বাল্যবিবাহ
কিশোরী পুষ্প নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বয়স ১৩-১৪ বছর। আজ স্কুল ছুটির পর মন খারাপ করে আনমনা হয়ে স্কুলব্যাগটি পিঠে ঝুলিয়ে একাকী বাড়ি ফিরছে সে। পেছন থেকে খুব দ্রুত হাঁটছে আর উচ্চ স্বরে ডাকছে বান্ধবী স্বর্ণলতা—এই পুষ্প, দাঁড়া, শোন...। তবু পুষ্প শুনতে পাচ্ছে না। আবারও ডাক দিল স্বর্ণলতা—পুষ্প, এই পুষ্প দাঁড়া। কী হলো পুষ্প, শুনতে পাচ্ছিস না? এই পুষ্প, একটু দাঁড়া।
এবার স্বর্ণলতার ডাক কর্ণগোচর হতেই হাঁটার গতি কিছুটা শ্লথ করল পুষ্প। স্বর্ণলতা পেছন থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে পুষ্পর কাছে পৌঁছে বলল, বাব্বাহ! সেই কখন থেকে তোকে ডাকছি। তোর মন কোথায় ছিল শুনি?
পুষ্প স্বর্ণলতার দিকে তাকিয়ে মলিন মুখে মৃদু হেসে বলল, বিশ্বাস কর, তুই ডাকছিস, আসলে আমি খেয়াল করিনি।
স্বর্ণলতা বলল, তা করবি কেন? এখন তো তুই আর আমাদের চিনতে পারবি না। একটু ঠেস মেরে বলল, হাজার হোক নতুন বিয়ে বলে কথা। নতুন জীবনসঙ্গী পাচ্ছিস। এখন কি আর তুই আমাদের চিনতে পারবি? এই বলে হাসতে লাগল স্বর্ণলতা।
স্বর্ণলতার সঙ্গে ছিল পুষ্পর আরেক বান্ধবী প্রভা। সে বলল, কী বললি! সত্যি পুষ্প, তোর বিয়ে?
পুষ্প বলল, আরে না, তোরা যেটা শুনেছিস, তা সম্পূর্ণ সত্যি নয়। তবে গতকাল ঘটক কোথা থেকে যেন ছেলে নিয়ে আসছিল আমাকে দেখানোর জন্য।
স্বর্ণলতা বলল, তা ছেলে কী করে? দেখতে কেমন? বয়স কত?
প্রভা বলল, বাব্বাহ! তুই যেভাবে উকিলের মতো ওকে জেরা শুরু করেছিস, তোর উত্তর দেবে কীভাবে ও?
পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে পুষ্প বলল, ছেলে যেন কী একটা বেসরকারি কোম্পানিতে মোটা অঙ্কের মাইনেতে চাকরি করে। বয়স ৩০–৩৫ বছরের মতো হবে। আমি ভালো করে দেখিনি। তবে মোটামুটি ভালো নাকি। কিন্তু আমি এ বিয়েতে রাজি না। আমি আরও পড়াশোনা করতে চাই। জানিস, আমার মনে অনেক আশা। পড়াশোনা করে বড় হয়ে আমি শিক্ষক হব।
প্রভা বলল, তুই তো পড়াশোনাতে ক্লাসে অন্য সবার চেয়ে অনেক ভালো। তা তোর আব্বা–মা এইটুকু বয়সে তোকে বিয়ে দেবে কেন?
স্বর্ণলতা প্রভার দিকে তাকিয়ে বলল, একদম ঠিক বলেছিস তুই। আমরা এটা হতে দেব না। তারপর স্বর্ণলতা বলল, তুই তোর মা-বাবাকে বলিসনি যে এই বিয়েতে তুই রাজি না? তুই এখন বিয়ে করতে চাস না। পড়াশোনা করতে চাস।
পুষ্প বলল, মাকে বলেছি; কিন্তু ঘটক কী সব বুঝিয়ে বাবাকে রাজি করিয়ে ফেলেছে জানি না!
প্রভা বলল, তোরা যা–ই বলিস, এটা কিন্তু একদম উচিত না। আচ্ছা ভেবে দেখেছিস, ছেলের বয়স পুষ্পর চেয়ে কত বেশি? এতটা বয়স হয়েছে অথচ সে এখনো বিয়ে করেনি কেন?
