সমাজে যৌথ পরিবারের ভবিষ্যৎ কী?

ছবি: এআই/প্রথম আলো

বিশ্ব পরিবার দিবস আজ। প্রতিবছর ১৫ মে দিবসটি পালন করা হয়। ১৯৯৩ সালে বিশ্বজুড়ে পরিবারের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে ও পরিবারের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘ ১৫ মে বিশ্ব পরিবার দিবস পালনের ঘোষণা করে। উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় পরিবারের গুরুত্বের ওপর সর্বস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্য নিয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে দিবসটি পালন করা হয়। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো ‘টেকসই উন্নয়নে পরিবার কেন্দ্রিক নীতি: সামাজিক উন্নয়নে দ্বিতীয় সম্মেলনের দিকে যাত্রা।’

নৃবিজ্ঞানী ওয়েস্টার মার্ক বলেছেন, পরিবারই মানবসমাজের আদি সামাজিক সংগঠন। বেঁচে থাকার তাগিদ, যৌন প্রবৃত্তি, মানসিক আবেগে পরিবারের জন্ম হয়েছে বলে অনেকের ধারণা। জানা যায় সভ্যতার শুরুর দিকে মানুষ দলবেঁধে গুহায় বাস করত, সেটাই ছিল পরিবার। এক একটা গুহায় এক একটা পরিবার। স্থানভেদে গুহার ধরন ছিল ভিন্ন। ফলে পরিবারের গঠন প্রকৃতিও ছিল আলাদা। আশপাশ থেকে জীবনরসদ সংগ্রহের তালিকা ভিন্ন তো পরিবারে সমৃদ্ধির রূপও ভিন্ন। যে অঞ্চলে জীবনরসদ সহজলভ্য ছিল, সেখানে পরিবারে স্বাচ্ছন্দ্য ছিল। পরবর্তীকালে বুদ্ধিমত্তা ও পেশিশক্তির পার্থক্যে গুহা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বৈষম্য গড়ে ওঠে। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে সংঘাতের জন্ম নেয়। ফলে পরিবারের কাঠামোতে পরিবর্তন আসে। সেই পরিবর্তনের ধারা আজও অব্যহত আছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, মানব সভ্যতার আদি মাতৃভূমি খ্যাত আফ্রিকার কাভাগোনা নদীর পাড়ে হাডার অঞ্চলের এক গুহায় মানুষের প্রথম স্থায়ী আবাসের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। সে সময় গুহা-পরিবারে বহুবিবাহ প্রথা চালু ছিল। গুহা-পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটা শক্ত বন্ধন ছিল। গুহায় গুহায় বড়সড় মানব দল নিয়ে গঠিত সেই যৌথ পরিবার অধুনা সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

কালের স্রোতে মানুষের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটেছে। সম্পদের সংজ্ঞা পাল্টেছে। বুদ্ধির নিরিখে মানুষে-মানুষে পার্থক্য তৈরি হয়েছে। বুদ্ধিকে সম্বল করে মানুষ তার অধিকারকে বুঝে নিতে শিখেছে। ভোগ-সুখের জন্য গোষ্ঠীসত্তা থেকে ব্যক্তিসত্তাকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আস্ত যৌথ পরিবার ভেঙে ছোট ছোট পরিবার হয়ে হয়ে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে গেছে নানা অঞ্চলে। অর্থাৎ মানুষ নিজস্বতা খোঁজার তাগিদে এক পরিবার ভেঙে একাধিক পরিবার গঠন করেছে। এ ছাড়া যান্ত্রিক সভ্যতার মোড়কে চাহিদাকে প্রশ্রয় দিতে গিয়ে ছোট পরিবার ভেঙে ব্যক্তি-পরিবারে ঢুকে পড়েছে। ফলে পরিবার শব্দের উপস্থিতি অনেকটা অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে।

