বায়োস্কোপ

শারদীয় দুর্গাপূজাফাইল ছবি

আমি উৎপল, বুয়েটের ইঞ্জিনিয়ার। বাবার পাঁজি অনুযায়ী আমার বয়স সাতাশ ছুঁই ছুঁই। নয় মাস হলো সরকারি চাকরি পেয়েছি। বড় চাকরি, রাজধানী ঢাকার সচিবালয়ে আমি এখন সহকারী সচিব। গৌরবের সঙ্গে একটু গরিমাও এসেছে, বাতাসের সৌরভে যেমন আসে ধুলোবালু। নিজের গল্প তাই নিজেই বলি।

বিয়েটা করে ফেলা দরকার, জীবনের এক-তৃতীয়াংশ বা তারও বেশি তো শেষ কিন্তু মেয়ে কোথায় পাই। এটুকু জীবনে কতবার কত মেয়েকে ভালো লাগল, একটাকেও ধরে রাখতে পারলাম না। এখন চাই মনের মতো একটা বউ, যে চোখ দেখে মনের কথা, ঠোঁট দেখে মুখের কথা বুঝতে পারবে। ছোটখাটো বাসাও একটা দরকার, বেতন যা পাই, চলতে পারব কি না ভয় পাচ্ছি। যাক, প্রয়োজনে টিউশনি করব, বউ বাইরে কাজ করলে করুক, না করলেও সই।

নাড়ির টানে বাড়িতে যাই, ঢাকা শহরে যত আরামেই থাকি, আমার বাড়ি আর দেশ বলতে বুঝি আমার গ্রামের জন্মভিটা। পৃথিবীর আলো আর মাটি প্রথম দেখলাম যেখানে, সেই আলো-মাটি আমাকে বারবার টেনে নিয়ে যায়। মরণেও যেন সেখানেই পাই ঠাঁই।

সাভারে প্রশিক্ষণ নিতে গিয়ে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হলো, বেশ কয়েকজন সুবন্ধু হলো। একবার ওদের নিয়ে আসতে হবে আমাদের বাড়িতে। দেখি, সময়-সুযোগ উপলক্ষ বের করতে হবে। তাড়াহুড়ো করা ঠিক হবে না। এবার দুর্গোৎসবে আমি একাই যাই। বিরলদা তো বউদিকে নিয়ে আগেই চলে গেছে, সবাই নিশ্চয়ই আমার পথ চেয়ে অপেক্ষায় আছে। মাহিরকে অন্তত নিতে পারলে হতো, ছেলেটা আমারই মতো গ্রামীণ জমিনে বড় হয়েছে। অন্তরের কোথায় যেন তাকে পাই বারবার। বেটার উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে, একা একা খেটে সচিবালয় ছেড়ে পররাষ্ট্র ক্যাডারে চলে যাচ্ছে। তার পথ ধরতে হবে, আগামী বিসিএসটার জন্য উঠেপড়ে লাগতে হবে।

বনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষ। শিল্প মন্ত্রণালয়ে যোগ দিয়ে ছুটি নিয়ে মহানন্দে এলাম বাড়িতে। এবারকার শারদীয়ায় মা দুর্গা যেন তীব্র আকর্ষণে আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে। ঘুমেও যেন শুনতে পাই ঢাকের ডাক। আমাদের পূজা কমিটি নেই, বাবা একাই এক শ, এতকাল তা-ই দেখে এসেছি। আমাকে কেউ কিছু করতে দিচ্ছে না। সংসারে সমাজে আমার কদর বেড়ে যাওয়ায় বরং অস্বস্তি লাগছে। ছোট্ট শিশুর মতো আমার হাত ধরে বাবা মণ্ডপে নিয়ে গেলেন।

