অভিযোগ
দিনের চব্বিশ ঘণ্টায় যেন নিজেকে খরগোশের ন্যায় কোথায় কোথায় ব্যস্ত রেখে চলেছি তার হিসাব মিলিয়ে দেখার সময় পর্যন্ত যেন নেই। সারা দিন কতটা ভালো বা খারাপ কাজ করলাম, সেই বিষয়টাও যেন কোনোভাবেই নির্ণয় করা হয়ে ওঠে না। হঠাৎ করেই রোববার বিয়ের অনুষ্ঠানের দাওয়াত পেলাম। যদিও ব্যস্ততার কারণে আমি দাওয়াতটা মন থেকে গ্রহণ করিনি, তবুও অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ স্বজনদের অনুষ্ঠান হওয়ায় না করতে পারিনি। রোববার সকাল হতে না হতেই অনুষ্ঠানে সঠিক সময়ে যাওয়ার বিষয়টি মনে করিয়ে দিল প্রিয় বন্ধু জাফর। এই জাফরের ফোন পেলেই আগে পকেটে হাত দিয়ে দেখি মানি ব্যাগে যথেষ্ট টাকা আছে কি না। কেননা, জাফরের কূট কৌশলের কারণে বিভিন্নভাবে রেস্তোরাঁর বিলটা আমার কাঁধে এসেই চাপা পড়েছে। এ জন্য আমি তাকে মিরজাফর বলেই ডাকতাম। তবে আত্মসম্মান যাতে নষ্ট না হয়, সেদিকটা খেয়াল রেখেই মানুষের মধ্যে তাকে প্রকৃত নাম জাফর ডাকতাম।
যাহোক, গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে বন্ধু হিসেবে জাফর আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করে। বিয়ের অনুষ্ঠানে আমাকে যেতে হবে বেলা দুইটার দিকে। এ জন্য ভাবলাম রোববার যেহেতু ভার্সিটিতে ক্লাস নেই, সেহেতু আমার উচিত হবে সকালে টিউশনিটা করিয়ে আসা। টিউশনি থেকে এসে তখনো হাতে প্রায় দেড় ঘণ্টা সময় রয়েছে। অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুত হলাম। এখন শুধু জুতাটা পায়ে দিয়ে সুনসান বেরিয়ে পড়ব। মেসে আমার কক্ষে টেবিলের পাশেই রাখা আছে চার তাকবিশিষ্ট একটি র্যাক। র্যাকের দ্বিতীয় তাকটাতে একজোড়া কালো রঙের জুতা কিছুটা হেলানো অবস্থায় রাখা ছিল। জুতাটা পায়ে দেওয়ার জন্য এগোতেই চোখ পড়ল টেবিলের দিকে। টেবিলে চোখ পড়তেই হতবাক হয়ে গেলাম এবং কতকগুলো অজানা প্রশ্নের উত্তরে নিজেকে ব্যর্থ প্রমাণিত করলাম।
বিষয়টি হলো এই যে টেবিলের ওপর ৭০-৮০টি বই নোংরা অবস্থায় মরণ যন্ত্রণা ভোগ করছে। টেবিলে বিভিন্ন ধরনের বই থাকলেও ব্যাকরণ অনুযায়ী সব বইয়ের সাধারণ নামই বই। এখানে বইয়ের নাম নির্দিষ্ট করে উল্লেখ না করে আমি আমার মূল প্রসঙ্গে যাই। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই বই আমাকে বেদনাতুর কণ্ঠে প্রশ্ন করে বসল কেমন আছো প্রিয়? আমি অতিরিক্ত কোনো উত্তর খুঁজে না পেয়ে আস্তে করে উত্তর দিলাম ভালো। আমি বইকে কোনো প্রশ্ন না করায় সে আপনা থেকেই আবার প্রশ্ন করল তুমি ভালো আছো, সেটা বুঝতে পারলাম, কিন্তু আমি কেমন আছি জানতে চাইবে না? আমি তার কথামতো প্রশ্ন করলাম যে সে কেমন আছে। সে উত্তর দিল অন্যভাবে। বলল, প্রিয় মানুষটি যদি তোমার নাম তার হৃদয় থেকে মুছে ফেলে, তাহলে তুমি কেমন অনুভব করবে? আমি ঠিক তেমন আছি। সে শুধু আমাকে আচমকা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছে, কেন তার যথার্থতা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। বই কেন অন্তরে এমন কষ্টভরে উত্তর করছে? তবে এটা সত্য যে প্রিয়জন দূরে চলে যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। কোনো কিছু না ভেবেই প্রশ্ন করলাম তোমার প্রিয়জন কে? কে তোমার নাম হৃদয় থেকে মুছে ফেলেছে? সে আবেগভরা কণ্ঠে উত্তর দিল, তুমি। তুমিই আমার হৃদয়ে দাবানলের সৃষ্টি করেছ। উত্তরটা অত্যন্ত কৌতূহলপূর্ণ মনে হওয়ায় জুতা পরা রেখে তার সঙ্গে সংলাপে বসলাম।