স্বর্ণলতা বলল, আরে বুঝলি না প্রভা, এ ধরনের ছেলেরা যৌবন বয়সে বারো ফুলে ঘুরে বেড়ায়। তারপর যখন বয়সটা হেলে পড়ে, তখন টাকা আর চাকরির জোরে এরা অল্প বয়সী উঠতি যৌবনের কচি মেয়েদের খোঁজে ঘরের বউ করার জন্য।
প্রভা বলল, তুই ঠিক বলেছিস। আমার তো মনে হয়, এ–জাতীয় ছেলেদের চরিত্র ভালো হয় না। বিয়ের পর ঘরে বউ থাকতে অন্য নারীদের প্রতি আসক্ত থাকে।
স্বর্ণলতা বলল, আমারও তা–ই মনে হয়। কথায় বলে না, ইল্লত যায় না ধুলে, খাসলত যায় না ম’লে। মানুষের যার যা খাসলত, তা মৃত্যুর আগপর্যন্ত পরিবর্তন হয় না। হয়তো ক্ষণিকের জন্য মুখোশ পরিবর্তন করে। ভালো মানুষের ভাব ধরে আরকি।
ওরা কথা বলতে বলতে বাড়ির পথ শেষ হয়ে এলো। স্বর্ণলতা বলল, পুষ্প, তুই একদম চিন্তা করবি না। আমার চাচা মেম্বার। আমি চাচাকে বলব তোর আব্বাকে বুঝিয়ে বলতে, এখন যা।
পুষ্প বলল, তাহলে খুব ভালো হয় রে। তোরা যদি আমার এই উপকারটা করিস।
প্রভা বলল, যা, চিন্তা করিসনে। বললাম তো আমরা দেখব, কথা দিলাম।
এরপর ওরা যে যার মতো বাড়ির পথে রওনা দিল।
পুষ্প বাড়ির ভেতর ঢুকতেই তার পাঁচ বছর বয়সের ছোট ভাই সৌরভ দৌড়ে এসে বলল, আপু আপু, আজ না ঘটক এসেছিল। সামনের শুক্রবার ছেলের বাবা–চাচারা আসবে সেই কথা বলতে।
শুনে পুষ্পর মনটা আবারও খারাপ হয়ে গেল।
পুষ্পর বান্ধবী প্রভার ভাই শুভ ওদের স্কুলের শিক্ষক। শুভ বাড়িতে ফিরলে প্রভা তার ভাইকে সবকিছু খুলে বলল।
এদিকে স্বর্ণলতা তার মেম্বার চাচাকে সব বলল।
কয়েক দিন পরেই পুষ্পকে দেখতে আর তার বিয়ের কথাবার্তা পাকা করতে ছেলের অভিভাবকেরা এসেছে। পুষ্পর বাবা সামছুল হক গরিব মানুষ। তাই সে যেন কন্যাদায় থেকে মুক্ত হতে পারলেই বাঁচে।
মেহমানদের বসতে দিয়েছে পাশের ঘরটিতে। আধা পাকা দুই কামরাবিশিষ্ট টালির ছাউনির ঘর সামছুল হকের। সে তড়িঘড়ি করে বাইরের রান্নাঘরের দিকে এসে পুষ্পর মা রজনীকে বলল, কই গো পুষ্পর মা, একটু তাড়াতাড়ি পুষ্পকে গুছিয়ে মেহমানদের সামনে আসতে বলো।
পুষ্পর মা বলল, পুষ্প তো ভীষণ কান্নাকাটি করছে। বলছে, সে নাকি এখন বিয়ে করবে না। পড়াশোনা করবে। তাই বলছিলাম কি, মেয়ের মনের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে দেওয়া কি উচিত হবে? তা ছাড়া ওইটুকু মেয়ে। কয় দিনেই বা বয়স হয়েছে ওর।
সামছুল হক শুনে বলল, সবই বুঝি পুষ্পর মা। কিন্তু মেয়ের বিয়ের বয়স হলে যে বিয়ে দেওয়াই ভালো, বুঝলে।
এমন সময় পেছন থেকে মেম্বার সাজ্জাদ রহমান এসে বলল, কার বিয়ের বয়স হয়েছে চাচা?
সেদিকে তাকিয়ে সামছুল হক বলল, আরে মেম্বার যে। তা এসে ভালোই করেছেন। আমি আরও আপনাকে ডাকতে কাউকে পাঠাতে চেয়েছিলাম।
সে সময় স্কুলের মাস্টার শুভ বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে বলল, শুধু মেম্বারকে ডাকলে হবে, আমাদের ডাকবেন না চাচা?
আরে মাস্টার, কেন ডাকব না, আসেন আসেন।
তারপর ছেলে সৌরভকে ডেকে বলল, বাবা সৌরভ, মেম্বার আর মাস্টারকে বসতে দে বাবা।
মেম্বার বলল, কার যেন বিয়ের বয়স হয়েছে বলছিলেন চাচা?
সামছুল হক বলল, আমার মেয়ে পুষ্পর কথা বলছিলাম মেম্বার। ছেলেপক্ষের বাবা-চাচারা এসেছে পুষ্পকে দেখতে। ছেলে আগেই দেখে গেছে। তারা একটু মেয়ে পুষ্পকে দেখবে। তারপর দিন–তারিখ ঠিক করবে বিয়ের জন্য।
মেম্বার বলল, মেহমানরা কই চাচা? বাইরে চেয়ার এনে উনাদের ডাকুন।
একটু পরেই বাইরে এলো মেহমানরা। সালাম বিনিময় ও কুশলাদি জিজ্ঞাসার পর মেম্বার বলল, আপনারা একটু বসুন। তারপর মেম্বার বলল, এখানে আপনারা প্রায় সকলেই বয়োজ্যেষ্ঠ ও জ্ঞানী–গুণী বিচক্ষণ ব্যক্তি। আমার চেয়ে আপনারা অনেক ভালো বোঝেন। তবু বলছি, এ বিয়ে হবে না।
পাত্রপক্ষ বলল, কেন? কেনে হবে না বাবাজি?
