলো না।
কবি ফেরদৌসির সঙ্গে সুলতান মাহমুদের গভীর সম্পর্ক এবং রাজদরবারে কবির শ্রেষ্ঠ সম্মান দেখে রাজসভার অন্য কবিরা ঈর্ষান্বিত হয়ে কবিকে দরবার থেকে বের করার জন্য গভীরভাবে ষড়যন্ত্রের আটঘাট বাঁধেন। ইতিমধ্যে সুলতান মাহমুদ কবিকে মহাকাব্য ‘শাহনামা’ রচনা করার অনুরোধ জানান। তিনি প্রতিটি শ্লোকের জন্য একটি করে স্বর্ণমুদ্রা ও নগদে ৬০ হাজার দিরহাম দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দেন।
ফেরদৌসি ‘শাহনামা’য় প্রাচীন ইরানের ইতিহাস, কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নিয়ে কাব্যগাথা রচনা করেছেন। ‘শাহনামা’ মহাকাব্য রচনা শেষ হয় হিজরি ৩৯৩ সনে। এতে আছে ৯৯৭টি অধ্যায় ও ৬২টি কাহিনি উল্লেখযোগ্য। এই ‘শাহনামা’ ৭টি বৃহৎ খণ্ডে বিভক্ত এবং পুরো মহাকাব্যে ৬০ হাজার শ্লোক রয়েছে। মহাকবি ২০ বছর রাজসভায় কাটিয়েছেন।
‘ইউসুফ জুলেখা’র কাহিনি নিয়ে ১ হাজার ৮০০ শ্লোকের একটি প্রেমের কাব্যও রচনা করেন ফেরদৌসি। তিনি দীর্ঘ ৩০ বছর ইরানের বিভিন্ন শাসক ও বাদশাহর কাহিনি তুলে ধরেন ‘শাহনামা’য়। ‘শাহনামা’ পৃথিবীর মহাকাব্যগুলোর মধ্যে অন্যতম। সুলতান মাহমুদ তাঁর আমলাদের ষড়যন্ত্রে এক হয়ে কবির সঙ্গে যে কথা ছিল, তা রক্ষা করতে পারেননি। এতে কবি অপমানিত হন, অজানা-অচেনা নিরাপদ এক আশ্রয়ের সন্ধান করতে থাকেন। গজনি ছাড়ার আগে সুলতান মাহমুদের এ হীনম্মন্যতার জন্য তাঁকে গালমন্দ করে কবি একটি ব্যঙ্গরসাত্মক কবিতা মসজিদের দেয়ালে টাঙিয়ে রাতের অন্ধকারে গজনি ছেড়ে যান। তখন সুলতান মাহমুদ পত্রে এসব দেখে বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি কিংবা রাজদরবারে ফেরদৌসির অভাব দারুণভাবে অনুভব করেন। আজ যদি কবি ফেরদৌসি দরবারে থাকতেন, তাহলে এর অর্থ বোঝার জন্য রাজদরবারের বাইরে যেতে হতো না।
সুলতানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কুয়েস্তানের রাজা নসরুদ্দিন মুহতাসেম কবি ফেরদৌসির উচ্চ প্রশংসা করে সুলতান মাহমুদের কাছে একটি পত্রও পাঠান। তিনি কবি প্রতি নিষ্ঠুর আচরণে খুবই মর্মাহত হন। কবির প্রতি ন্যায়বিচার করেননি, বরং ষড়যন্ত্রকারীদের কুপরামর্শে তিনি কবির প্রতি অন্যায় আচরণ করেছেন। তাই সুলতান মাহমুদ বুঝতে পেরে তিনি নিজেকেই অপরাধী মনে করেন। পাশাপাশি কবি ফেরদৌসিকে ক্ষমা করে দেন এবং কবির প্রতি সুলতানের সম্মান প্রদর্শনস্বরূপ কবির প্রাপ্য স্বর্ণমুদ্রাসহ ইরানের তুস নগরীতে কবির নিজ বাড়িতে দূত পাঠান। প্রাপ্য সমুদয় স্বর্ণমুদ্রা কবি আর নিতে পারেননি। কবি তত দিনে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন।
১০২০ খ্রিষ্টাব্দে, মতান্তরে ১০১৪ খ্রিষ্টাব্দে কবি এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন। কবির ইন্তেকালের হাজার বছর অতিবাহিত হলেও কাব্য ও সাহিত্যের মজা মানব-মানবীর অন্তরে রেখে দুনিয়ায় অমর হয়ে আছেন, থাকবেনও।
*তথ্যসূত্র: মাইকে এইচ. হাট
*লেখক: মোহাম্মদ মহসীন, প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ক লেখক