আমাকে একের পর এক প্রশ্ন করেই চলেছে। সে বলল, আচ্ছা, মেনে নিলাম যে তুমি সারা দিন অনেক কাজে ব্যস্ত থাক। কিন্তু সারা দিনের মধ্যে কি একটি ঘণ্টা সময়ও ঘরের এই বিদ্যাভান্ডারী প্রিয়জনের জন্য হয় না? কথা তো সত্য। সর্বশেষ কবে যে এই আপনজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছে, সে একমাত্র আল্লাহ তাআলা জানে, আমার তো সেসব দিন–তারিখ কিছুই মনে নেই। যথাযথ উত্তর খুঁজে না পেয়ে অজুহাত দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। বললাম, টিউশনি, ভার্সিটিতে ক্লাস আর খাবারদাবার বা অন্যান্য জরুরি কাজ করতে গিয়েই তো দিন শেষ হয়ে যায়। এ জন্য তোমার সঙ্গে সাক্ষাতে বসতে পারি না। কিন্তু বই তো আর পাগল না। আমার এসব অজুহাত ধোপে টিকল না। বরং অজুহাতের পরিবর্তে আরও কিছু তিক্ত কথা শোনার অংশীদার হলাম। সে বলল, এই দুটি মাত্র কাজ করেই তোমার দিন পার হয়ে যায়? ঢের হয়েছ দেখছি। তা তুমি ভাবছ তোমার খোঁজখবর আমি কিছুই রাখিনে। আরে, তুমি আমার প্রিয়জন। আমার খবর তুমি না রাখলেও তোমার খবর আমি ঠিকই রাখি। টিএসসিতে চা খাওয়া, ভিক্টোরিয়ার মতো উন্মুক্ত পার্কে বসে বন্ধুদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দেওয়া, সদরঘাটে লঞ্চে লঞ্চে ঘুরে বেড়ানো, রাতের শহরে সাইকেল নিয়ে হঠাৎ করেই বেরিয়ে পড়া—এগুলোতে বুঝি তোমার সময়ের কোনো অভাব হয় না। মনে মনে ভাবতে লাগলাম, এখন মন স্থির করে একটা অনুষ্ঠানে যাব, তোমার এখনই সময় হলো এসব প্রশ্ন করার। যাহোক, একটা উত্তর না দিলে রেহাই নেই। তাই একটা ভুল যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করে বললাম, মাঝেমধ্যে ব্যস্ততা রেখে মনকে একটু উৎফুল্ল রাখার প্রয়োজন আছে। এ জন্য একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য এসব জায়গায় যাই। উত্তরটা দিয়েই অনুভব করলাম যুক্তিটার ভিত্তি কাঠামো দুর্বল হয়েছে, এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। না জানি প্রতি উত্তরে সে আবার কী বলে বসে। কিন্তু আমার যুক্তির বিরুদ্ধে কথা বলাকে উপেক্ষা করেই সে বলল, সপ্তায় সপ্তায় যে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাও, সেই সময়টা কীভাবে পাও? আমি থতমত খেয়ে বললাম, সেগুলোর উদ্দেশ্য হলো জ্ঞানার্জন করা। বই দেখছি আজকে আমাকে ধুয়ে দিচ্ছে। আমার প্রতিদিনের রুটিনের ফালতু কর্মকাণ্ডের কোনোটাই বাদ দিচ্ছে না। আমি আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এমন সময় সে আবার বলে উঠল, আচ্ছা, বলো তো একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন কত ঘণ্টা ঘুমানো উচিত? প্রশ্নটা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে থাকতে অনেকবার পড়েছি। এ জন্য উত্তরটা ঠোঁটের আগায়ই ছিল। উত্তর দিলাম। সে আবার বলল, তুমি দিনে কত ঘণ্টা ঘুমাও? আমি বললাম, সাত ঘণ্টা। সে রেগে বলল, রাত এগারোটায় ঘুমিয়ে