তখন পাশ থেকে মাস্টার শুভ বলল, বিষয়টা আমি আপনাদের বলছি। আচ্ছা বলুন তো, আপনাদের ছেলের বয়স কত হবে?
ছেলের বাবা সেলিম মিয়া বলল, ৩০–৩৫–এর মতো হবে। কেন বাবাজি?
শুভ বলল, বলছি।
তারপর পুষ্পর বাবা সামছুল হকের দিকে তাকিয়ে বলল, চাচা, পুষ্পর এখন বয়স কত?
সামছুল হক বলল, ১৪ বছর চলছে মাস্টার।
শুভ বলল, তাহলে এবার ভাবুন তো, মেয়ের চেয়ে ছেলের বয়স কত বছর বেশি। কতটা ব্যবধান। অথচ গবেষণা করে স্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্র–পাত্রীর বয়সের ব্যবধান পাঁচ থেকে ছয় বছর হওয়া বাঞ্ছনীয়। কেননা তাতে উভয়ের স্ব্যস্থ্য ভালো থাকে। অল্প বয়সী মেয়ে বিয়ে দিলে স্বাস্থ্যগত অনেক সমস্যা সৃষ্টি হয়। সংসারের কাজকর্মের চাপ। অল্প বয়সে গর্ভধারণ। তা ছাড়া সেসব বাচ্চাকাচ্চা লালনপালন করতে গিয়ে শরীরে নানা রকম রোগ বাসা বাঁধে। তখন শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে, শরীর ভেঙে যায়।
মেম্বার বলল, এবার আমি একটু বলি মাস্টার। শুনুন, যেহেতু বিয়েশাদি কোনো পুতুল কিংবা ছেলেখেলা নয়। তাই বলছি, টাকা বা অর্থসম্পদ স্বামী–স্ত্রীর মাঝে সুখ এনে দিতে পারে না। বয়সের সামঞ্জস্য বিয়ের ক্ষেত্রে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তা ছাড়া পুষ্পর এখনো বিয়ের পূর্ণ বয়স হয়নি। বাংলাদেশের বিয়ের আইন মোতাবেক একটা ছেলের ২২ বছর আর মেয়ের ১৮ বছর হতে হবে। পুষ্পর এখন যে বয়স, এই বয়সে বিয়ে দেওয়াটাকে বাল্যবিবাহ বলে। যেটা বাংলাদেশের নারী ও শিশু মানবাধিকার ট্রাইব্যুনাল আইনে জঘন্য ও অমার্জনীয় অপরাধ।
সব শুনে ছেলেপক্ষের লোকজন বলল, তোমরা আমাদের চোখ খুলে দিয়েছ বাবাজিরা। আমরা চলে যাচ্ছি।
ঘর থেকে পুষ্প আর তার বান্ধবী প্রভা, স্বর্ণলতা ও অন্যরা এতক্ষণ সবকিছু শুনছিল। মেহমানরা চলে যেতেই পুষ্প ও তার বান্ধবীদের মুখে হাসি ফুটে উঠল।
শুভ বলল, চাচা, একটু কষ্ট হলেও মেয়েটাকে পড়ালেখা করান। কারণ, ওর মেধা অনেক ভালো। দেখবেন তা একদিন কাজে আসবে।
সামছুল হক বলল, আর বলতে হবে না মাস্টার। আমি আমার মেয়ে পুষ্পকে অনেক লেখাপড়া করাব। লেখাপড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর বিয়ের কথা মুখেও আনব না।
মেম্বার বলল, এই তো এবার আমার চাচার সুবুদ্ধি হয়েছে।
এরপর সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল পুষ্পদের বাড়ি থেকে।
এরপর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। পুষ্প লেখাপড়া শেষ করে এখন নিজেদেরই গাঁয়ের স্কুলের হেডমাস্টার হয়েছে। সামছুল হক ও তার স্ত্রী রজনী বেগম হয়েছে একজন হেডমাস্টারের গর্বিত মা-বাবা। সে সময় যদি মা-বাবা তাকে বাল্যবিবাহ দিয়ে দিত, তাহলে আর মেধার আলোর বিকিরণ ছড়াতে পারত না পুষ্প। একটি বাল্যবিবাহের মধ্য দিয়ে তার স্বপ্ন আর কচি মনের আশা-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে আজকের এই প্রতিফলিত শিক্ষার দীপ্তি সবার অগোচরে চিরতরে অমাবস্যার অন্ধকারের অতল গহিনে সমাধিস্থ হতো।