মাকে বলিস, আমি আসছি

সকাল ৭টা বেজে ৩০ মিনিট। ফোনে রিং হচ্ছে। রিসিভ করার পর ওপাশ থেকে ভেসে এল, ‘কিরে ছোটন কেমন আছিস?’ ছোটন বলল, ‘আরে ভাইয়া তুমি!...হ্যাঁ, মাকে বলিস, আমি আসছি।’

রবি মা-বাবার বড় ছেলে। আর সিফাত হচ্ছে রবির একমাত্র ছোট ভাই। রবি আদর করে তাকে ছোটন বলে ডাকে। শুধু রবি নয়, পরিবারের সবাই তাকে ছোটন বলেই ডাকে। আর মাত্র তিন দিন পর ঈদ। রবি চাকরি পাওয়ার পর এটাই তার প্রথম ঈদ। সে খুব খুশি। কারণ, সে তার চাকরির বেতন থেকে মা-বাবাসহ ছোটনের জন্য ঈদের শপিং করেছে। আজ রবি সকাল সকাল রাস্তায় বেরিয়েছে বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে। বাস কাউন্টারে এসে টিকিট নিয়ে সে বাসে উঠে। অল্প কিছুক্ষণ পরই বাস তার গন্তব্যে যাত্রা করে।

রবি জানালার ধারে বসে মৃদু হাওয়ায় ভাবছে তার অতীতের স্মৃতি। তার মা-বাবা তাকে কত কষ্ট করে লেখাপড়া করিয়েছে। তার মনে পড়ে ছোটবেলার সেই ঈদের কথা। যে ঈদের আগে তার খুব মন খারাপ ছিল। কারণ, বাবা তাকে নতুন জামা কিনে দেয়নি। কিনে দেয়নি বললে ঠিক হবে না, আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ায় কিনে দিতে পারেনি। রবির মন খারাপ দেখে ঈদের আগের দিন বিকেলে মা তার শখের দুটি মুরগি বাবার হাতে তুলে দেয় বিক্রি করতে। বাবা সেই মুরগি বিক্রি করে সেদিনই রবিকে নতুন জামা কিনে দেয়। তখন রবির খুশির শেষ ছিল না। এই ভাবতে ভাবতে রবি ঘুমিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে সে স্বপ্ন দেখছে, আজ তার বাড়ি যাওয়ার কথা শুনে মা বারবার পথে এসে উঁকি দিচ্ছে, ছেলেকে দেখা যায় কি না! আর ছোটন বাবাকে বারবার জিজ্ঞাসা করছে, ‘বাবা! ভাইয়া কখন আসবে?’ উত্তরে বাবা বলছে, এই বুঝি চলে এল, আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে। অতঃপর রবি যখন বাড়িতে যায়, তখন সবাই খুব খুশি। রবি ছোটনকে নতুন জামা দিলে জামাটি দেখে ছোটন বলছে, ‘ভাইয়া আমার অনেক পছন্দ হয়েছে।’ বাবা বলছে, ‘আমাদের জন্য এত টাকা খরচ না করলেও পারতে।’ আর মায়ের চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু। রবি দেখে বলছে, মা তু….!

হঠাৎ বিকট শব্দে রবির ভেঙে গেল স্বপ্নময় ঘুম। আর চোখ দুটি মিলতে না মিলতেই ভর করল আঁধার। রক্তাক্ত দেহে না ফেরার দেশের যাত্রী হয়ে ওপারে পাড়ি জমাল রবি। ওদিকে মায়ের অন্তরে ছটফটানি শুরু হয়েছে। মা ছোটনকে বলল, তোর বড় ভাইকে ফোন দিয়ে শোন তো কত দূর আছে এখন? ছোটন মায়ের কথামতো ফোন দিলে, কল যাচ্ছে কিন্তু ফোন ধরছে না। তাই সে তার মাকে বলল, ‘মা রিং হচ্ছে কিন্তু ফোন রিসিভ করছে না। হয়তো ভাইয়া গাড়ির শব্দে বুঝতে পারছে না।’

দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তবুও রবির কোনো খবর নেই। তার মা-বাবা খুবই চিন্তা করছে। আর ভাবছে, ছেলেটা সেই যে সকালে রওনা হলো সারাদিন কোনো খোঁজখবর নেই। ফোন দিলে ফোনও ধরছে না। ছেলেটার কিছু হলো না তো। মা খুব চিন্তিত।

হঠাৎ ছোটন চিৎকার করে তার মা-বাবাকে ডাকছে। ছোটনের চিৎকার শুনে তার মা-বাবা দুজনই এল। মা বলল, তোর আবার কী হলো? ছোটন অশ্রুভেজা চোখে বলল, মা দেখো টিভিতে দেখাচ্ছে বাস দুর্ঘটনা হয়েছে। আর রক্তাক্ত ওই লাশটিকে আমার রবি ভাইয়ার মতো দেখাচ্ছে। মা-বাবা দেখামাত্রই চিনতে পারেন তার আদরের ছেলেকে। মা রবির মৃত চেহারা দেখামাত্রই জ্ঞান হারিয়ে ধপ করে মাটিতে পড়ে গেলেন। অশ্রু চোখে হতবিহ্বল তার বাবা। আর ছোটনের কানে এখনো বাজছে, ‘কিরে ছোটন কেমন আছিস?... মাকে বলিস, আমি আসছি।’

*লেখক: মোফাজ্জল হোসেন শান্ত, শিক্ষার্থী, ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]