বেলা এগারোটায় উঠলে কি সাত ঘণ্টা হয়? আমি আর কোনো কথা বললাম না। যুক্তি-তর্ক বাদ দিয়ে একটু দমে গেলাম। ভয় পেয়ে মনে মনে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলাম। তাকে সময় না দেওয়ার আসল কারণটা এখনো গোপন রয়েছে। সে কি এই গোপন রহস্যটাও উন্মোচন করে বসবে। কারণ, তার মুখে আজকে কিছুই আটকাচ্ছে না। বইয়ের এসব বকবকানি যাতে না শুনতে হয়, সে জন্য টেবিলের ওপর থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়ার জন্য দরজার দিকে মুখ ফিরে দাঁড়ালাম। এমন সময় সে ঝগড়াটেদের মতো চিৎকার দিয়ে বলে উঠল, তোমাকে কী বলেছিলাম? আমি কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলাম, কী বলেছিলে? এতক্ষণ আমি ভাবছিলাম যে আসল কথাটাই বলে দেয় কি না। আসলে সে কী বলেছিল, এটা বলতে যা বোঝাল, তা বুঝতে আমার কিছুমাত্র বাকি নেই। আসলে অনেক দিন ধরে একজনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকলে সাধারণভাবেই একধরনের অবহেলার জন্ম হয়। আমারও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। আমি অন্য একজনের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে নিতে চেয়েছিলাম। এ কথাটি প্রথমে সরাসরি তার কাছে বলতে পারিনি। পরে একদিন সাহস করে বলেছিলাম এবং সে অনেক রেগে গিয়েছিল। একাধিকবার বলার পরে সে আমাকে কয়েকটা শর্ত জুড়ে দিয়ে সম্মত হয়েছিল। বিষয়টা হলো এই সে (বই) আমার ঘরে থাকার পাশাপাশি একটি মোবাইলও এই ঘরে নিয়ে আসব। কিন্তু কেউই চাই না জীবনে অলক্ষুনে সতিন ঘরে আসুক। তবুও আমি তাকে (বই) অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছিলাম এই শর্ত যে তোমাকে (বই) এবং তোমার সতিন মোবাইলকে সমান সমান সময় ও ভরণপোষণ দেব। কিন্তু মোবাইল আমার ঘরে আসার পরে দিন বদলে গেছে, মুখের কথাও বদলে গেছে। নতুনকে রেখে পুরাতনের দিকে কে চায়? তাই তো এখন মোবাইলকেই বেশি সময় দেওয়া হয়। বইয়ের রাগের এটাই প্রধান কারণ। মঞ্চের প্রধান বক্তা যেমন সবার শেষে আকর্ষণীয় বক্তব্য দেন বা জাদুকরের শেষের জাদুটা দর্শকের মাঝে যেমন বেশ কৌতূহলের সৃষ্টি করে, বই তেমনি এতক্ষণ আমার অন্যান্য অপ্রধান দোষের কথা বলছে, কিন্তু এখন সব শেষে তাকে সময় না দেওয়ার প্রধান রহস্য যে মোবাইল এই সমস্যার কথাই চমৎকারভাবে উল্লেখ করছে। সে বলে, আমার মোবাইল নামক সতিন থাকতে আমাকে কেন অযথা সময় দেবে? আমার নিকট তো সামান্য তথ্য আর তোমার মোবাইল হতে যেকোনো তথ্য পেতে পারো। আমি তো পুরোনো হয়ে গেছি। আমাকে এখন শুধু শুধু প্রয়োজন হবে কেন? যেকোনো সমস্যার সমাধানের জন্য তো তোমার মোবাইলের ইউটিউব ব্যবহার করতে পারো; বিশ্বের যেকোনো তথ্য পেতে গুগল ব্যবহার করতে পারো; কোনো কিছু ভালো না লাগলে দীর্ঘ সময় ধরে চ্যাট জিপিটির সঙ্গে গল্পের আসর জমাতে পারো; খবরাখবরের জন্য তোমার মোবাইলকে ব্যবহার করতে পারো। আর কী বলব? বিভিন্ন মানুষের দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের কথা জানতে ফেসবুকের নিউজ ফিডের গুরুত্ব তোমার কাছে অপরিসীম। ফেসবুকের রিলস ভিডিওর প্রতি তোমার আসক্তির কথা তো ছেড়েই দিলাম। আমার কি কোনো গুরুত্ব এখন তোমার কাছে থাকবে বলো?
