আওয়ামী লীগ সরকারের সাতকাহন ও আমাদের ভবিষ্যৎ ভাবনা
একাত্তর–পরবর্তী সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী একটি সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশ অভূতপূর্ব একটি ইতিহাসের সাক্ষী হলো। অনেকেই যাকে বলছেন দ্বিতীয় স্বাধীনতা। সত্যিকার স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে, কী হয়নি, তা সময়ই বলে দেবে। আমি এখানে গত সরকারের কিছু সাফল্য ও ব্যর্থতার নিরিখে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করছি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের কী করণীয় হতে পারে, সেই বিষয়ে কিছু ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করছি।
অর্থনৈতিক সূচকে বিস্ময়কর অগ্রগতি
নব্বইয়ে এরশাদ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ পুনরায় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু করে। ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৩৩ বছরকে আমরা মোটাদাগে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। প্রথম ১৮ বছর ১৯৯১ থেকে ২০০৮ এবং পরের ১৫ বছর অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল। প্রথম ভাগে দেখেছি ক্ষমতার কয়েক দফা পালাবদল। দ্বিতীয় ভাগে দেখতে পাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একটানা শাসন। শেখ হাসিনা বুঝতে পেরেছিলেন বারবার ক্ষমতার হাতবদল বাংলাদেশের উন্নতির ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। তাই তিনি দেশের উন্নয়নের লক্ষ্যে ক্ষমতাকে দীর্ঘমেয়াদি ও সুসংহত করার পরিকল্পনা করলেন। এই পরিকল্পনার সুফল আমরা হাতেনাতে পেলাম। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ যে অভাবিত সাফল্য পেয়েছে, তা সত্যিকার অর্থেই একটি সুফল পরিকল্পনার ফসল। ’৯১–পরবর্তী এই দুটি ভাগের একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়। ১৯৯১–এ যখন বিএনপি সরকার দায়িত্ব নেয়, তখন দেশের জিডিপি ছিল ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং সেই অর্থবছরে প্রণীত বাজেটের আকার ছিল সাড়ে ১৫ হাজার কোটি টাকা। ২০০৬ সালে বিএনপি যখন দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতা ছাড়ে, তখন বাংলাদেশের জিডিপি দাঁড়ায় ৭২ বিলিয়ন ডলার ও সেই বছর বাজেটের আকার দাঁড়ায় ৭০ হাজার কোটি টাকায়। প্রথম ১৫ বছরে জিডিপির আকার বৃদ্ধি হয় দ্বিগুণের চেয়ে কিছুটা বেশি এবং বাজেটের আকার বৃদ্ধি পায় সাড়ে চার গুণ। অন্যদিকে ২০০৯–এ আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন জিডিপি ছিল ৯২ বিলিয়ন ডলার এবং ২০২৩–এ তা দাঁড়ায় ৪৫০ বিলিয়ন ডলারে। অর্থাৎ ১৫ বছরে জিডিপি বৃদ্ধি পায় প্রায় পাঁচ গুণ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৬২ হাজার কোটি টাকা অর্থাৎ পরবর্তী অর্ধে বাজেটের আকার বাড়ে প্রায় ১০ গুণ! মানুষের অর্থনৈতিক জীবনযাত্রার মান যদি মাথাপিছু জিডিপি ধরি, সে ক্ষেত্রেও উল্লম্ফনটা চোখে পড়ার মতোই। প্রথম ১৫ বছরে মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে দুই গুণের কম (১৯৯১ সালে ২৮৩ ডলার, ২০০৬ সালে ৫০৩ ডলার) এবং দ্বিতীয় ১৫ বছরে মাথাপিছু জিডিপি বেড়েছে চার গুণ (২০০৯ সালে ৬৩০ ডলার, ২০২৩ সালে ২ হাজার ৫৩০ ডলার)। জিডিপি বৃদ্ধিতে উচ্চহার বাংলাদেশকে তুলে এনেছিল বিশ্বের দ্রুতবর্ধনশীল দেশগুলোর তালিকার প্রথম সারিতে। এই সময়ই বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে। এ ছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণের সূচকেও অগ্রগতি বিগত আওয়ামী সরকারের উল্লেখযোগ্য অর্জন।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন
গত সরকারের আমলে দেখেছি একের পর এক বিশাল আকারের বাজেট প্রণয়ন, যার বেশির ভাগটুকুই বরাদ্দ থাকত উন্নয়ন বাজেট ও সামরিক খাতে। বিগত সরকারের সময়ই বাংলাদেশ এমন সব উচ্চাভিলাষী ও দুঃসাহসিক অবকাঠামোগত উন্নয়ন দেখেছে, যা আগের সরকারগুলো চিন্তাও করতে পারেনি। পদ্মা সেতু নির্মাণ যার সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন। তা ছাড়া ঢাকা মেট্রোরেল, ঢাকা বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, মহেশখালী টার্মিনাল, বে টার্মিনালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধি, ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ অনেক মেগা প্রকল্প সফল বাস্তবায়ন করেছে এ সরকার। দেশের প্রায় সব মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা এবং ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর এই ভূখণ্ডে প্রথমবারের মতো রেললাইন এক্সটেনশনের মাধ্যমে কক্সবাজার ও মোংলাতে রেলসেবা চালু করেছে আওয়ামী সরকার।
অন্য উল্লেখযোগ্য অর্জন
অর্থনৈতিক সূচকগুলোতে তরতরিয়ে এগিয়ে যাওয়া ও অভূতপূর্ব অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়াও বেশ কিছু সামাজিক সূচকেও বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। তা ছাড়া ভারতের সঙ্গে ছিটমহল সমস্যার সমাধান এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমানা নির্ধারণে বড় অর্জন। সাক্ষরতার হার বেড়েছে উল্লেখযোগ্যভাবে। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও উন্নতি হয়েছিল। কমে এসেছিল সাধারণ চুরি ও ছিনতাইয়ের মতো অপরাধগুলো। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও বাংলাদেশ প্রশংসনীয় উন্নতির ছাপ রাখতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া জঙ্গিবাদ দমনে বিগত সরকারের সাফল্যও ছিল চোখে পড়ার মতো।
কিছু সমালোচনা ও কিছু মারাত্মক ভুল
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই ভারত বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতীম দেশ। তা ছাড়া পঁচাত্তর–পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা যখন দেশে আসতে পারছিলেন না, তখন ছয় বছর এই ভারতই তাঁকে আশ্রয় দেয়। তাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী সরকার যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই ভারত তার বন্ধুত্বের হাত দ্বিগুণ প্রসারিত করেছে। ভারতকে ট্রানজিট সুবিধা প্রদানসহ নানা ইস্যুতে হাসিনার সরকার বারবার সমালোচিত হয়েছে। ভারতের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রাখতে গিয়ে এবং অতিরিক্ত গোঁয়ার্তুমির কারণে বিনষ্ট হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক। তা ছাড়া বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তৈরি হওয়া দূরত্বটা এক পর্যায়ে ব্যক্তিগত রেষারেষির পর্যায়ে নিয়ে যান শেখ হাসিনা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈশ্বিকভাবে সমাদৃত ব্যক্তি। তাঁর সঙ্গে এমন রেষারেষি, পদে পদে তাঁকে অপদস্ত করা একটি বড় ভুল ছিল, যে ভুলের মূল্য তাঁকে শেষ পর্যন্ত দিতে হয়েছে।
এত উন্নতির পরও কেন এই জন–অসন্তোষ
মুদ্রার এপিঠ থাকলে তার ওপিঠ থাকবেই। সংগতভাবেই প্রশ্ন আসে, অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগতভাবে এমন অভূতপূর্ব সাফল্যের পরও জনমনে এত অসন্তোষের জন্ম কেন হলো? এর উত্তর নিহিত রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণেই, যেখানে তিনি বলেছিলেন—বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ অধিকার চায়। শেখ হাসিনার অধীন একদিকে যেমন উন্নয়নের পারদ চড়েছে, অন্যদিকে ক্রমেই সংকুচিত হয়েছে নাগরিক অধিকার। অর্থনীতিতে trade off বলে একটি শব্দ আছে, যার অর্থ কোনো কিছু অর্জন করার বিনিময়ে কোনো কিছুকে ছাড় দেওয়া। আওয়ামী সরকার trade off করেছে নাগরিক অধিকারকে। দেশের উন্নয়ন ঘটাতে গিয়ে বারবার ভূলুণ্ঠিত করেছেন