গুরু, আপনাকে প্রণাম

শিক্ষকতাপ্রতীকী ছবি

স্মৃতিতে অম্লান চিরহরিৎ একটি গল্প। যে গল্প বাস্তব ও সত্য, নেই মিথ্যার লেশমাত্র। প্রতিটি ভাঁজে জড়িয়ে আছে স্নেহ-ভালোবাসা, মায়া-মমতা, শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর একজন গুরুর প্রয়োজন হয়; যিনি প্রয়োজনীয় বিষয় শেখান শ্রেণিকক্ষে বা বাইরে, দিবস বা রজনীতে। হোক সে জ্ঞান প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক, বিভাগীয় বা অবিভাগীয়।

যার গুরু নেই, সে মূলত শিক্ষার রস আস্বাদন করতে সমর্থ হয় না। ভর্তি হওয়ার পর প্রথম পাঁচ মাসের মধ্যেই শ্রেণিকক্ষে বন্ধুর সন্ধান পাওয়ার আগে আমি একজন গুরুর সন্ধান পাই। যাঁর ব্যক্তিত্ব, শেখানোর কৌশল, উপস্থিত জ্ঞান, পাত্রভেদে সম্বোধনের ধরন আমাকে মুগ্ধ করে।

শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে একটি সমাজকে আলোকিত করার ক্ষমতা যাঁদের আছে, তাঁদের মধ্যে আমার গুরু একজন উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। শিক্ষকতার এই মহৎ পেশায় নিজের জীবনকে সঁপে দিয়ে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন অসংখ্য শিক্ষার্থীর মধ্যে। তাঁর অসামান্য শিক্ষা, পাণ্ডিত্য ও উদার মানবিকতার জন্য তিনি আমার কাছে শুধু একজন শিক্ষক নন, বরং আদর্শ গুরু হিসেবেই পরিগণিত।

তিনি বিশ্বাস করেন, শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য হলো শিক্ষার্থীদের মধ্যে জ্ঞানের উদ্দীপনা তৈরি করা এবং চিন্তা ও অনুসন্ধানের জন্য প্রণোদিত করা। তিনি শ্রেণিকক্ষে শুধু পাঠ্যবিষয় শেখানোর পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের পর্যবেক্ষণশক্তি বাড়াতে বলেন এবং সৃজনশীল হওয়ার অনুপ্রেরণা দেন। শিক্ষার্থীদের সমস্যার সমাধান করতে, যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত নিতে এবং সৃজনশীল চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেন।

শিক্ষার্থী থাকাকালে অধ্যাপক সুলতান মাহমুদ স্যারের সঙ্গে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে কথা বলতাম। শ্রেণিকক্ষের বাইরে স্যারের চেম্বার ছিল আমার রাজনৈতিক আলাপের পীঠস্থান। রুমে বসে পড়াশোনা করার সময় যেসব বিষয়ে মনে সন্দেহের সৃষ্টি হতো অথবা যেসব বিষয়ে নতুন মতের সৃষ্টি হতো, সেসব বিষয় আমি স্যারকে জানাতাম।

প্রথম বর্ষ শেষ করে কোভিডের কারণে লকডাউনে পরে যাই। দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তখনো আমি ফোনে স্যারের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার দারুণ সমাধান খুঁজে বের করতাম। প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর কয়েক মাসের মধ্যে স্যারের সঙ্গে আমার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়, যাকে গুরু-শিষ্য সম্পর্ক বলা যায়।

স্যারের সঙ্গে চেম্বারে রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা শেষে প্রায়ই বই নিতাম। ডিনস কমপ্লেক্সে থাকাকালে স্যারের চেম্বারে তাকবোঝাই অনেক বই ছিল। স্যারকে বলেছিলাম—স্যার, কোন ধরনের বই আগে শুরু করব? স্যার বলেছিলেন—মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ নিয়ে আগে স্টাডি করো। সেখান থেকে পুরোদমে আমার বই পড়া শুরু। স্যারের থেকে একটা করে বই নিতাম, পড়ে আবার দিয়ে দিতাম যথারীতি।

স্যারের কাছে শিক্ষাদান কেবল একটি পেশা নয়, বরং এটি তাঁর ধ্যান ও জ্ঞান। আমি যখন শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন তিনি শিক্ষার্থীদের উন্নতির জন্য নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করতেন এবং শিক্ষাদানে নতুনত্ব আনতে চেষ্টা করতেন। এখনো করেন আমার বিশ্বাস। তাঁর ক্লাসরুমে পাঠদান ছিল একটি প্রাণবন্ত অভিজ্ঞতা। যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেদের জ্ঞানকে প্রসারিত করার সুযোগ পেত। ক্লাসের প্রতিটি মুহূর্ত ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষামূলক এবং অনুপ্রেরণাদায়ক।

স্যার ক্লাসে এসে হঠাৎ করেই পূর্বে আলোচিত টপিক থেকে পড়া ধরতেন এবং নতুন উদাহরণ চাইতেন। এতে ক্লাসের সব শিক্ষার্থীরা তটস্থ থাকত। কারণ, তত্ত্বের সঙ্গে নতুন উদাহরণ মিলিয়ে একটি সৃজনশীল উত্তর আশা করতেন স্যার। এ জন্য চলমান জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে আপডেট তথ্য শিখে আসতাম সবাই, যাতে স্যারকে সন্তোষজনক উত্তর দেওয়া যায়।

শুধু –তাই নয়, স্যার ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে প্রেজেন্টেশনের ব্যবস্থা করতেন; যেখানে একজন শিক্ষার্থীকে ১৫ মিনিট সময় দেওয়া হতো। এর মধ্যে প্রশ্নোত্তর পর্বসহ নির্ধারিত বিষয়ে আলোচনা শেষ করতে হতো। স্নাতক শেষ বর্ষে স্যার তাঁর লেকচার শেষ করে একটি ডেমো ক্লাসেরও আয়োজন করেছিলেন।

ডেমো ক্লাসে একজন শিক্ষার্থী প্রায় ২৫ মিনিট সময় পেত। এই ২৫ মিনিটে একজন শিক্ষক যেভাবে ক্লাস নেন, তাকেও সেভাবে ক্লাস নিতে হতো। এটি ছিল স্যারের এক নতুন সংযোজন। এই ক্লাস নেওয়ার মাধ্যমে অনেকেই শিক্ষকতা পেশাকে পছন্দ করতে শুরু করে।

স্যারের সঙ্গে আমার সম্পর্ক তৈরি হয় ক্লাসে রেসপন্সের মাধ্যমে। ক্লাসে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর করার কারণে স্যার আমাকে পছন্দ করতেন। গুরু-শিষ্য সম্পর্কের শুরুটা শুধু জ্ঞান ও তত্ত্বীয় আলোচনাতে সীমাবদ্ধ থাকলেও পরবর্তী সময়ে আরও বিস্তার ঘটে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে যত সমস্যার সম্মুখীন হয়েছি, স্যার নিঃস্বার্থ সহযোগিতা করেছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন, সাহস দিয়েছেন। স্যারের ইতিবাচক আচরণ আমার চলার পাথেয় হয়েছে।

স্যারের প্রতি অন্তরের অন্তস্তল থেকে দোয়া ও ভালোবাসা জানাই। আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার যথেষ্ট চমৎকার ভাষা আমার জানা নেই স্যার। শুধু এটুকুই বলব, ‘গুরু, আপনাকে প্রণাম।’

*লেখক: মো: শফিকুল ইসলাম নিয়ামত, সাবেক শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

*নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]