এতক্ষণ বইয়ের বকবকানি শুনে নিজে মনে মনে অনুশোচনাবোধ করছিলাম। কিন্তু ফেসবুকের রিলস ভিডিও দেখার কথা বলায় মস্তিষ্কটা একেবারে বিগড়ে গেল। যে ফালতু কাজে আমি অভ্যস্ত না, সেটা বললে আমার মেজাজ সপ্তমে চড়ে যায়। তাই নিজেকে আর থামাতে না পেরে বইগুলোকে ধরে দূরে ছুড়ে ফেলে দিতে এক পা এগোনোর সঙ্গেসঙ্গেই সে বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও। না বুঝে আমাকে আঘাত করবে না। একটা সময় তার সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল, এই কথাটি মনে হতেই আমি দাঁড়িয়ে গেলাম এবং কর্কশ স্বরে বললাম, কী বলবে তুমি? আর কথা বলার ইচ্ছা নেই। তার সঙ্গে তর্ক করতে করতে আধা ঘণ্টার বেশি সময় পার করে দিয়েছি। সে বলে উঠল, একটিবার চিন্তা করে দেখো তো। পুরো পৃথিবীতে আলো কে ছড়ায়? আজকে তুমি যে মোবাইল নিয়ে এত বড়াই করছ, সেটা আমার থেকে ধার করা জ্ঞান দিয়ে তৈরি করা, তা কি তুমি জানো? তোমার মোবাইলের আর আমার বৈশিষ্ট্যের মধ্যে বড় পার্থক্য হলো মোবাইল ভালো ও খারাপ উভয় কাজের উপদেশ দিলেও আমি সর্বদা ভালোটার উপদেশই দিয়ে থাকি। সুতরাং আমার গুরুত্ব কতখানি, তা বিখ্যাত মনীষীদের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখো। তোমার ইউটিউব, ফেসবুক, গুগল, মেসেঞ্জারের কলিংপদ্ধতি, গেমিং, চ্যাট জিপিটি সবার জ্ঞানই আমার নিকট থেকে ধার করা। তাহলে বুঝতে পারছ আমার গুরুত্ব কতটুকু? বৃথা তুমি আমাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইছ।
প্রসঙ্গক্রমে আর একটা কথা বলে রাখি, যদি আমাকে আর ভালো না লাগে, তবে আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না। বরং আমার গায়ে লেগে থাকা মাকড়সাওয়ালা ঝুলগুলো ভেঙে নীলক্ষেতের লাইব্রেরিগুলোতে রেখে আসাই এখন তোমার উচিত বলে আমি মনে করছি। আমি লাইব্রেরি থেকে অন্যের বাড়িতে গিয়ে জ্ঞানের আলো ছড়াতে চেষ্টা করব। আর যদি আমার কথাগুলো যুক্তিসংগত বলে মনে করো; নিজে জ্ঞানের শক্তিতে বলীয়ান হতে চাও, তাহলে আমাকে এখন থেকে যত্ন করো প্রিয়। আমি তার শেষের কথাগুলো শুনে তাকে আঘাত করতে ব্যর্থ হলাম। কেননা, বইয়ের অভিযোগগুলো অস্বাভাবিক কিছু নয়। স্বীকার করতে বাধ্য হলাম অত্যন্ত মূল্যবান কথা বলেছে সে।
আসলে বই পড়ে পৃথিবীতে জ্ঞানী হওয়া যায়, এটা চিরন্তন সত্য। এই কথা আমি অস্বীকার করতে পারব না। তাই এতক্ষণ যাকে ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল, তাকে কাছে টেনে নিয়ে দিলাম অবশিষ্ট এক ঘণ্টা সময় এবং বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য রওনা হলাম।
*লেখক: মো. আশিক আলী, বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়