মানবাধিকারকে, যার চড়া মূল্য দিতে হয়েছে সরকারকে। বৈশ্বিক মানবাধিকার সূচকগুলোতে বাংলাদেশ ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে এবং আমরা দেখেছি এর ফলস্বরূপ বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশ যুক্তরাষ্ট্রও আমাদের ওপর নাখোশ হয়েছে। সাধারণ অপরাধ কমে গেলেও ক্ষমতা সুসংহত করতে গিয়ে বেড়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা সংস্থাগুলো কর্তৃক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা। এ ছাড়া সাধারণ চোর ও ছিনতাইকারী সবাই দলে দলে ছাত্রলীগে যোগ দিয়ে দেশজুড়ে চাঁদাবাজির প্রাতিষ্ঠানিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার মাধ্যমে কামিয়ে নিয়েছে বিপুল অর্থ। ফলে তাদের রাস্তাঘাটে আর চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাই করার প্রয়োজনই পড়ল না। ছাত্রলীগও পরিণত হলো একটি নির্যাতনকারী সংগঠনে। ২০০৯–এ ক্ষমতায় আসার শুরুতেই রক্তাক্ত বিডিআর বিদ্রোহে মসনদ কেঁপে ওঠে শেখ হাসিনার। তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণভাবে ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষমও হন। কিন্তু সেই বিদ্রোহের প্রকৃত সত্য মানুষ আজও জানতে পারেনি। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে হাসিনা সরকার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটালেও তা ব্যবহার করার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা হলো না। ফলে প্রজন্ম বুঁদ হয়ে রইল ফেসবুক স্ক্রলিং ও টিকটকে। অন্যদিকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন করে হরণ করা হলো মানুষের বাক্স্বাধীনতা। হাসিনা চেয়েছিলেন সবার মতামতকে উপেক্ষা করে দেশের উন্নয়ন করতে। কিন্তু উপেক্ষা করতে করতে এক পর্যায়ে এসে বিরুদ্ধ মতকে এমনভাবে দমন করতে শুরু করলেন, যা গণমানুষের সহ্যসীমাকে ছাড়িয়ে গেল।
অন্যদিকে দেশের ব্যাপক উন্নয়নযজ্ঞ করতে গিয়ে প্রয়োজন পড়ল বিপুল পরিমাণ অর্থ। জাতীয় বাজেটের মূল জোগান আসেই মূলত দুটি খাত থেকে—প্রথমত, অভ্যন্তরীণ উৎস তথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতাভুক্ত কর এবং দ্বিতীয়ত, অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণ। এনবিআর কর্তৃক আদায়যোগ্য করের বোঝা যত বাড়তে লাগল, কর আদায়কারী কর্মকর্তাদের ক্ষমতা ও প্রভাব তত বেড়ে গেল। এসব কর্মকর্তাদের অতি লোভের কারণে পুরো কর ব্যবস্থাই হয়ে পড়ল দুর্নীতিগ্রস্ত। ২০১০ সালে বাংলাদেশ সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ২ লাখ ৭৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ২০২৩ সালে এসে তা দাঁড়ায় ১৮ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকায়, যার মধ্যে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ছিল ৮ লাখ কোটি টাকা। ব্যাংক ও শেয়ারবাজারেও অকল্পনীয় লুটপাটের মাধ্যমে দেশ থেকে হাজারো কোটি ডলার পাচার হয়ে গেল বিদেশে। তৈরি হলো ডলার–সংকট। সম্প্রতি ‘বণিক বার্তা’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাচার হওয়া অর্থের পরিমাণ ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭ লাখ কোটি টাকা! যা কিনা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের প্রায় আড়াই গুণ! ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যের পতন ঠেকানো গেল না কিছুতে, বাড়ল আমদানি খরচ। বাংলাদেশ আমদানিনির্ভর অর্থনীতির দেশ হওয়ায় ব্যালেন্স অব পেমেন্টে সৃষ্টি হলো মারাত্মক ঘাটতি। আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি লাগামছাড়া হলো এবং অর্থনীতি দেখল উচ্চ মূল্যস্ফীতি। ফলে মাথাপিছু জিডিপি বৃদ্ধির সুফল জনগণ পেল না। বরং আয় যত বেড়েছে, খরচ তাঁর চেয়ে বেশি বেড়েছে। মানুষের ব্যবহারযোগ্য আয় গেল কমে। সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগসাজশ করে দুটি ভিন্ন কোম্পানি দেশে ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটপাটে নেতৃত্ব দিয়েছে। সঙ্গে অন্যান্য অসাধু ব্যবসায়ীরা তো ছিলেনই। এর ওপর ছিল দলীয় সুবিধাভোগীদের একের পর এক নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া। তারপর লুটপাট শেষে ওই সব ব্যাংকগুলোকে আবার ভালো ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করার তোড়জোড় শুরু হলো।
