রাজনৈতিক অস্থিরতায় বন্ধুত্ব নষ্ট হচ্ছে না তো
বাংলাদেশের মানুষ অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন। তারা সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। গ্রামগঞ্জে চায়ের দোকান থেকে শুরু করে হাটে–মাঠে–ঘাটে কোথায় নেই রাজনৈতিক আলাপ–আলোচনা। এ ছাড়া দেশের সচেতন নাগরিক তো রয়েছেই। রাজনীতি মূলত মানুষের অধিকারবোধের কথা বলে। আর এ জন্যই এ দেশের মানুষ রাজনীতিতে এতটা সক্রিয়।
বাংলাদেশে মূলত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল ধরা হয়। জাতীয় পার্টিকে তৃতীয় দল হিসেবেই ধরা হয়। জামায়াতে ইসলামীসহ বেশ কিছু ইসলামপন্থী দল জাতীয়তাবাদী দলের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করে রাজনীতি করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যগতভাবে বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলোর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে রাজনীতি করে। এ দুই দলের মধ্যে সমর্থক প্রায় কাছাকাছি। দুই দলই রাজনৈতিক সহিংসতা, আন্দোলন এমনকি হত্যাকাণ্ডেরও জন্ম দিয়েছে। দুই দলেরই ছাত্রসংগঠন বেশ সক্রিয়।
বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির নানা অভিযোগের কারণে সাধারণ মানুষ বেশ হতাশ।
দুই মাস ধরে বাংলাদেশে এক ভয়ানক অস্থিরতা বিরাজ করেছিল। সরকার পতনের জোর আন্দোলন। আন্দোলন অনেকটা যুদ্ধের মতো অবস্থায় পরিণত হয়েছিল। অসংখ্য লাশ পড়েছে। বাংলার মানুষ আওয়ামী সরকারের পতন ঘটাতে পেরেছে।
শেখ হাসিনার সরকার পতন তো হলো, দেশ নিপীড়িত শাসকের কবল থেকে মুক্তি পেল বলে অনেকেই বলছেন। কিন্তু দলাদলি আর রেষারেষি কি থামল?
কেউ না কেউ কারো না কারো পেছনে কায়দা করে লেগেই আছে। এমনভাবে লেগে আছে যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে এখন রীতিমতো ডিবেট ক্লাব মনে হয়। কে কার চেয়ে যুক্তিতে এগিয়ে, কে কত বেশি ঘায়েল করতে পারছে প্রতিপক্ষকে, তা নিয়ে চলছে কঠিন লড়াই।
কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি, রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে নিজেরা নিজেদের মধ্যে সুন্দর সাবলীল সম্পর্কটা নষ্ট করে ফেলছেন।
যাকে আপনি দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলছেন, আপনার কাছের মানুষই হয়তো সেটা মানতে পারছেন না। অথবা বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে গিয়ে এমন সব শব্দ চয়ন করছেন নিজের অজান্তেই, যা আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একেবারেই বেমানান।
আপনার যে চেহারা কাছের মানুষগুলো দেখে অভ্যস্ত, হঠাৎ দেশের ভয়ানক পরিস্থিতিতে আপনার সেই বদলে যাওয়া চেহারা অনেকেই চিনতে পারছে না। আপনার কঠিন প্রতিবাদের ভাষা ছাপিয়ে যাচ্ছে চিরচেনা আপনার কোমলতাকে। আপনাকে লোকে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বলে কটাক্ষ করছে। আপনি হয়তো আপনার ভেতরের ক্রোধ উগরে দিচ্ছেন সময়ের এই ভয়াবহতায়।
যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই একজন মানবিক মানুষের কাজ, কিন্তু আপনার প্রতিবাদের ভাষা যদি কাউকে দেশপ্রেমিক থেকে দেশদ্রোহী বানিয়ে দেয়, তাহলে তো অন্যায়। একেকজনের প্রতিবাদের ভাষা একেক রকম। তা ছাড়া দল, মত এসব তো প্রত্যেক মানুষের ব্যক্তিগত পছন্দ–অপছন্দের ব্যাপার।
হয়তো আপনি কোনোকালেই কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াননি, রাস্তায় নামা তো দূরের কথা দুটো লাইন লিখতেও আপনার ইচ্ছা করেনি কোনো দিন, সেই আপনি হঠাৎ কেন এত বিগড়ে গেলেন, এর পেছনে আপনার কোনো ব্যক্তিস্বার্থ নেই তো? এমনটাও কিন্তু আপনার কাছের লোকেরা ভাবতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, আপনি কোনো বিশেষ দলের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট, যা এত দিন গোপন রেখেছিলেন। কাজেই কী বলছেন, কাকে মিন করে বলছেন বা কেন বলছেন, প্লিজ ঠান্ডা মাথায় ভেবে বলুন। যেন আপনার কথার আঘাতে দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব বা সামাজিক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে না যায়।
