গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্টদের কেন কাজে লাগানো হচ্ছে না

ফাইল ছবি

একসময় যে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলা হতো, সেই বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের অনেক দেশের কাছে এক বিস্ময়কর সম্ভাবনার দেশ। বাংলাদেশ ইতিমধ্যে মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ করেছে। পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলসহ অনেক মেঘা প্রকল্প হাতে নিয়ে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। অথচ দেশের অসুস্থ স্বাস্থ্যসেবা আজও সুস্থতার লক্ষণ দেখেনি। একটি দেশের পূর্ণাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয় ডাক্তার, ফার্মাসিস্ট ও নার্সের সমন্বিত প্রয়াসে। অথচ দেশে অসংখ্য গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা সত্ত্বেও তাঁদের কাজে লাগানো হচ্ছে না।

১৯৬৪ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি শিক্ষা চালু হয়। পরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের ১৩টি পাবলিক ও ৪৩টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি শিক্ষা চালু হয়েছে। প্রতিবছর এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনেক গ্র্যাজুয়েট ফার্মেসি বের হচ্ছেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হচ্ছে, ৫০ বছরেও ফার্মাসিস্টদের সরকারি হাসপাতালে নিয়োগের কোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়নি। ২০১৮ সালে ফার্মাসিস্টদের হাসপাতালে নিয়োগের উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো এক অজানা কারণে সেই উদ্যোগ লাল ফিতার দৌরাত্ম্য থেকে আর জামিন লাভ করেনি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, উন্নত স্বাস্থ্যসেবার মান নিশ্চিত করার জন্য ফার্মাসিস্টদের ৫৫ শতাংশ কমিউনিটি ফার্মেসি, ৩০ শতাংশ হসপিটাল ফার্মেসি, ৫ শতাংশ ম্যানুফ্যাকচারিং, ৫ শতাংশ সরকারি সংস্থায় এবং ৫ শতাংশ একাডেমিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করার নিয়ম রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল ফেডারেশনের (এফআইপি) ‘ফার্মেসি অ্যাট আ গ্ল্যান্স ২০১৫-২০১৭’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী সারা বিশ্বে প্রায় ২৮ লাখের বেশি রেজিস্ট্রার্ড গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বর্তমানে কর্মরত রয়েছেন, যার প্রায় ৭৫ দশমিক ১ শতাংশ কাজ করেন কমিউনিটি ফার্মেসিতে, ১৩ দশমিক ২ শতাংশ হসপিটাল ফার্মেসিতে এবং বাকি প্রায় ১২ দশমিক ৭ শতাংশ কাজ করে ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিতে।

বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের নির্দেশনা অনুযায়ী ফার্মাসিস্টদের কর্মক্ষেত্রগুলো হচ্ছে ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি, ওষুধ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা ও ওষুধ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ওষুধ সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং বিতরণ, ওষুধের তথ্য প্রদানে মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষাগার, কমিউনিটি এবং হাসপাতালের ফার্মেসিতে একাডেমিক কার্যক্রম, প্রশিক্ষক, গবেষণা, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজত টিম এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা।

উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলানো তো দূরে থাক, দেশের প্রচলিত নিয়মে ফার্মাসিস্টদের যেসব কর্মক্ষেত্রের কথা বলা আছে, তা নিশ্চিত করতে পারিনি আমরা। এখনো হয়নি কমিউনিটি ফার্মেসি ও হসপিটাল ফার্মেসি। সারা বিশ্ব ফার্মাসিস্টদের কদর বুঝলে আমাদের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নাজুক এ স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও ফার্মাসিস্টদের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেনি। কবে পারবে বা কবে ঘুম ভাঙবে, সেটি সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারও বোঝার ক্ষমতা হয়তো নেই। ফার্মাসিস্টদেত প্রতি এমন বঞ্চনা চলতে থাকলে দেশকে আরও চড়া মূল্য দিতে হবে। বিশেষায়িত এ কোর্স সম্পূর্ণ করে যথার্থ কর্মক্ষেত্রে না পেয়ে কেউ কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করছেন, কেউবা ভিনদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এভাবে মেধার পাচার চলতে থাকলে দেশ তার মেধাবী সন্তানদের হারাতে থাকবে। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে উঁকি দেওয়া সোনালি দিন ফেরার সুযোগ থেকেও হাতছাড়া হবে, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি, দেশের গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট সমাজ শুধু ওষুধ উৎপাদন নয়, এ দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় সরাসরি যুক্ত থাকতে বদ্ধপরিকর। ফার্মাসিস্ট সমাজকে কাজ করার সুযোগ দিন। অনতিবিলম্বে হসপিটাল ফার্মেসি চালু করুন। কমিউনিটি ফার্মেসি ব্যবস্থা ব্যাপক হারে শুরু করুন।

দেশের মেধা পাচার রোধ করতে এগিয়ে আসুন। অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি বুদ্ধিবৃত্তিক মানবসম্পদ দেশে ধরে রাখতে যথার্থ জায়গায় নিযুক্ত করুন। শুধু রেজিস্ট্রেশন প্রদান ও শিক্ষার মান নিয়ে কাজ করলে তা ফলপ্রসূ হবে না, যতক্ষণ সেই শিক্ষা প্রয়োগের পর্যাপ্ত কর্মক্ষেত্র তৈরি না হয়। সে জন্য বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের আরও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা জরুরি। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়ন করতে পারলে নিশ্চয়ই দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সোনালি দিন ফিরে আসবে।

  • লেখক: তানভীর আহমেদ রাসেল, শিক্ষার্থী, এমফার্ম, ফার্মেসি বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়