সিআরএফের আনন্দ সম্মিলন, প্রকৃতির সান্নিধ্যে অনন্য এক দিন

সন্ধ্যা-সকাল কুয়াশার চাদরে মুড়ে দিচ্ছে পৌষের শীত। মন ছুঁয়ে যাওয়া শীতের শুভ্রতায় ফুরফুরে মনটা একেবারেই ঘোরার মেজাজে। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা–বাগানে চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরামের (সিআরএফ) আনন্দ সম্মিলনের আয়োজন করা হয়েছিল গত বুধবার (২৫ ডিসেম্বর)। তখন সকাল প্রায় আটটা। সকালের স্নিগ্ধ রোদ এসে পড়েছে কর্ণফুলীর বুকে। একটু পরেই নদীর দুই পাড়ের অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে দেখতেই আমরা এগিয়ে যাব রাঙ্গুনিয়ার দিকে। ফোরাম সদস্যদের কয়েকজন এলেও বেশির ভাগ সংবাদকর্মী তখনো আসেননি। তবে সময় একটু গড়াতেই যাত্রীরা একে একে উপস্থিত হতে থাকেন নগরের অভয় মিত্র ঘাটে। ফিরিঙ্গিবাজার ব্রিজঘাটটায় তখন মাঝিদের হাঁকডাক। নদী পারাপার হতে ধীরে ধীরে বাড়ছে যাত্রীদের ভিড়। অবশেষে সকাল নয়টায় ঘাট ছাড়ল আমাদের ইঞ্জিনচালিত নৌকা।

যাত্রা শুরু করতেই মনে পড়ে গেল কবি সুনির্মল বসুর বিখ্যাত সেই কবিতা—‘নৌকা চলে নৌকা চলে/ মাঝ-নদীতে অথই জলে/ বৈঠা মারি মাল্লা মাঝি/ ‘বদর বদর’ চেঁচায় আজি/ সবাই মিলে হল্লা তোলে;/ নৌকা চলে, নৌকা চলে।/ রইল দূরে কূল কিনারা/ পল্লীখানি ঝাপসা-পারা, ঝপাস ঝপাস-শব্দ জলে;/ নৌকা চলে নৌকা চলে।’ নদীর বুকে পানকৌড়ির দল আর ছুটে চলছে মাছরাঙা কিংবা বক। জাল নিয়ে ছুটে চলছে কিছু ডিঙিনৌকা। বালুর নৌকা, মাছের ডিঙি, সাম্পান, কোসানৌকাও চোখে পড়ছে বেশ। এদিকে স্পিকারে মিলন আচার্যের কণ্ঠে তরঙ্গায়িত হয়ে উঠল প্রয়াত শিল্পী সঞ্জিত আচার্যের বিখ্যাত সেই গান—‘বাঁশখালী মইষখালী পাল তুলিয়া দিলে সাম্পান গুড়গুড়াই টানে’। তারপর জনপ্রিয় সব গানে উজ্জীবিত আসর। একে একে গান পরিবেশন করেন মিলন আচার্য ও সুপ্রিয়া লাকী। বেলা সাড়ে ১১টায় সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্বে অংশ নেন চট্টগ্রাম রিপোর্টার্স ফোরামের সভাপতি আবুল মনসুর, সাধারণ সম্পাদক আলিউর রাহমান, বনভোজন কমিটির চেয়ারম্যান লোকমান চৌধুরী, সদস্যসচিব কামাল পারভেজ, ফোরাম সদস্য সাংবাদিক সাইফুল্লাহ চৌধুরী, আইয়ুব আলী, আলী আহমেদ শাহীন, মোহন মিন্টু, নূর মোহাম্মদ রানা প্রমুখ।

এদিকে গানের ফাঁকে ফাঁকে নিজ পেশার বন্ধুদের সঙ্গে আবেগ-উচ্ছ্বাস আর ভালোবাসা বিনিময় পর্ব জমে ওঠে নৌকায়। আনন্দ-আড্ডায় মেতে উঠেছিলেন সংবাদকর্মীরা ও তাঁদের পরিবার। দুপুর সাড়ে ১২টায় নির্ধারিত গন্তব্য রাঙ্গুনিয়ার কোদালা চা–বাগানে পৌঁছে ছবি তোলাতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন সবাই। চা–বাগানের সৌন্দর্য উপভোগে দল বেঁধে বেরিয়েও পড়েন অনেকে। চা–বাগানের আশপাশে চোখ পড়তেই দেখা গেল চারদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। অসাধারণ সুন্দর বাগানের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা পিচঢালা পাহাড়ি পথ। এ রকম অসাধারণ নৈসর্গিক সৌন্দর্য অবলোকনে দল বেঁধে ঘুরতে ব্যস্ত সবাই। প্রাণে প্রাণ মিলেমিশে থাকার বন্ধুত্বের এমন আবেগ আর উচ্ছ্বাস বুঝিয়ে দিল বাঁধন আলগা হয়নি মোটেও। এভাবে ম্যারাথন আড্ডা আর ছবি তোলায় কেটে যায় প্রায় এক ঘণ্টা।

দুপুরের খাবার পর্ব শেষে শুরু হয় আকর্ষণীয় র‌্যাফেল ড্র। এ পর্ব শেষে আবারও নিজ গন্তব্যে ফেরার প্রস্তুতি। বিকেল চারটায় নৌকায় আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পালা। শিল্পীদের কণ্ঠে উঠে আসে ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা’সহ পরিচিত সব গান। এ সময়ে সুরের মূর্ছনায় মেতে ওঠে চারপাশ। গান ও নৃত্যের জমজমাট সমাহার মুগ্ধতা ছড়ায় দর্শক-শ্রোতাদের মনে। জনপ্রিয় সব গানে আসর মাতান শিল্পী মিলন আচার্য, সুপ্রিয়া লাকী, সাইফুল্লাহ চৌধুরী, রাজিব সেন প্রিন্স, অনুজ দেব বাপু, ডা. সায়মা, জাহাঙ্গীর আলম প্রমুখ।

সূর্য অনেক আগেই হেলে পড়েছে পশ্চিমের দিকে। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে কর্ণফুলীর বুকে। কিন্তু নৌকা তখনো চলছে গন্তব্যের দিকে। অবশেষে প্রায় সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় নোঙর করল নৌকা। অন্যদিকে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের কয়েক ঘণ্টার মিলনমেলা ভেঙে সবার বিদায় নেওয়ার পালা। গন্তব্যে ফেরার আগে ফোরামের সদস্যদের কণ্ঠেও তাই রাবীন্দ্রিক সুর—যখন ভাঙল মিলনমেলা/ ভেবেছিলুম ভুলব না আর চক্ষের জল ফেলা/ দিনে দিনে পথের ধুলায় মালা হতে ফুল ঝরে যায়...।

লেখক: অনুজ দেব বাপু, সাংবাদিক

* নাগরিক সংবাদ-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]–এ