এত দিনে বুঝেছি দুর্গাপ্রতিমাটিতে নানা ভাবের সমন্বিত প্রকাশ ঘটেছে। চার সন্তানের জননী দুর্গা মাতৃরূপেন ও শক্তিরূপেন, তিনি গৌরী বিপত্তারিণী। ডানে ও বাঁয়ে দুই পরম পূজনীয়া দেবীÑবিত্তের লক্ষ্মী ও বিদ্যার সরস্বতী। দক্ষিণে সিদ্ধিদাতা গণেশ, বাঁয়ে বলরূপী কার্তিকেয়। সিংহের ওপরে মাতৃচরণ, হিংসারূপ অসুর আক্রান্ত, ওপরে ৩৩ কোটি দেবতা আর তাদের মাঝখানে দেবাদিদেব মহাবেদ। দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য যুগে যুগে মানবরূপী অবতারের আবির্ভাব ঘটে। পিতৃদেব বুঝিয়ে বললেন, বাবারে, আমরা ঠিক মূর্তিটাকে পূজা করি না, বিভিন্নরূপে ঈশ্বরের প্রতিরূপ/প্রতিভূকে ঈশ্বরজ্ঞানে হৃদয়ার্ঘ্য নিবেদন করি। নিরাকারকে ধারণ করতে পারি না বলেই আকারে সে আসে। তবে যে নামে যত আছে দেব-দেবী, সর্বমূলে একমূল, সে হলো পরম ভগবান ব্রহ্ম।

পশুশক্তিকে পরাভূত করে সত্ত্বগুণের প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বেশ্বরী বিশ্বমাতা শ্রীদুর্গা-মূর্তিতে এখন আমাদের সামনে আবির্ভূতা হয়েছেন। চক্র শঙ্খ ত্রিশূল গদা তীর-ধনুক অসি বর্ম ও ঘন্ট নিয়ে অসুরদলনে যিনি অপরাজিতা বা করাল মূর্তি দশভুজা, শরণাগতের নিকট তিনিই ব্রহ্মময়ী মা, অসহায় নিপীড়িতের আশ্রয়। দশমহাবিদ্যায় মা দুর্গার দশমূর্তি: কালী তারা ষোড়শী ভুবনেশ্বরী ভৈরবী ছিন্নমস্তা ধূমাবতী বগলা মাতঙ্গী কমলা। বাবার ব্যাখ্যা শুনে, নিষ্ঠা দেখে নমিত হই তার চরণে। তিনি আমাকে বুকে টেনে আশীর্বাদ করলেন। আহ্, কী শান্তি, কী শান্তি!

গতকাল বীথি এসেছিল সান্ধ্য পুজোয়। আমি দেখলাম, সে দেখল। আর কেউ দেখেছিল কি না আমাদের চার চোখ কে জানে। ঈশ্বর দেখলে আপত্তি নেই, আমাদের কষ্ট বুঝুক। আহা বীথি, তুমি কেন হঠাৎ করে এত বড় হয়ে গেলে! বাচ্চা কোলে ঘোমটা দিয়ে টকটকে লাল সিঁদুর পরে এসেছিল রীতা। থাক, সবাই সুখে থাকুক সংসারে। পরস্ত্রীকে কামনা করা নাকি হারাম। সেদিন হাফিজের হাতে হারাম-হালালের একটা লিস্ট দেখেছিলাম। এই লিস্ট এড়ানোর জন্যই কি অনেক মানুষের জীবন চলে আঁকাবাঁকা চোরাপথে?

আমাদের বাড়ির চারপাশে দেখি যে যা পারে নিয়ে বসেছে বিক্রয়ার্থে। প্রতিবছর তা-ই হয়, ছোটবেলায় পুজোর চেয়ে মেলাকেই মনে করতাম দুর্গোৎসব। একবার ঘটল এক মজার কাণ্ড, শরীর খারাপ বলে শয্যাগত আমি। পায়ের আওয়াজ পেলাম, কে যেন দাঁড়িয়ে আমার শিয়রের কাছে। চোখ খুলে দেখি বীথি! ছোটবেলায় আমার সবচেয়ে প্রিয় লভ্য, কদমা নিয়ে এসেছে কাপড়ের একগোছায়, সঙ্গে একটা রক্তজবা। ছোটবেলায় না বুঝেই সে বলত, তুমি আমার দেবতা, আমি বলতাম, তুই আমার দেবী। আহা, জীবনভর যদি এই দেব-দেবীর খেলা চলত।

আজ যে কী হলো আমার, পেটের যন্ত্রণায় দেবীর সান্নিধ্যে গিয়ে শান্তিতে বসতে পারিনি। আশ্বিন-কার্তিকের আকাশ, মেঘের পর মেঘ জমিয়ে বারবার আলো-আঁধারির খেলা দেখাচ্ছে ধরণিমাতা। বেশ কয়েকজন বন্ধু-স্বজন এসেছিল দেখা করতে, বললাম শুধু, শরীরটা ভালো না, আরেক দিন এসো। কখন যে সন্ধ্যা নেমে এল, ক্ষুধায় মরে যাচ্ছি। মা খাবার নিয়ে এল কয়েকবার। যা মুখে দিই তার চেয়ে বেশি বের হয়ে যায় বমিতে। অভিমানে মাকে বললাম, আর কিছু খাবই না মা। এই আনন্দ-উৎসবের দিনে মার কষ্টের মুখ দেখে বেশি কিছু আর বলতে পারলাম না।

