রিয়াদ ভাইরে বাদ দিয়ে দিলেন?

আসন্ন এশিয়া কাপের জন্য ঘোষিত ১৭ সদস্যের দলে মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ নেই জেনে একজন ক্রিকেটার জনৈক ক্রিকেট কর্মকর্তাকে বলেছিলেন, ‘রিয়াদ ভাইরে বাদ দিয়ে দিলেন?’ তামিমের মতো এ দেশের লাখো ক্রিকেটপ্রেমীর মনে আজ এই একই জিজ্ঞাসা—কেন এশিয়া কাপে জায়গা হলো না দেশের ক্রিকেটে ক্রাইসিস ম্যান বা দ্য সাইলেন্ট কিলার নামে পরিচিত মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের? বিশ্বকাপে তিনি থাকবেন কি না, তা অনেকটাই অনিশ্চিত। অনেকেই ইতিমধ্যে দেখতে পাচ্ছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে মাহমুদউল্লাহর বিদায়। দেশজুড়ে এ নিয়ে চলছে তুমুল আলোচনা, পর্যালোচনা আর সমালোচনা। হচ্ছে ব্যাপক প্রতিবাদ—রাজপথে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।  

অনেক ক্রিকেটবোদ্ধা বলছেন, ক্রিকেটপ্রেমীরা নাকি আবেগতাড়িত হয়ে এ রকমটা করছেন। ক্রিকেটীয় এবং খেলোয়াড়ি মনোভাব নিয়ে বিষয়টা বিবেচনা করা উচিত। দলের দীর্ঘমেয়াদি সাফল্য এবং কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নির্বাচক কমিটি, টিম ম্যানেজমেন্ট, প্রধান কোচ এবং অধিনায়ক যৌথভাবে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কী সেই পরিকল্পনা? বাংলাদেশ দলে ৭ নম্বর পজিশনে যিনি ব্যাট করবেন তাঁকে হতে হবে এক্কেবারে মারমার–কাটকাট ধরনের, স্ট্রাইক রেট হতে হবে ১০০–এর ওপরে।

অনেকটা ভারতের হার্দিক পান্ডিয়ার মতো। মাহমুদউল্লাহর মধ্যে নাকি এ বিষয়গুলোর ঘাটতি দেখতে পাচ্ছেন দেশের ক্রিকেটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তাব্যক্তিরা।

বিষয়টার কিছুটা গভীরে যাওয়া যাক। কিছুদিন ধরে মাহমুদউল্লাহকে নিয়ে চলছে একধরনের টানাপোড়েন, ঢাক ঢাক গুড় গুড়। দলে ছিলেন না বিগত তিনটি ওয়ানডে সিরিজে। তখন বলা হয়েছিল, তাঁকে বিশ্রাম দেওয়া হয়েছে। এ সুযোগে তরুণ, প্রতিভাবান ক্রিকেটারদের ঝালিয়ে নেওয়া হবে, তাঁদের তৈরি করা হবে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে। বিশ্রাম শেষে রিয়াদ দলের সঙ্গে যোগ দেবেন। দেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, মাহমুদউল্লাহ বিশ্বকাপ স্কোয়াডে থাকবেন। এশিয়া কাপের জন্য প্রস্তুতি ক্যাম্পে মাহমুদউল্লাহকে ডাকাও হয়েছিল। তারপর তিনি ছিটকে পড়লেন দল থেকেই।

অনেকেই মাহমুদউল্লাহর সাম্প্রতিক নিম্নগামী পারফরম্যান্সের দিকে ইঙ্গিত করেন। পরিসংখ্যান আসলে কী বলে? ২০২২ সালে বাংলাদেশের হয়ে এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রহকারী ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। সর্বোচ্চ রান ছিল লিটন দাসের ৫৭৭; মাহমুদউল্লাহ করেছিলেন ৪১০। ২০২৩ সালে তিনি মাত্র একটা সিরিজ খেলার সুযোগ পান—ইংল্যান্ডের বিপক্ষে। এ সিরিজে তিনটি ম্যাচে তাঁর রান ছিল ৩১, ৩২ ও ৮। ওয়ানডের সুপার লিগে বাংলাদেশের চতুর্থ সর্বোচ্চ রানসংগ্রহকারী ছিলেন মাহমুদউল্লাহ। তথাকথিত ‘বিশ্রামে’ যাওয়ার আগে শেষ ১০টি আন্তর্জাতিক এক দিনের ম্যাচে তিনি করেছিলেন ৪৩ দশমিক ৩৭ গড়ে মোট ৩৪৭ রান। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে (ডিপিএল) শেষ ১০টি ম্যাচে ৪২ দশমিক ৩৩ গড়ে ৩৮১ রান করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে ৫টি অর্ধশতক। সুতরাং পারফরম্যান্সের যুক্তি আসলে ধোপে টেকে না। ইংল্যান্ড সিরিজে রিয়াদ হয়তো আশানুরূপ রান পাননি, তাই বলে একটা সিরিজের পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিয়ে তাঁর মতো একজনকে দল থেকে বাদ দেওয়া কতটা যুক্তিযুক্ত, সে প্রশ্ন করাই যায়।

এবার দেখা যাক মাহমুদউল্লাহকে বিশ্রামে পাঠিয়ে যাঁদের সুযোগ দেওয়া হয়েছিল তাঁরা কেমন করেছিলেন? বেশ কয়েকজন খেলোয়াড়কে ৭ নম্বরে ট্রাই করা হয়েছিল কিন্তু দুঃখজনকভাবে তাঁরা কেউই ভালো করতে পারেননি, মাহমুদউল্লাহর তুলনায় তো নয়ই। তাহলে? এশিয়া কাপের জন্য ঘোষিত ১৭ জনের দলে এমন খেলোয়াড় আছেন যাঁর এখনো আন্তর্জাতিক একদিনের ক্রিকেট অভিষেকও হয়নি।

এমন খেলোয়াড়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাঁর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট রেকর্ড বা পারফরম্যান্স ভীষণ হতাশাজনক।

এশিয়া কাপ বা বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার (এক্সপেরিমেন্ট) জায়গা না।

এক্সপেরিমেন্ট বা এক্সপোজার দেওয়ার মতো অনেক সিরিজ, টুর্নামেন্ট রয়েছে যেখানে তরুণদের সুযোগ দিয়ে ধীরে ধীরে বড় টুর্নামেন্টের জন্য প্রস্তুত করা হয়। এশিয়া কাপ বা বিশ্বকাপের মতো আসরে আপনি চাইবেন আপনার সেরা এবং পরীক্ষিত খেলোয়াড়েরা থাকুন। মাহমুদউল্লাহ অন্তত যেকোনো বিবেচনায় ১৭ জনের দলে স্থান পাওয়ার জোরালো দাবি রাখেন।

সাধারণ দর্শকেরা না হয় আবেগপ্রবণ। ওই ক্রিকেটারও কি তাই? এই যে তামিম ইকবাল যিনি ভাঙা কবজি নিয়ে দলের প্রয়োজনে দ্রুতগতির পেস বোলারের সামনে এক হাতে ব্যাট নিয়ে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন। ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের কথা ভাবেননি। লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নিজের নাম লেখা তথা বাংলাদেশের ক্রিকেটকে গৌরবান্বিত করার জন্য যে ভয়ংকর আগ্রাসী ইনিংস খেলেছিলেন, সেটা রূপকথাকেও হার মানায়। দেশের ক্রিকেটের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সেরা ব্যাটসম্যান, সদ্য সাবেক হওয়া ওয়ানডে অধিনায়ক তামিম যখন মাহমুদউল্লাহর বাদ পড়াকে মেনে নিতে পারেন না, তখন আমরা সাধারণ দর্শকেরা আবেগতাড়িত হব, এটাই স্বাভাবিক।  

মাহমুদউল্লাহর সঙ্গে আসলেই অনেক আবেগ জড়িত। ২০১১ সালে দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই অবিশ্বাস্য জয়! ২২৫ রান তাড়া করতে গিয়ে ১৬৯ রানে ৮ উইকেট হারিয়ে ফেলে টাইগাররা। খাদের কিনারা থেকে বোলার শফিউলকে সঙ্গে করে যে অতিমানবীয় ইনিংস সেদিন তিনি খেলেছিলেন, জয় করে নিয়েছিলেন এ দেশের লাখো-কোটি ক্রিকেট দর্শকের হৃদয়। ২০১৫ সালের বিশ্বকাপ—প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ কোয়ার্টার ফাইনালে। পারফরম্যান্স বিবেচনায় এখন পর্যন্ত আমাদের সেরা সাফল্য। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রিয়াদের ১০৩ রানের সেই মহাকাব্যিক ইনিংস! বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কোনো ক্রিকেটারের প্রথম সেঞ্চুরি। এর পরের ম্যাচে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে আরেকটি শতক—১২৩ বলে অপরাজিত ১২৮ রান।

২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়নস ট্রফি। আবারও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা। ২৬৬ রান তাড়া করতে গিয়ে ৩৩ রানে নেই ৪ উইকেট। এমন এক নাজুক পরিস্থিতিতে সাকিবকে সঙ্গে নিয়ে গড়লেন এক অবিশ্বাস্য জুটি। দুজনের জোড়া শতকে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ পৌঁছে যায় সেমিফাইনালে।  

২০১৮ সালে নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ম্যাচ। ফাইনালে যেতে হলে জিততেই হবে। চরম উত্তেজনা। আম্পায়ারের ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করতে গিয়ে একপর্যায়ে অধিনায়ক সাকিব ক্রিজে থাকা দুই ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহ আর রুবেলকে মাঠ ছেড়ে চলে আসতে বলেন। অনেক নাটকের শেষে আবার খেলা মাঠে গড়ায়। একপর্যায়ে জিততে হলে বাংলাদেশ দলের প্রয়োজন ২ বলে ৬ রান।

মাহমুদউল্লাহর সেই অবিশ্বাস্য ছয়! বাংলাদেশ পৌঁছে যায় ফাইনালে।    

এ কথা সত্যি সবাইকে একদিন থামতে হয়। কেউ চিরদিন দলে থাকবেন না। মাহমুদউল্লাহ, তামিম, মুশফিকরাও অবসরে যাবেন। তবে সেটা যেন হয় সম্মানের সঙ্গে। কেননা তাঁরা দেশের সম্পদ; এ দেশের লাখো কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীর রোল মডেল, তাঁদের আদর্শ। অগণিত তরুণ-তরুণী উজ্জীবিত হয় মাহমুদউল্লাহদের দেখে।  

বাংলাদেশের ক্রিকেটের সোনালি প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী মাহমুদউল্লাহ বিশ্বকাপ দলে থাকবেন কি না জানি না, তবে তিনি আজীবন থাকবেন লাখো-কোটি ক্রিকেটভক্তের হৃদয়ে।    

লেখক: সাজ্জাদুল হাসান, একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কর্মরত