ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ড
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
ইফতি আহমেদ আর নবনীতা স্বামী-স্ত্রী। তাদের বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো। ইফতি আহমেদ ভালোবেসে নবনীতাকে ‘নবনী’ বলে ডাকে। দুজনেই গ্রাজুয়েট হলেও নবনীতা ভার্চ্যুয়াল জগতে খুবই দক্ষ। অপর দিকে ইফতি সেখানে ছাত্র মাত্র। ইফতি একসময় নিয়মিত রেডিও শুনত। টেলিভিশনে ফুটবল বিশ্বকাপ, বাংলাদেশ দলের ক্রিকেট ম্যাচ, শুক্রবারের বাংলা ছায়াছবি প্রভৃতি দেখার জন্য বাজার পর্যন্ত যেতে হতো ইফতির সমবয়সীদের। এরপর পাশের গ্রাম, পাশের গ্রাম থেকে পাশের বাড়ি, সাদা–কালো থেকে রঙিন...। বলা চলে দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এই তো সেদিন ইফতিদের ঘরে টিভি ঢুকেছে, রক্ষণশীল মা-বাবাকে অনেক কষ্টে ম্যানেজ করার পর। কিন্তু হঠাৎ সবকিছু বদলে দিয়ে এলোমেলো করে দিল ‘স্মার্টফোন’!
টিভি, রেডিও, ক্যামেরা, ঘড়ি থেকে শুরু করে মানুষের সমস্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় এবং বিলাসী যন্ত্র যেন একলহমায় গিলে খেয়ে নিল স্মার্টফোন নামের একটিমাত্র ডিভাইস! এরপর সেই পালে অন্য রকম হাওয়া দিল ইউটিউব এবং জাকারবার্গের ফেসবুক। তবে প্রথম দিকে শিক্ষিত হয়েও অনেকে মোবাইল, ইন্টারনেট ইত্যাদি ব্যবহারে ছিল খুবই কাঁচা। কল রিসিভ আর কল দেওয়া ছাড়া অনেকে কিছুই বুঝত না। অনেকে আবার বুঝতেও চায় না। এমন ন্যাকামো করে, মনে হয় এর ভেতরে সাপ আছে! আবার দেখা যায় একেবারে অশিক্ষিত হয়েও ভার্চ্যুয়াল জগতে এতটা দক্ষ যে অবাক না হয়ে পারা যায় না।
ইফতি প্রথম দলে পড়ে। কিন্তু আগ্রহ আছে শেখার। একটা স্মার্টফোন কিনে নবনীতার সহায়তায় একটা ফেসবুক আইডি খুলে নিয়ে সময় পেলেই হারিয়ে যাচ্ছে ভার্চ্যুয়াল জগতে। যেখানেই কোনো সমস্যা হয় বা নতুন কিছু দেখে,Ñনবনীতার সহায়তা নেয়। একদিন অফিসের কাজের ফাঁকে ফেসবুকে ঢুঁ মারতেই ইফতির চোখে পড়ল পরপর কিছু ছবি। পাশে ইংরেজি হরফে লেখাÑ‘পিপল ইউ মে নো’। কয়েকটি ছবি অতিক্রম করে যেতেই একটি ছবিতে চোখ আটকে গেল ইফতির। না, ছবিটি কোনো মেয়ের নয়,Ñছেলের, যার নাম আফনান খান। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ছবিটির ওপর আলতো আঙুল ছোঁয়াতেই বিস্তারিত ভেসে ওঠে। ছেলেটির ছবির নিচে লেখা ‘ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ এবং সঙ্গে খুবই ছোট্ট একটি ছবি। এত ছোট যে স্পষ্ট বোঝা যায় না। তারপরও ছবিটি দেখে প্রথমেই একটা ধাক্কা খায় ইফতি। এবার আফনানের প্রোফাইল রেখে ছবিটির ওপর টাচ করতেই নবনীতার ছবি ভেসে ওঠে। এবার ‘আফনান’ নামটা মনে পড়ে ইফতির। স্মৃতি ইফতিকে নিয়ে দাঁড় করায় দুই বছর আগেরকার কোনো এক দিনে। যখন নবনীতাও ইফতির বিয়ে হয়নি। কেবল রিলেশনশিপে জড়িয়েছে দুজনে। নবনীতা একটা কোম্পানিতে চাকরি করত। অপর দিকে ইফতি চাকুরি খুঁজছে হন্যে হয়ে।
নবনীতা ও ইফতির মধ্যে মুঠোফোনে কথা হচ্ছিল একদিন। ‘জানো, আমাদের এক স্যার আছে, নাম আফনান খান’ নবনীতা বলে।
‘এই তো জানলাম।’ ভারী কণ্ঠে জবাব দেয় ইফতি।
আমার সহকর্মী অবন্তি, স্যারের বড় ভক্ত। বলে কী, ‘বিয়েটা করে ভুল করেছি। না হলে আফনান স্যারকে প্রেমের প্রস্তাব দিতাম।’
বুঝলাম, তাতে তোমার কী? আর আমাকে এসব কথা বলার কারণ?
এমনি। স্যার খুব হ্যান্ডসাম তো, যেকোনো মেয়ে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাবে।
ফাজলামো বাদ দাও রাখি।
ইফতি জানে, নবনীতাকে রাগানোর জন্যই শেষের দুই লাইন বাড়িয়ে ওভাবে বলেছে। তারপরও ইফতির কাছে বিষয়টি ভালো লাগেনি। এরপর নবনীতার সঙ্গে আফনান স্যার সম্পর্কে আর কখনো কোনো আলাপ হয়নি ইফতির। আফনান নামটাও আর মনে নেই। ছবিতে আজ প্রথম দেখল। ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ডের বাংলা প্রতিশব্দ নিয়ে ভাবল না ইফতি। আসলে আফনানের ছবির নিচে লেখা ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ড, আর সেই ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ড তার স্ত্রী নবনীতা,Ñএ কথা মানতে পারল না সে। প্রথম দিন আফনান সম্পর্কে নবনীতার সঙ্গে কথোপকথনের সময় চাপা অভিমানটা যেখানে শেষ হয়েছিল, সেখান থেকেই আজ আবার এত বছর পর জেগে উঠল। ধীরে ধীরে মাথাটা গরম হচ্ছিল একই সঙ্গে।
ফেসবুক রেখে সঙ্গে সঙ্গেই নবনীতাকে ফোন করল ইফতি।
‘হ্যালো।’ নবনীতা ওপাশ থেকে বলে।
‘আফনান-টা কে?’ উত্তেজিত হয়ে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়ে দেয় ইফতি।
‘মানে?’ কিছুটা চমকে যায় নবনীতা।
‘বাংলা বোঝো না? বলছি আফনান-টা কে?’ ইফতির কণ্ঠ থেকে রাগ ঝরে পড়ে।
এবার নবনীতা একটু সময় নিয়ে বলে, ‘ও, তুমি আফনান স্যারের কথা বলতেছ? উনি তো আমার অফিসের বস ছিলেন। তোমাকে তো বলেছিলাম একদিন স্যারের কথা।’
বুঝলাম। কিন্তু ওনার একজন মাত্র ‘মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’। আর সেই একজন তুমি, কেন?
মিউচুয়াল ফ্রেন্ড মানে তো...
না, আমি মানেটানে কিছুই শুনতে চাই না। তুমি এখন ওনাকে আনফ্রেন্ড করবা।
আসলে তুমি বুঝতেছ না...
না, আমি বুঝতে চাই না। তুমি লোকটার একমাত্র মিউচুয়াল...এখনই আনফ্রেন্ড করবা।
আমার কথাটা শেষ করতে দাও।
শেষটেস বুঝি না। আনফ্রেন্ড করবা বলছি, আনফ্রেন্ড করবাÑব্যাস।
‘আচ্ছা আনফ্রেন্ড করে দিচ্ছি।’ স্বামীকে বুঝাতে না পারার হতাশা ঝরে পড়ে নবনীতার কণ্ঠে।
দুজনের দীর্ঘদিনের জানাশোনার পর বিয়ে। ইফতি ও নবনীতা দুজন দুজনকে খুব বিশ্বাস করে। তবুও ইফতি ‘ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’–এর ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছিল না। সেদিন ওই পর্যন্তই শেষ হয়। ইফতি আর কখনো জানতে বা দেখতেও চায়নি আফনানকে নবনীতা আনফ্রেন্ড করেছে কি না। দিন যেতে যেতে ভার্চ্যুয়াল জগতে ভালোই অভিজ্ঞ হয়ে ওঠে ইফতি। প্রথম প্রথম ইফতির ফেসবুক ফ্রেন্ডলিস্টে শুধু ওর প্রকৃত বন্ধুরাই ছিল। এখন বন্ধুর অভাব নেই। কিছুদিন শিক্ষকতা পেশায় ছিল ইফতি। তাই অনেক ছাত্রের কাছ থেকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে। ইফতি অনেক দিন ঝুলিয়ে রেখেছিল সবাইকে। রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেনি। ইফতির মতে ছাত্র আবার বন্ধু হয় কী করে! পরে সে ভাবে, ছাত্ররা হয়তো ভাববে স্যার অহংকারী। তাই শেষমেশ সবার রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিয়েছে।
একদিন মোবাইল স্ক্রল করতে করতে ইফতির অফিসের বিগ বসের কাছে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট চলে যায়। এতে ও একটু ঘাবড়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই দেখে, বস রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে নিয়েছে। ইফতি এখন বুঝতে শিখেছে, সত্যিকার জীবনের ফ্রেন্ড আর ভার্চ্যুয়াল জগতের ফ্রেন্ড এক নয়। এখন কোনো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পেলে যদি দেখে লোকটির সঙ্গে তার ১০–এর ওপরে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড আছে,Ñতাহলে বিস্তারিত না দেখেই চোখ বুজে রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে, ফ্রেন্ড করে নেয়। আর তখন আফনানকে নিয়ে নবনীতার সঙ্গে ‘ওয়ান মিউচুয়াল ফ্রেন্ড’ রাগটার কথা মনে পড়ে। সেই সময় সেদিনের অজ্ঞতার জন্য মনে মনে লজ্জা পেয়ে যায় ইফতি।
*লেখক: ইয়াসিন আযীয, রূপনগর, পালং সদর, শরীয়তপুর।