আজ গেল নবমী, শুক্লপক্ষের রাত। শরীর সায়সারা দিচ্ছে না কোনো কাজে, সব যেন ঝিমিয়ে আসছে, জ্ঞান হারাব না তো আবার! রাত বাড়ছে তো বৃষ্টিও বাড়ছে। সারা দিন খাটাখাটুনির পর সবাই হয়তো গভীর ঘুমে অচেতন। রাতের নিঝুম অন্ধকারে এই অঝোর বৃষ্টির মধ্যে আমি কাকে ডাকব এখন। নিজের ওঠারও সামর্থ্য নেই। বিছানায় শুয়েই উথাল-পাতাল ভাবছি। জীবন-পরিধি আর কর্মপরিসর নিয়ে কত ভাবনা আমার। বিভিন্ন সময়ে পড়া শ্রীমদ্ভাগবদ্গীতায় বর্ণিত নানা কিসিমের জপতপ আসতে থাকল মনে: যে আমারে যে প্রকারে করে আরাধনা, আমি তারে সে প্রকারে পুরাই বাসনা। শূন্য হাতে এসেছি, শূন্য হাতে যাব। আজ যা আমার, গতকাল তা অন্যের ছিল এবং আগামীকাল তা আরেকজনের হবে। আত্মার কোনো জন্ম-মৃত্যু নেই, সে চিরন্তন চিরবিদ্যমান, দেহের সাথে তার বিনাশ হয় না। হে ঈশ্বর! তুমি আমার মাতা-পিতা-বন্ধু-সখা, তুমিই আমার বিদ্যা-ধন, তুমিই আমার সবকিছু। সকলেই সুখী হোক, সকলেই রোগশূন্য হোক। সকলেই মঙ্গল লাভ করুক, কেহও যেন দুঃখভোগ না করে। অসত্য হতে আমাকে সত্যে নিয়ে যাও। অন্ধকার হতে আমাকে আলোতে নিয়ে যাও। মৃত্যু হতে আমাকে অমরত্বে নিয়ে যাও। আমার নিকট আবির্ভূত হও, আবির্ভূত হও।

হঠাৎ মাথা ঝিম ধরে এল, আমি কি মরে যাচ্ছি? মরণটা তাহলে এ রকমই!

* * * * *

আমি বিরল, উৎপলের বড় ভাই। অর্থনীতিতে লেখাপড়া শেষ করে স্বাধীন একটা পেশার খুঁজে আছি। বশ্যতা অধীনতা ধরাবাঁধা আমার ভালো লাগে না। সাংবাদিকতা কেমন কে জানে। মা-বাবার বড় সন্তান আমি। জুলিকে বিয়ে করলাম পছন্দ করে। দুর্মুখেরা বলবে, সোনার ছেলেটা শেখের মেয়ে বিয়ে করে গোল্লায় গেছে। সুতরাং বাড়িতে এবার পুজোয় যেতে হবে আগেভাগে। প্রেমে টইটম্বুর স্ত্রী তো সানন্দে রাজি।

শুভ মহালয়ায় বাড়িতে গিয়ে দেখি আমার উপবাসী বাবা অনেক কিছুই করে রেখেছেন। আলোকোজ্জ্বল সুসজ্জিত প্যান্ডেল করেছেন ভক্তদের নিয়ে, ঘট ও প্রতিমা স্থাপনের কাজ শেষ করে বিশেষ পূজাও হলো আজ। আমার মানবীপ্রতিমা দেখতেও অনেক বন্ধুবান্ধব আসবে, সুতরাং কিছু বাজারসদাই করতে হবে। সন্তানদের লেখাপড়া ও পূজায় সারাটা জীবন আত্মনিয়োগ করে গেছেন নিরীহ শিক্ষকপিতা। এবারও অকালবোধনের বাদ্য বেজে উঠতেই তার বয়স্ক দেহমন চাঙা হয়ে উঠেছে। বাবার দিকে তাকিয়ে আমার মন খারাপ হয়ে যায়, এমন নিবেদিতপ্রাণ ঈশ্বরভক্ত মানুষ কী করে বেঁচে আছে এই দুর্বিপাকের পৃথিবীতে। জ্ঞান ও ঐশ্বর্যদায়িনী দেবীদ্বয় বাবাকে কতটুকু দিয়েছেন বোঝা ভার, কিন্তু মমতাময়ী দুর্গা তার মনে দিয়েছেন অফুরন্ত প্রাণশক্তি। আজ তিনি সশ্রদ্ধচিত্তে স্মৃতিতর্পণ করলেন তার স্বর্গীয় পূর্বপুরুষদের।