অনেকের মতে, পরিবারের ধরন নির্ভর করে কোনো অঞ্চলের ভৌগোলিক পরিবেশের ওপর। যেমন পৃথিবীর দুর্গম অঞ্চলে আজও যৌথ পরিবার দেখা যায়। এ অঞ্চলের মানুষ প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে একসঙ্গে থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করে। উত্তর নরওয়েতে বা সাহারা মরুভূমিতে জনবসতিতে সবাই যৌথ পরিবারের কাঠামো দেখা যায়। আবার বালিঝড়কে মোকাবিলা করতে সাহারাবাসীরা নিজের পরিবারের সদস্যদের অধিক বিশ্বাস করেন। এদিকে ভারতের অরুণাচল প্রদেশের দুর্গম অঞ্চলের আপাতনি সম্প্রদায়ের সঙ্গে বা উত্তর সিকিমের খাসি জনগোষ্ঠীর সদস্যদের যৌথ পরিবারের প্রতিই অধিক আস্থা রয়েছে। আসলে ওই সব প্রতিকূল পরিবেশে মনোবল বাঁচিয়ে রাখার ভিত্তি হলো যৌথ পরিবার। আবার দেখা যায় আন্দামান-নিকোবর দ্বীপে নিকোবরিদের যৌথ পরিবার। পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে পরিবারের সবার শ্রমদানের প্রয়োজনই ভাঙতে দেয়নি সেই পরিবারকে।

আর বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক সমাজ যৌথ পরিবারকে টিকিয়ে রাখার পেছনে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। আসলে যৌথ পরিবার হলো একটি বটবৃক্ষের মতো, যেখানে সুবিধা একক পরিবারের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। যৌথ পরিবারে বিপদে-আপদে অনেককে পাশে পাওয়া যায়। সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়া যায়। এ ছাড়া সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ এবং শিশুর মানসিক বিকাশেও একক পরিবারের চেয়ে যৌথ পরিবারের অবদান বেশি। এ ধরনের পরিবারের সদস্যদের একে অপরের প্রতি অগাধ ভালোবাসা, আদর-স্নেহ ইত্যাদি সবসময় অটুট থাকে।

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়-মা-বাবা, ভাইবোন, চাচা-চাচি, দাদা-দাদি নিয়েই পরিবার। মানুষ যৌথ পরিবারে বাস করার কারণেই হয়তো পরিবারের সংজ্ঞা এভাবে করা হয়েছিল। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে এখন সেই চিত্র বদলে যাচ্ছে। শুধু মা-বাবা আর সন্তান মিলেই হচ্ছে পরিবার। অথচ সমাজজীবনে যৌথ পরিবারের ভূমিকা ব্যাপক। যৌথ পরিবার প্রথার নানা সুবিধা থাকা সত্ত্বেও তা ভেঙে অনু পরিবারের জন্ম হচ্ছে। অনেকের ধারণা বিশ্বায়ন ও তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ যৌথ পরিবার ভাঙার অন্যতম কারণ। বিশ্বায়নের ছায়ায় বহির্মুখী মন, ঘরের দুয়ার খুলে বাইরে এনে দাঁড় করিয়েছে। পেছনে পড়ে আছে যৌথ পরিবার। যৌথ পরিবারের ভিতে ফাটল ধরেছে ও স্বার্থসুখে আত্মমগ্ন হয়ে উঠেছে মানব সমাজ। পৃথিবী যত এগিয়ে যাচ্ছে, যৌথ পরিবার তত কমে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে যৌথ পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য; সেই সঙ্গে সামাজিক বন্ধন। পর্যবেক্ষণ বলে, অতীতের সব যৌথ পরিবারের একটা নিজস্ব সংস্কৃতি ছিল, যাকে সম্বল করে সবাই বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় মনের তাগিদে বা পরিবারের ঐতিহ্য বা একতা প্রতিষ্ঠা করতে এক জায়গায় জমায়েত হতো। তা সে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে অবলম্বন করেই হোক, বা বিশেষ কোনো খেলাধুলাকে কেন্দ্র করেই হোক বা ধর্মীয় তিথি-পার্বনে। এই জমায়েত হওয়াটাই যৌথ পরিবারের অস্তিত্বের মূল শিকড়। এসব কারণে আজও স্বল্প পরিসরে হলেও যৌথ পরিবার দেখতে পাওয়া যায়।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, যৌথ পরিবার আর সমাজে ধরে রাখা সম্ভব না। তবে আমরা চেষ্টা করতে পারি। যেমন জাপানে যৌথ পরিবারের সংখ্যা বেশি। সেখানে বিশ্বায়নের প্রভাব আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। এরপরও তারা এটা ধরে রেখেছে এবং এর সুফলও ভোগ করছে। সেখানে রাষ্ট্রীয়ভাবে যৌথ পরিবার ধরে রাখার জন্য উৎসাহিত করা হচ্ছে। বর্তমান সময় আধুনিক নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, কর্মসংস্থানসহ নানা কারণে যৌথ পরিবার ভেঙে একক পরিবার হচ্ছে। মূলত আর্থসামাজিক উন্নতি, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, নগরায়ণ, শিল্পায়ন, শিক্ষার প্রসার, সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের পরিণতিতে যৌথ পরিবার ধীরে হলেও ভেঙে পড়তে বাধ্য।

