আর কত কাঁদাবে তিস্তা?
ভাঙতে থাকা নদীর পাড়ে চলছে বসতবাড়ি সরিয়ে নেওয়ার প্রাণান্তকর চেষ্টা। নদীর বক্ষে তলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে এলাকার একমাত্র স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও পুরোনো আমলের মসজিদ। কয়েক দিন আগে যখন শেষবার কুড়িগ্রামের রাজারহাটের চরগতিয়াশ্যাম ও নামাভরত মৌজা দেখতে গিয়েছিলাম, তখন এমনই মর্মান্তিক দৃশ্য ছিল সেখানে। এখন সেটুকুও আছে কি না, বলা দুষ্কর। গত ৪০ বছরে এ অঞ্চলের মানচিত্র ওলট-পালট করে তিস্তা নদীর স্রোত এখন দিশাহারা। অপরিকল্পনা আর অবহেলায় এভাবেই দিনের পর দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে তিস্তাপারের গ্রামগুলো৷
আমরা যখন গতিয়াশ্যামে গিয়ে পৌঁছাই, তখন সেখানে সরানো হচ্ছিল শ্রমিক গাজীউর রহমানের আধপাকা বাড়িটি। তাঁরই কাছে জানতে চাইলাম, দুই বছর আগে নদীর পাড় কোথায় ছিল। গ্রামের লোকজন আঙুল তুলে দেখিয়ে দিলেন, নদীর মাঝখানে! গত বছরও যে নদী অর্ধেক ছিল, আজ তা ভাঙতে ভাঙতে দ্বিগুণ হয়েছে। জানলাম, এ এক বছরে প্রায় ৪০টি বসতভিটা বিলীন হয়েছে তিস্তায়। এত দীর্ঘ একটা শুকনো মৌসুম গেল, অথচ এখানে ভাঙন ঠেকাতে কী পদক্ষেপ নিল পাউবো?
৪০ বছর আগেও এই তিস্তা ছিল ২ কিলোমিটার প্রস্থের সুজলা নদী। আজ সেই তিস্তা কোথাও কোথাও ১০-১২ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে গেছে৷ ইদানীং চীনের অর্থায়নে যে মহাপরিকল্পনার কথা শুনছি, তার আশ্বাসে কত দিন থাকতে হবে, জানি না। তবে এই ৪০ বছরে কি সরকার পারত না নদীটির যথাযথ পরিচর্যা করে সুপরিকল্পিতভাবে এই ভাঙন প্রতিরোধ করতে?
অবশ্যই পারত। কিন্তু কেন সে উদ্যোগ আজও নেওয়া হলো না, জানি না আমরা, জানে না এখানকার দরিদ্র–নিরীহ মানুষগুলো। তাদের চোখে-মুখে কেবলই হাহাকার আর শেষ সম্বল হারানোর ভয়। কৃষিজীবী এই জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে বাড়ি ভাঙার এসব বেগার খাটুনি খাটতে খাটতে ক্লান্ত। কেউ কেউ গাজীউরের মতোই পরিযায়ী শ্রমিক হয়ে ঘর ছেড়েছেন। সব মিলিয়ে পুরো গতিয়াশ্যাম আজ বিলীনের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা এক হতভাগ্য জনপদ৷ তারা যেন থেকেও নেই, তাদের দেখার কেউ নেই।
স্থানীয় এক স্কুলশিক্ষকের সঙ্গে কথা হলো। বলতে গিয়ে তিনি কেঁদেই ফেললেন, ‘জীবনের সব সঞ্চয় দিয়ে একটা বাড়ি করছিলাম। সেটাও আর রক্ষা করতে পারতেছি না। বহু বছর ধরে ওপর মহলে দৌড়াদৌড়ি করছি। আর কুলাইতে পারি না। কেউ কানে তুলল না আমাদের কথা।’ শুধু তিনি নন, অভিযোগের এই সুর সবার মধ্যে। শোনা গেল, গত বর্ষায় এখানে ১ হাজার ২০০ জিও ব্যাগ ফেলেছিল পাউবো। অপ্রতুল হওয়ায় তাতে কিছুই হয়নি। উল্টো হুড়হুড় করে পানি ঢুকে গ্রামের চারপাশ ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে নদী। এভাবেই তিস্তা এখন তিন–চারটি আলাদা ধারায় সর্বগ্রাসী হয়ে গিলে খাচ্ছে কুড়িগ্রামের রাজারহাটকে। কী জানি, কবে হবে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন? তত দিনে আরও যে কত গ্রাম এভাবে বিলীন হবে তিস্তাবক্ষে!
‘লালসালু’তে রহিমা বিবির একটা উক্তি মনে পড়ছে, ‘ধান দিয়া কী হইবো লোকের জান যদি না থাকে?’ সত্যিই তো, যদি তিস্তাপারই এভাবে বিলীন হতে থাকে, তাহলে তিস্তা মহাপরিকল্পনা হবে কোথায়, কিসের জন্য, কাদের নিয়ে? আমরা মনে করি, বাংলাদেশ সরকারের সাত লক্ষাধিক কোটি টাকার বাজেটে মাত্র দু-এক হাজার কোটির অর্থায়নেই তিস্তার এই করাল গ্রাস থেকে বাঁচতে পারে রাজারহাটসহ গোটা কুড়িগ্রাম।
মহাপরিকল্পনা হোক, তবে আগে জীবন বাঁচুক। অবিলম্বে গতিয়াশ্যাম-নামাভরতের ভাঙনরোধে পদক্ষেপ নেওয়া হোক। অবহেলার ভাঙনে তিস্তায় সব হারানো মানুষের এই ৪০ বছরের হাহাকার পৌঁছে যাক দায়িত্বশীলদের হৃদয়ে। হোয়াংহোর মতোই কান্না ফিরিয়ে নিয়ে প্রমত্ত তিস্তা বয়ে আনুক সম্ভাবনার স্রোতোধারা।
*লেখক: শাফায়াত স্বচ্ছ, আইইআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সদস্য, রিভারাইন পিপল বাংলাদেশ