দেশের প্রশাসন, পুলিশ, বিচারব্যবস্থা থেকে শুরু করে খেলাধুলা, সংস্কৃতি অঙ্গন—সর্বত্রই দলীয়করণ ও দুর্নীতি মানুষ দেখেছে সাবেক সরকারের সময়ই। দারিদ্র নিরসনে সফলতা পেলেও সরকারের সুবিধাভোগী শ্রেণিগুলো বিপুল সম্পদ অর্জন করে অতিধনী হয়ে যায়। যে কারণে দেশের মোট সম্পদ বাড়লেও হয়নি সম্পদের সুষম বণ্টন। ফলে ধনী–গরিবের বৈষম্য আরও বেড়েছে। দেশে সাক্ষরতার হার বাড়লেও প্রকৃত শিক্ষিত ও সচেতন নাগরিক তৈরি করেনি সরকার। যাঁরা দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা চলে গেছেন। কিন্তু না যেতে পারার সংখ্যা বাড়তে লাগল দিন দিন। দেশে শিক্ষিত বেকার বেড়ে গেল অনেক। বেসরকারি খাতে পর্যাপ্ত চাকরির ক্ষেত্র তৈরি না হওয়ায় সবাই ঝুঁকতে লাগল সরকারি চাকরিতে। কিন্তু সেখানেও কোটা বৈষম্য। এভাবে বৈষম্য, নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হতে হতে যখন মানুষের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল, আর তখনই তাঁরা বারুদের মতো জ্বলে উঠে ঘুরে দাঁড়ালেন।
ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি
১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে জাতীয় দল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় গণতন্ত্রের প্রবর্তন করেন। যার ফলে ফেব্রুয়ারিতে গঠিত হয় বাকশাল এবং জুনে গঠিত হয় বাকশালের কমিটি। কিন্তু তার দুই মাস পরই মৃত্যুবরণ করায় জীবদ্দশায় বঙ্গবন্ধু বাকশাল কার্যকর করে যেতে পারেননি, কিন্তু তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ কী সুনিপুণভাবেই না কার্যকর করলেন তাঁর উত্তরসূরি গণতন্ত্রের মানসকন্যা খেতাব পাওয়া শেখ হাসিনা! বিগত বছরগুলোতে বিরোধী দলগুলোকে দমন–পীড়নের মাধ্যমে তিনি কায়েম করলেন একদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থারই নামান্তর। এই একদলীয় শাসনব্যবস্থার চূড়ান্ত রূপ আমরা দেখলাম চলতি বছরের জানুয়ারির নির্বাচনে। প্রকৃত বিরোধী দলগুলোকে বাদ দিয়ে কিছু পোষ্য বিরোধী দল ও কিছু দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে নির্বাচন করে বিপুলভাবে জয়লাভ করে আবারও ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।
ইতিহাসের কী আশ্চর্য পুনরাবৃত্তি! জানুয়ারিতে একদলীয় গণতন্ত্রের সূচনা করে সেই বছরের আগস্টেই পতন ঘটে বঙ্গবন্ধু সরকারের। আর তার প্রায় ৫০ বছর পর, আরেক জানুয়ারিতে একদলীয় নির্বাচনের মাধ্যমে জোরপূর্বক ক্ষমতা ধরে রাখার সেই বছরের আগস্টেই পতন ঘটল বঙ্গবন্ধুকন্যা হাসিনা সরকারের। বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তা বিপুলভাবে কমে যাওয়ার পেছনে ওনার নিজের দায়টাই সবচেয়ে বেশি। নিজের আশপাশ থেকে তাজউদ্দীন আহমদের মতো বিজ্ঞ ও বিচক্ষণ লোকজনদের সরিয়ে চারপাশ ভরিয়ে তুলেছিলেন চাটুকার ও সুবিধাবাদী লোকজন দিয়ে। ফলে তিনি হয়ে পড়েছিলেন বন্ধু ও সুপরামর্শকহীন। হাসিনার পতনের ক্ষেত্রেও দায়টা পুরোপুরি তাঁর ওপরই বর্তায়। প্রবীণ ও বিচক্ষণ রাজনীতিকদের সরিয়ে দিয়ে তিনি চাটুকার মন্ত্রিসভা, সুবিধাবাদী আমলা, পোষ্য পেশাজীবী ও বিরোধী দল, লোভী ও নীতিহীন ব্যবসায়ী এবং নব্য আওয়ামী লীগারদের দিয়ে চারপাশ ভরিয়েছিলেন। তাই শেষকালের রাজনৈতিক বুদ্ধির খেলায় সুপরামর্শকের অভাবে তিনি একের পর এক চাল হেরে গেছেন। ইতিহাস এভাবেই ফিরে ফিরে আসে।
নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশা আকাশসমান। সে অনুপাতে তাঁদের চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, সহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে একনায়কের পতন ঘটিয়ে সফল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার হার মাত্র ৬ শতাংশ, যেখানে অহিংস আন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতন্ত্রের পথে যাত্রার সাফল্য ৫৭ শতাংশ। অর্থাৎ বর্তমান সরকারের মূল চ্যালেঞ্জ মাত্র ৬ শতাংশ সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এ ছাড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক কারও অবিদিত নয়। সুতরাং আমরা বিশ্বাস করি, তিনি তাঁর এই সুসম্পর্ক কাজে লাগিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিত্রতা বজায় রেখেই তাঁর পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন করবেন এবং সব ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে ভ্রান্ত প্রমাণ করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজই হলো যত দ্রুত সম্ভব দেশে নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি করে সুষ্ঠু একটি নির্বাচন দেওয়া। তবে এই মুহূর্তে জনগণ দ্রুত নির্বাচন দিয়ে কোনোও রাজনৈতিক দলকে আবার ক্ষমতায় বসাতে চান না। বর্তমানে সরকারের কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে—
১. বিগত সরকার অনেক উন্নয়ন প্রকল্প নির্মানাধীন রেখে গেছে। বর্তমান সরকারের কাজ হবে নতুন কোনো উন্নয়ন প্রকল্প হাতে না নিয়ে নির্মানাধীন প্রকল্পগুলো চলমান রাখা।
২. আওয়ামী সরকারের রেখে যাওয়া ঋণের বোঝা কমানোর জন্য সচেষ্ট থাকা। প্রয়োজনে ঋণ পুনঃতফসিলিকরণ অথবা ঋণ পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিকল্প ফান্ডের ব্যবস্থা করা।
৩. ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য না বাড়িয়ে রেমিট্যান্সের প্রবাহ বৃদ্ধি করা এবং আগামী কয়েক মাস নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাদে অন্যান্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা।
৪. বিদেশে পাচার করা ডলারের যতটুকু সম্ভব ফেরত আনার ব্যবস্থা নেওয়া।
৫. ব্যাংকিং খাত ও শেয়ারবাজারে স্বচ্ছতা আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া।
৬. বাজেটে উন্নয়ন ও সামরিক খাতে বরাদ্দ কমিয়ে, শিক্ষা ও গবেষণা খাতে বাজেট বাড়ানো।
৭. স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি দূরীকরণে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ।
৮. সব বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখা, কিন্তু কাউকে বাড়তি সুবিধা দিতে গিয়ে নিজেদের ঝুঁকিতে না ফেলা।
৯. দেশে জঙ্গিবাদ ও ধর্মীয় মৌলবাদ আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। জঙ্গিবাদ দমনে সর্বোচ্চ কঠোরতা অবলম্বন করতে হবে।
১০. ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা এবং একই সঙ্গে ছাত্রাবস্থায় নেতৃত্ব তৈরির জন্য অরাজনৈতিক বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১১. দেশে শুধু সাক্ষরতা নয়, বরং প্রকৃত শিক্ষিত, সচেতন ও দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার জন্য সঠিক শিক্ষানীতি প্রণয়ন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস সবার শ্রদ্ধাভাজন। তিনি সব সময় ছাত্রশক্তিকে উদ্বুদ্ধ করেন এবং তরুণদের নিয়ে কাজ করতে চান। ছাত্র–তরুণদের সঙ্গে নিয়ে নতুন একটি বাংলাদেশ গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় তিনি সফল হবেন বলেই আমাদের বিশ্বাস।
লেখক: আসিফ তানভীর, ফেলো সদস্য, দ্য ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশ,
*নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]