ফেসবুক তো এখন রীতিমতো রাজনৈতিক প্রাঙ্গণ, যে যা পারছে শেয়ার করছে এবং তাই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনা চলছে। সেটা এতটাই মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে অনেকেরই ইতিমধ্যে বহু বছরের বন্ধুত্ব শেষ হয়ে গেছে।
দেখুন, সবাই হয়তো সবার জায়গা থেকে ঠিক, তাই বলে এমন কিছু লিখবেন না বা বলবেন না, যাতে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়।
খেলা, রাজনীতি এসব নিয়ে মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মত থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে কাউকে আক্রমণ করতে যাবেন না। দিনশেষে কোনো রাজনীতিবিদই আপনার পাশে দাঁড়াবে না। ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া আর যা–ই হোক রাজনীতি হয় না।
মনে রাখবেন, এই পরিস্থিতিও একসময় স্বাভাবিক হয়ে যাবে বা অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে। কিন্তু আপনার লেখার ভাষা বা কথা এবং আচরণ হয়তো আপনার কাছের মানুষটা কোনো দিনও ভুলে যাবে না।
মতের অমিল হতে পারে। কে কাকে সমর্থন করবে, কে কোন নীতি লালন করবে, এটা যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু আমি আপনি কাউকে তো ফোর্স করতে পারি না বা তার মতামতকে উপেক্ষা করতে পারি না। মনে রাখবেন, এত এত মৃত্যু, এত লাশ কোনো মানবিক মানুষের পক্ষেই সহ্য করা খুব একটা সহজ নয়!
আপনি হয়তো কাউকে ইনবক্সে লিখলেন, আসসালামু আলাইকুম, কেমন আছেন? উত্তরে সে আপনাকে শুধু লিখল, ভালো আছি, কিন্তু ওয়ালাইকুম আসসালাম লিখল না। তার মানে কি সে খারাপ, নাকি অভদ্র। মনে মনেই সে হয়তো সালামের উত্তর দিয়ে ফেলেছে, বাট কষ্ট করে আর লেখেনি। কাজেই সবার প্রকাশ তো একই কায়দায় একই ভঙ্গিতে না–ও হতে পারে।
আপনি হাজারো জনতার সঙ্গে মিশে সরকার পতনে অংশগ্রহণ করে আনন্দিত হয়েছেন, সেটা আপনার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যায় বলেই করেছেন। আবার অনেকেই ঘরে বসেই মনে মনে হয়তো হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে সরকারের এমন পতনে।
পুরো পৃথিবীতে আজ অস্থিরতা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা, যুদ্ধবিগ্রহ, দুর্নীতি, দ্রব্যমূল্যের চড়া দাম। এতে কিন্তু ক্ষতি অন্য কারও নয়, যারা আমাদের মতো সাধারণ হতদরিদ্র তাদের। আজ যাদের দেখছি সতেজ সজীব, তারাই একদিন ফুলে–ফেঁপে উঠবে ক্ষমতার দম্ভে। এটাই যুগে যুগে হয়ে আসছে এবং আগামীতেও হবে। রাজনীতির পেছনেও রাজনীতি থাকে।
আদর্শ থাকা ভালো, ন্যায়ের পথে চলা ভালো, কিন্তু অতিরঞ্জিত হঠাৎ অতি উৎসাহ মানুষের চোখে লাগে। কত মানুষকে দেখছি চোখের সামনে বদলে যেতে, রোদ যেদিকে ছাতাও সেদিকে। আবার কতজনকে দেখছি অকারণে গালি খেতে, নির্যাতিত হতে, কিন্তু তারা নির্বিকার। ক্ষমতা যত বেশি তার অপব্যবহার তত বেশি বিপদজ্জনক। (এডমন্ড বার্ক)
কথায় বলে, ক্ষমতা হলো সূর্যের আলোর মতো। তাতে কেউ আলোকিত হয়, আবার কেউ পুড়ে শেষ হয়ে যায়। লোভ মানুষকে কখনো অর্জনের দিকে নিয়ে যায় না। লোভ মানুষকে প্রতিনিয়ত ধ্বংসের দিকে ঠেলতে থাকে।
যার প্রমাণ এ দেশের মানুষ নিজ চোখে দেখতে পেল। একটা কথা আছে...
‘এত আলো পৃথিবীতে তবু মানুষ অন্ধকারে কেন?
কিছু অন্ধকারেরও আলো থাকে আবার সব আলোতেই অন্ধকার ঘোচে না।’
আমরা চাই সমস্ত অন্ধকার ঘুচে নতুন সূর্য উদিত হোক।
দিনশেষে আমরা সুস্থ সুন্দর স্বাভাবিক জীবনের জন্য একটা নিরাপদ বাংলাদেশ চাই।
* লেখক: রোজিনা রাখী, ফিচার লেখক
** নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]