হঠাৎ আকাশে ভীষণ কালো মেঘ জমেছে। চারদিকটা ঘন অন্ধকার হয়ে আসছে। আসমান থেকে মেঘেদের কর্কশ গর্জন ভেসে আসছে! সূর্যটা মেঘেদের রাজ্যে তলিয়ে গেছে। চারদিকে প্রবল বেগে বাতাস বইছে। পথিক নিজ গন্তব্যে ছুটে চলেছেন। সড়কপথে বিভিন্ন পরিবহন নিজ গতিতে ছুটে চলছে‚ ওয়েটিং রুমটা যাত্রীশূন্য হয়ে আছে‚ সবকিছু কেমন যেন নীরব–নিস্তব্ধ হয়ে আছে। শহরজুড়ে যেন আজ নীরবতা দিবস চলছে। কেউ কেউ বলছে, আজ নাকি দুর্দমনীয় ঝড় হবে। অনেক অঞ্চল নাকি পানি উঠে তলিয়ে গেছে। কিন্তু এই ঝড়ঝাপটা নিয়ে আবির হাসানের কোনো উচ্ছ্বাস নেই। তিনি চিন্তিত তার দাদাজানকে মন ভরে শেষবারের মতো দেখা নিয়ে। মিনিট দশেক আগে গ্রামের বাড়ি থেকে আসা একটা ফোনকলের মাধ্যমে তার দাদার মৃত্যুর সংবাদ জানলেন।

আবির হাসান সংবাদ শোনামাত্রই তার স্ত্রী রাহেলাকে ফোন করে জানিয়ে দিলেন দাদার মৃত্যুর কথা। আর এটাও জানিয়ে দিলেন যে তিনি গ্রামের বাড়ির দিকে যাচ্ছেন। রাহেলা ও মুনিরাকেও গাড়ি নিয়ে রওনা দিতে বললেন। যদিও রাহেলা অনুরোধ ও অভিযোগ মেশানো গলায় বারবার বলছিল, ‘আপনি না বাজারে গেলেন? জামাকাপড় চেঞ্জ না করেই পাগলের মতো যাচ্ছেন। তা ছাড়া আমরা তো এক গাড়িতেই যেতে পারি। আপনার একা আগে যেতে হবে কেন?’

আবির হাসান সত্যি পাগলের মতো হয়ে গেছেন। দাদাকে দেখার জন্য মন বেশ ছটফট করছিল, তাই হয়তো রাহলার কথার অনুরোধ রাখতে পারলেন না। একা একাই আগে যেতে লাগলেন। আবির হাসান ভীষণ শান্তশিষ্ট স্বভাবের মানুষ। টাকাপয়সার পাহাড় থাকার পরও মনে কোনো অহংকার বা হিংসা নেই। খুব সাধারণভাবে চলাফেরা করেন। গ্রামের লোকেরা তার আচার-আচরণের ভীষণ ভক্ত। মা–বাবার একমাত্র সন্তান তিনি। আপন দ্বিতীয় কোনো ভাইবোন নেই। ব্যবসার জন্য পাঁচ বছর ধরে গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় থাকেন। মা-বাবা থাকেন গ্রামে। চার বছর বয়সের মুনিরা তার একমাত্র রাজকন্যা। মুনিরা খুব চঞ্চল। গ্রামের ছোট্ট ছেলেমেয়েরা ভীষণ ভক্ত তার।

আবির হাসান ঢাকা বিমানবন্দর থেকে বিমানে উঠে তার জেলা শহরে পৌঁছে গেছেন। জেলা শহর থেকে একটা মোটরবাইক ভাড়া করে গ্রামের বাড়ির দিকে যেতে লাগলেন। ধীরে ধীরে মোটরবাইক শহরের দালানকোটা পার হয়ে গ্রামের সবুজ বনজঙ্গলের দিকে যেতে লাগল। আবির হাসান সবুজ ঘন বনজঙ্গলের দিকে তাকিয়ে মনে করতে লাগলেন শৈশবের কথা। কত সুন্দর ছিল শৈশবকালটা। দাদার সঙ্গে মাছ ধরা, নদীতে গোসল করা, কখনো আবার দাদার পিঠে চরে মসজিদে যাওয়া। আরও কত নানান স্মৃতি। কথাগুলো মনে করতেই আবির হাসানের চোখটা জলে ভিজে গেল। খুব মনে পড়ছে দাদাকে। দাদা এভাবে চলে যাবে, কখনো কল্পনাও করতে পারেননি। মোটরসাইকেলটা ধীরগতিতে পায়রা সেতুর ওপর উঠতে লাগল। সেতুটা পেরোলেই আবির হাসানের গন্তব্য।

মোটরসাইকেলটা ঠিক সেতুর মাঝবরাবর আসতেই পেছন থেকে দ্রুতগতির একটা বাস ধেয়ে এসে ধাক্কা দিল। মোটরসাইকেলটা ছিটকে গিয়ে বাসের চাকার নিচে পড়ল। আবির হাসানের দেহ থেকে হাত–পাগুলো আলাদা হয়ে গেল। সড়কের চারদিক লাল রক্তে ভরে গেল। আবির হাসানের চোখের চারদিকটা অন্ধকার হয়ে এল। অন্ধকারে ভেসে আসছে দাদার মুখের ছবি। আর পাশে বাবার নিষ্পাপ মুখ। বাবা যেন চিৎকার করে বলছেন, তোরা দাদা–নাতি আমাকে রেখে কই চলে যাচ্ছিস? আমাকেও নিয়ে যা? আবির হাসানের চোখের পাতাটা ধীরে ধীরে বুজে গেল, দাদা যেন তাকে ডাকছে ‘দাদা ভাই দাদা ভাই’ বলে!
লেখক: মুশফিকুর রহমান, বাকেরগঞ্জ, বরিশাল