ষষ্ঠী তিথিতে উৎপল চলে এসেছে বাড়িতে। মা আর ছোট বোন বীণা তাকে পেয়ে খুশিতে উদ্বেল। ভোরে কল্পারম্ভ হলো। অপরাহ্ণে বোধন-অধিবাস উপলক্ষে এলাকার লোকজন এসেছেন দেবীর আগমনকে স্বাগত জানাতে। শঙ্খের ধ্বনি ও চণ্ডীপাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হলো আবাহন। নৃত্য-গীত-আগমনীবার্তার মধ্য দিয়ে এবার মা দুর্গা ধরণিতে বাবার বাড়িতে আসবেন ঘোড়ায় চড়ে, বিদায় নেবেন দোলায় চড়ে। এমন আনন্দ-উৎসবের দিনে সবাই একসঙ্গে হয়েছে, সেই খুশিতে মার রান্নাবাড়া বেড়ে গেছে, কথা বলারই যেন সময় নেই। আমার মায়ের আনন্দ উপচে পড়ে চোখেমুখে নয়, খাবার বাসনে। খেতে বসলে কত কিছু যে বের করে কোথা থেকে। কোনটা রেখে কোনটা খাব, মা বলে সব খাও। পেটে জায়গা নেই কিন্তু চোখের ক্ষুধা আর মুখের স্বাদ কমে না।

সেদিন সপ্তমী, বাড়িভর্তি লোক। লৌকিকতা সামাজিকতা ও কুশলাদি বিনিময়ের জন্য গ্রামের লোকজন ছাড়াও এসেছে আশপাশের গ্রামের কুটুম, পরিচিত বন্ধু ও উৎসাহী জনতা। দেবীর সমাপনান্তে পুরোহিতের শাস্ত্রপাঠ শুনতে বাবার পাশে বসলাম আমি আর উৎপল। বেদ-পুরাণ-তান্ত্রিকের দুর্বোধ্য ভাষা বুঝি না কিন্তু কোথায় যেন দুর্দমনীয় মাদকতা অনুভব করি। আরতি আর নারীদের উলুধ্বনির মধ্যে দেবী গমন করবেন প্রতারক মহিষাসুর বধে, তারই অপেক্ষায় সবাই উদ্‌গ্রীব। লোক দেখে মা-বাবা যেন আরও উদার সদয় সবল হয়ে উঠেছেন। কাউকে কিছু না খাইয়ে বাবা কখনই তাদের খালি মুখে ফিরতে দেবেন না। যাকে যেভাবে পারেন, আপ্যায়ন করছেন। আমি কিছুটা বিরক্ত, নতুন বউটাও নতুন কাণ্ডকারখানা দেখে হতভম্ব। প্রতিমা দেখতে যাঁরা আসছেন তাঁরা সবাই নতুন বউকেও দেখতে চান, আমাকে তাই ব্যস্ত থাকতে হয় অভ্যর্থনায়। মা হেঁশেলে, বাবা মণ্ডপে, বোনটা দৌড়াদৌড়িতে।

মহাষ্টমী শুরু হলো দেবীর গুণকীর্তন দিয়ে। পুরোহিতের মন্ত্র-শ্লোক-স্তোত্র-আরতির সঙ্গে বাবাও যেন তলিয়ে গেলেন ভাবের রাজ্যে। মহাদুর্গার স্বর্গীয় পবিত্রতার স্মরণে মহানন্দে উদ্‌যাপিত হলো কুমারীপূজা। অনুপম মাধুর্যে স্নিগ্ধশুদ্ধ বাচ্চাটাকে দেখে জুলি আস্তে করে কানে কানে বলে, এ রকম একটা মেয়ে চাই আমার! দিনান্তে শুরু হলো সন্ধিপূজা, অষ্টমী-নবমীর শুভ সন্ধিক্ষণে দেবী যাচ্ছেন বিনাশ করতে। শঙ্খধ্বনি উলুধ্বনির আনন্দোৎসবে বেজে উঠল ঘণ্টা-ঢাক-ঢোলের উন্মাদনাময় নৃত্য। ষাষ্টাঙ্গ প্রণাম জানিয়ে আদি-শক্তিময়ী বিজয়িনী মায়ের পাদদেশে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করলাম পরিবারের সবাই একসঙ্গে। বংশের সব বিদেহী আত্মার শান্তি কামনায় প্রার্থনা হলো।

মহানবমীতে খুশিতে উদ্বেল সবাই। দুষ্ট ‘দুর্গম’ অসুরকে বধ করে সত্য-সুন্দর-ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা করলেন সর্বময়ী দুর্গামাতা, যিনি এই বিশ্বের চূড়ান্তকারণ, পূর্ণতা ও শান্তির অভিব্যক্তি। হোম, যজ্ঞাগ্নিতে ঘৃতাহুতি ও খাদ্য বিসর্জন দিয়ে মঞ্চে উপবিষ্ট অন্য চার দেব-দেবীকেও অর্চনা-উপচারে মণ্ডিত করা হলো। নৃত্য-গীত-সিঁদুর মাখামাখিতে পুরো বাড়ি যেন আনন্দসাগরে ভাসছে। এই আনন্দঘন দিনে যে যাকে যা পারে, উপহারও দিচ্ছে। মেয়েরা দেবীকে ‘ভোগ’ দিচ্ছেন, সেই ভোগের ভাগীদার হলেন একে একে উপস্থিত সবাই। জুলিকে নিয়ে রাতের এক ফাঁকে গেলাম সৃষ্টি ও জীবনের প্রতীক মাতা পার্বতীকে আরেকবার শ্রদ্ধাঞ্জলি জানাতে, দুই পুত্র কার্তিক ও বিনায়ককে নিয়ে তিনি যেন আমাদের স্বাগত জানালেন। জুলি একবার অস্ফুটস্বরে বলল, বাবা শিব কোথায়? আমি হেসে বললাম, কাজে গেছেন! ‘বোন গঙ্গা, আর ভাই বিষ্ণু?’ ‘আরে দূর, বড়রা আছে যার যার সংসারে ব্যস্ত।’

গ্রামের লোকজন সাধারণত রাত জাগে না, সন্ধ্যাবাতি জ্বালিয়ে কেউ সামান্য খেয়ে, কেউ না খেয়ে বিছানায় চলে যায়। মেঘ-ঠান্ডা রাত পেয়ে উৎসাহী লোকজন নৃত্যগীত করল নিশিরাত অবধি। বাবা যথারীতি ঘরে-পালা শখের দুর্দান্ত এক পাঁঠা উৎসর্গ করলেন মায়ের চরণকমলে। সেই দেখে সধবা মেয়েরা দেবীর কপোলদেশ-পাদপদ্ম রাঙিয়ে দিলেন গভীর শ্রদ্ধায়, নিবিড় মমতায় এক অন্যের ললাটে দিলেন রক্তলাল সিঁদুর-তিলক যেন সুখের হয় তাদের বিবাহিত জীবন। জুলি দাঁড়াল এসে পাশে, স্বামীর সিঁদুর না পেলে কি তার মন ভরবে?

উৎপল? উৎপল কোথায় রে? শুনলাম, সারা দিন খেটেখুটে সন্ধ্যায় বিছানায় পড়েছে। ক্লান্তি বা ঘুম নয়, পেটের যন্ত্রণায়। কখন কী খেয়েছে, পেট খারাপ হয়ে পড়ে আছে বাহির ঘরে। এর মধ্যে একবার গেলাম উৎপলকে দেখতে। নেতিয়ে পড়েছে। পায়ের শব্দে চোখ খুলল, আমাকে দেখেই যেন সাহস পেল, ‘বড়দা, ডাক্তার ঔষধ কিছু একটার ব্যবস্থা করা যাবে?’ আমাকে দ্বিধান্বিত দেখে কষ্টে একটু হাসল, ‘আমার পকেটে টাকা আছে...।’

‘রাত তো অনেক রে, সকাল হলেই চকবাজার যাব, দেখি কে আছে, কী ওষুধ পাওয়া যায়।’

‘মা-কে একটু ডাকো, কথা বলি।’

বের হয়ে দেখি প্রায় সবাই চলে গেছে। খুটখাট শব্দ শোনা যায় কিন্তু বাবা-মা কাউকে দেখছি না। ব্যস্ততায় ক্লান্তিতে ঘুমে আলস্যে আমিও বিপর্যস্ত, মাকে উৎপলের কথা বলতে পারলাম না। বিছানায় যেতেই আমাকে ধরল মরার ঘুম, বাইরে কোথায় কার কী হলো খবর নিতে পারলাম না। ভোরে জোর করে ঘুম ভাঙিয়ে বউ বলল, ‘রাতের তৃতীয় প্রহর থেকে শুরু হয়েছে কানফাটা বৃষ্টি। আমার কেমন যেন ভয় ভয় লাগছে। বৃষ্টি কেন থামছে না?’

‘আরে ধুর, আশ্বিন-কার্তিকের বৃষ্টিকে ভয় পেলে বৈশাখের তুফানকে কি পাবা? গ্রামের দোচালা টিনের ঘরে শুইয়া নিশিরাইতের তুফান তো দেখো নাই।’

শুভ বিজয়া দশমী। দেবীর সপরিবার নিরঞ্জনের মধ্য দিয়ে একে অপরের সঙ্গে আলিঙ্গন, শুভেচ্ছা বিনিময় এবং গুরুজনদের আশীর্বাদ নিয়ে এবারের দুর্গোৎসবের পরিসমাপ্তি হবে। প্রতুষ্যেই বিদায়রাগিণীর করুণ সুর শুনলাম বিছানায় থেকেই। উঠে বের হয়ে দেখি সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। মা রান্নাঘরে, বীণা আছে সঙ্গে। বাবা অভ্যাগতদের সাদরে সাগ্রহে সযত্নেœবসাচ্ছেন প্রতিমার সামনে উঠানে। বিমোহিত ভক্তগণ সাশ্রুনয়নে তাকিয়ে আছেন হাসোজ্জ্বল মায়ের পানে। তিনি আজ প্রত্যাবর্তন করবেন কৈলাসগিরির স্বামীগৃহেÑস্বর্গবাসে, বিলীন হবেন মহাবিশ্বে। প্রতিবছর প্রতিবার দেখা হবে, সেই অপেক্ষার আকুতি সবার চোখেমুখে।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বাবার কথামতো কিছু কেনাকাটা করতে বাজারে রওনা হলাম। পথে মনে পড়ল উৎপলটার কথা। আচ্ছা, ভালোই হলো, দেখি বাজারে কার দোকানে পেট খারাপের ওষুধ পাওয়া যায়। ডাক্তারের অবস্থা এখন কী রকম কে জানে। শুনেছি কয়েকজন কম্পাউন্ডার বড়ি-ট্যাবলেট বিক্রয় করেÑওরাই দরকারে চিকিৎসা করে, ইনজেকশন দেয়, ডাক্তার পরিচয়ে বিকেলে এবাড়ি-ওবাড়ি যায়। গুরুতর কিছু হলে, যাদের সাধ্য আছে, যায় সদরে পাস করা ডাক্তার দেখাতে।

বাজার শেষে ফিরে আসছি, হাতে পুঁটলি, পকেটে ‘ওর স্যালাইন’। অন্য কোনো ওষুধ পেলাম না, উৎপল নিশ্চয়ই জানে গ্রামের অবস্থা। বাড়ির কাছে আসতেই শুনি মানুষের কান্না, একজন নয়, অনেকের চিৎকার-চেঁচামেচি আর্তনাদ! পূজায় এসে তো ঝগড়া করার কথা নয়, কী হলো! পায়ের গতি বাড়িয়ে দিলাম কিন্তু কিসের ভয়ে যেন গা ছমছম করে উঠছে। ঘাটে এসে দেখি জটলা, উঠানে এসে দেখি উৎপল শুয়ে আছে চৌকিতে। মা-বাবা মাটিতে পড়ে আছেন কাত হয়ে, বীণার কান্নায় আমি বাক্যহারা। জুলি এসে আমার পাশে দাঁড়াল, গত সাত বছরে তার এমন ভয়ার্ত চেহারা দেখিনি। এমন আনন্দের বাড়িতে সহসা কী হয়ে গেল! আমি উৎপলের দিকে তাকাই, কিছু ভাবতে পারি না। ওকে ডেকে কিছু জিজ্ঞাসা করব, সেই সাহসও পাচ্ছি না। এত দিন ভেবেছিলাম ছোটখাটো হলেও আমি খুব সাহসী পুরুষ, কোথায় সেই ভয়াবহ সাহস? তারপর...তার আর পর নাই।

* * * * *

আমি মাহির, উৎপলের বন্ধু। মাত্র দুই মাসের ভালো পরিচয় কিন্তু মনে হয় যেন কত যুগ ধরে তাকে চিনি। সাভারে একই রুমে ছিলাম দুজন। পরিচয় যে এত তাড়াতাড়ি বন্ধুত্বে পরিণত হয় জানতাম না। অবশ্য হবার হলে দ্রুতই নয়, নইলে কখনো নয়। যাক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে জীবনের এক ক্রান্তিলগ্নে এসে পৌঁছেছি, অন্তত হিমালয়ের গোড়ায় এসে স্থান গেড়েছি, এবার চূড়ায় ওঠার পালা। সংগ্রাম করতে এখন মজাই লাগে, সাঁতার শেখার পর সমুদ্র যেমন ভালো লাগে।

অফিসের নতুন কর্মকর্তা আমি, মাঝেমধ্যে অফিস সহকারীরা ‘কাগজ’ সই করাতে নিয়ে আসেন। এত সব বুঝি না এখনো। না বুঝে অথবা যা বোঝায় তা-ই বুঝে সই করে দিই। সেদিন অলিউল্লাহ একটা কাগজ নিয়ে এলেন, গৃহনির্মাণ ঋণ প্রদান মঞ্জুরি-সংক্রান্ত। আলাপ করছি, সচিবালয়ের আধমরা নীল পিএবিএক্স সজোরে বেজে উঠলÑক্রিং ক্রিং ক্রিং। মোহসীন বলল, ‘মাহির, খবর খুব খারাপ। উৎপল নাই, গত রাতে ডায়রিয়াতে...গ্রামের বাড়িতে।’

‘কোন উৎপল? কী বলো এসব?’

‘আমাদের ব্যাচের উৎপল। হ্যাঁ, ওর বড় ভাই নিজেই ফোন করেছিল।’

‘চলো যাই, আজই।’

‘আচ্ছা, দেখি গাড়িটাড়ি ম্যানেজ করা যায় কি না।’

উৎপল, তুমি একি করলে? বিদায়ের দিন তুমি আমার খাতায় লিখেছিলে, ‘আমি জল, তুমি চন্দন।’ তুমি সত্যি জল হয়ে গেলে, জলের এত অভাব ছিল তোমার! আমি ফরেন সার্ভিসে চলে যাচ্ছি শুনে তোমারও ইচ্ছা হয়েছিল নেক্সট বিসিএস দিয়ে ফরেন সার্ভিসে আসবে, এই তোমার ফরেন সার্ভিস! রাত যখন সাড়ে তিনটা, প্রকৃতির সাথে তুমি যেন রাগ করে পৃথিবীকে ছেড়ে চলে গেলে। কিন্তু উৎপল, তোমার কি যাবার সময় হয়েছিল? ঠিক আছে, আমিও আসছি, পরজীবনে আবারও ইহজীবনের কথা হবে। এটুকু সময় পর্যন্ত অপেক্ষা করো।

সারা রাত ভালো ঘুম হয়নি। চারটায় উঠে গেলাম। সাতটায় ‘তিস্তা’ ছেড়ে দিল। সঙ্গে আছে ফসিউল্লা, রিপন ও ফারুক। আমরা যাচ্ছি উৎপলের বাড়িতেÑওহ্ উৎপল, আমি আসছি তোমার বাড়িতে। শেরপুর পৌঁছে হোটেলে কিছু খেলাম। সিভিল সার্জনের পাজেরো গাড়িটাও পাওয়া গেল অনুরোধে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের তীর ঘেঁষে, অনেক শাখানদী পার হয়ে গ্রাম্য পথে চার চাকা ছুটে চলল নালিতাবাড়ী। উৎপল, এত দূরে জন্মেছিলে তুমি, আমারই মতো নিখুঁত পাড়াগাঁয়ে।

অগম্য পথে গাড়ি আর চলে না। যাব খালভাঙ্গা গ্রামে। কর্দমাক্ত পথে পায়ে হেঁটে মধ্যাহ্নে উৎপলদের বাড়ির আঙিনায় এসে দাঁড়ালাম। বিরলদা আর জুলি বউদি বের হয়ে এলেন ঘর থেকে। বাবা-মা আছেন আগে থেকেই উঠানে। তারা নাকি সারা রাত আকাশের নিচে মাটিতে শুয়ে-বসে ছিলেন। স্বজন পরিজন এবং সারাগ্রামের সারা এলাকার সব শ্রেণির মানুষ আছে, উৎপল শুধু নেই। উৎপলের প্রিয় ছিল তার ‘ভালোবাসার মানুষ’, সেই ভালোবাসার মানুষ আজ আসছে চারদিক থেকে। মা আছেন নির্বাক, বাবা হতবিহ্বল, বোন দিশাহারা, ভাই-বউদি চোখের জলে টলায়মান। সেই নদীতীরে তাকে দাহ করা হয়েছে, যে নদী পার হয়ে উৎপল বহুদিন ওই গ্রামে গিয়েছে পড়তে।

কী কারণে যেন প্রতিমা বিসর্জন হয়নি। একপাশে দেখি স্বর্ণোজ্জ্বল পোশাকে ভূষিতা মা দুর্গার সংহার মূর্তি, তারই চারপাশে সহাস্যে পরিতুষ্ট পরম পূজনীয় দেবদেবীগণ। আমার ইচ্ছা হলো চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করি সর্বদুঃখহারিণীকে, ‘হে শস্যময়ী প্রাণময়ী দুর্গতিনাশিনী ভগবতী, এত সুন্দর পৃথিবীতে কেন এত দুঃখ এনে দিলে? তবু তুমি কেন হাসো? কিছুতেই তোমার কান্না আসে না?’ তিনি যেন নড়েচড়ে উঠলেন, আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম, শুধু আমাকেই যেন বললেন, ‘আধাআধি বৎস্য, সবই আধাআধি।’ কে যেন আমাকে ছোটবেলার বায়োস্কোপ দেখানো শুরু করল, একের পর এক আসছে দৃশ্য: পূর্ণিমা আর অমাবস্যা, জোয়ার আর ভাটা, জল আর স্থল, হাসি আর কান্না, ঘৃণা-ভালোবাসা, জন্ম আর মৃত্যু...। রাতে সার্কিট হাউসে ঘুমিয়ে আছি, কে যেন আবার বায়োস্কোপ ছেড়ে দিল: রোদ-বৃষ্টি, পাহাড়-পাতাল, মিলন-বিরহ, প্রাচুর্য-দারিদ্র্য, ন্যায়-অন্যায়, সত্য-মিথ্যা...।

পরদিন ভোর চারটায় উঠলাম, সোয়া পাঁচটায় জামালপুর থেকে রওনা দিল ঢাকার ট্রেন। আবার দেখা হবে উৎপল, আজ তাহলে আসি। এদিকে সবকিছু ঠিকঠাক। আমরা বন্ধুরা হাসছি, বিয়েশাদির কথা বলছি, মেয়েদের দিকে তাকাচ্ছি কিন্তু তুমি উৎপল থেমে গেলে। অথচ গতি ছিল তোমারই ততোধিক। ট্রেন চলছে দ্রুত, ঘর-বাড়ি-গ্রাম-শহর পেরিয়ে একের পর এক বায়োস্কোপের ঘটনা আসতে থাকে, আমি তন্ময় হয়ে জানালার পাশে বসে ক্ষণিকের জন্য সব দেখি। ব্যাচমেটদের নিয়ে কিছুদিন পর ‘ক্লাব নাইন’-এর সম্প্রীতিমূলক পুনর্মিলনী হলো আনন্দ-উল্লাসে। উৎপল নেই অথচ সব ঠিক আছে। পৃথিবী কাউকে পরোয়া করে না। ব্যক্তি ব্যক্তিকে অনুভব করে কিন্তু সমষ্টি ব্যক্তির জন্য বসে থাকে না। খোদার জগতে ঘটনাই মুখ্য, ব্যক্তি গৌণ।

ভালো, সে জন্যই হয়তো বায়োস্কোপ দেখা আমার আর শেষ হয় না।

* মনিরুল ইসলাম, সচিব/রাষ্ট্রদূত (অবসরপ্রাপ্ত)