সমাজবিজ্ঞানী অ্যালিস ইভান্স বলেন, ভারত ও বাংলাদেশে এখনও অনেকে যৌথ পরিবারে বসবাস করার পেছনে পারিবারিক ব্যবসা এবং চাকরি বা পেশায় নারীদের অপেক্ষাকৃত কম অংশগ্রহণ বড় ভূমিকা রাখছে। তিনি মনে করেন, এসব কারণে পরোক্ষভাবে পরিবারের মধ্যে শক্ত বন্ধন তৈরি হয়। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি যার ফলে অনেকে বাধ্য হয়েই যৌথ পরিবারে আটকে থাকে। গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশে পরিবারের গড় আকৃতি ছোট হয়ে আসা, যুবকদের একটু বেশি বয়সে বিয়ে করা নারীদের মা হওয়ার বয়স বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার হ্রাস, দম্পতিদের কম সন্তান নিতে পছন্দ করা ইত্যাদি কারণে যৌথ পরিবারের স্থলে একক পরিবার প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। অনেকের মতে, চলমান শতাব্দীতে পরিবারের বাইরে কর্মসংস্থান, গ্রাম থেকে শহরে অভিবাসন এবং নারীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধির পরে দেশে যৌথ পরিবার ভেঙে পড়ছে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় বর্তমানে দেশে নগর জনসংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ। গত দুই দশকে নগরায়ণ, শিল্পায়ন, দারিদ্র্য, বেকারত্ব ও উন্নত জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষায় অনেক মানুষ গ্রাম থেকে শহরে এসেছে। এদিকে গ্রামগুলোয় যে পরিবারগুলো ছিল, তার ধারণাও পাল্টে গেছে। ফলে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছি যৌথ পরিবারের সুবিধা, ঐতিহ্য এবং সেই সঙ্গে সামাজিক বন্ধন। ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তরিকতা, মমতা, স্নেহ, ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ কমে যাচ্ছে। জরিপ অনুযায়ী বাংলাদেশের যৌথ পরিবারের সংখ্যা এখন ১০ শতাংশে নেমে আসছে। বিবিএস প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে মোট পরিবার সংখ্যা ৪ কোটি ১০ লাখ ১০ হাজার ৫১ জন এবং খানার গড় আকার ৪ জন। এক দশক আগে খানার সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ২১ লাখ ৭৩ হাজার ৬৩০ জন। পরিবারের আকার ছিল সাড়ে ৪ জন। অর্থাৎ পরিবারের আকার ছোট হচ্ছে। পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে ৮৮ লাখ ৩৬ হাজার ৪২১টি। ঢাকার মতো রাজশাহীতেও ছোট হচ্ছে পরিবারের আকার যা মাত্র ৩.০৮ জন। এছাড়া রংপুরে পরিবারের আকার ৩.০৯, খুলনায় ৩.০৯, বরিশালে ৪.০১, চট্টগ্রামে ৪.০৪ এবং ময়মনসিংহে ৪ জন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে খানা বা পরিবার প্রতি জনসংখ্যা ৪–এর নিচে।

যৌথ পরিবার ভেঙে এখন একক পরিবার রূপান্তরের বিষয়টি বৈশ্বিক। তবে অনেকের ধারণা একটা সময় আসবে, যখন কর্মজীবী দম্পতিরা যৌথ পরিবারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবে। কারণ, ইদানীং শহরের বাসাবাড়িতে কাজের জন্য গৃহকর্মীর বেশ সংকট লক্ষ করা যাচ্ছে। ভবিষ্যতে গৃহকর্মী না পাওয়া গেলে ইউরোপ-আমেরিকার মত নিজের কাজ নিজেকেই করতে হতে পারে। ফলে বাধ্য হয়েই কর্মজীবী দম্পতিকে যৌথ পরিবার ব্যতীত তাদের সন্তানদেও সঠিকভাবে লালন পালন হয়তো সম্ভবপর হয়ে উঠবে না। বিষয়টি সমাজবিজ্ঞানীদের চিন্তার খোরাক জোগাতে পারে।

*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর