কেমন হবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবন
আলিফ সবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে প্রবেশ করেছে। যেন স্কুল–কলেজজীবনের গণ্ডি পেরিয়ে এক সম্ভাবনাময় আগামীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কয়েক দিনের অভিজ্ঞতা তার আজীবনের স্মৃতি হয়ে থাকবে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা অসংখ্য মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগ, নতুন নতুন অনেক কিছু জানতে শেখা, রাতভর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা—যেন এক স্বাপ্নিক সময় পার করছে আলিফ। এত দিন ধরে যেন এ রকম একটা সময়েরই অপেক্ষায় ছিল সে। আলিফের এ গল্প সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক তরুণেরই গল্প। স্কুল-কলেজের উঠান পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নতুন এক পৃথিবী হাজির হয় তাদের সামনে। আসে জীবনকে নতুনভাবে সাজানোর সুযোগ। তাই এ সময়ের সদ্ব্যবহার করা দরকার শুরু থেকেই, যেন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে বের হওয়ার পর কোনো আফসোস না থাকে।
বিশ্ববিদ্যালয় শুধু একাডেমিক শিক্ষা অর্জনের স্থান নয়; বিশ্ববিদ্যালয় হলো জীবনকে চেনার মাধ্যম, নিজের সক্ষমতাকে চেনার সময়। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের পরবর্তী ধাপই হলো কর্মজীবন। তাই কর্মজীবনের প্রস্তুতিও নিতে হবে এখান থেকেই। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের এই সুন্দর সময়কে সফলভাবে কাজে লাগানো যায়, আজ আমরা সেটি নিয়েই কথা বলব।
১. নিজ বিষয়ের ওপর পড়াশোনা
বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক কাজের সুযোগ থাকলেও একজন শিক্ষার্থীর প্রধান কাজ তার নির্ধারিত বিভাগ বা বিষয়ের পড়াশোনাকে ঠিক পর্যায়ে রাখা। তার মানে এই নয় যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। তবে হ্যাঁ, পড়াশোনার ক্ষেত্রে সবার প্রথম যেটি মাথায় রাখতে হবে, তা হলো ধারাবাহিকতা। একদিন দীর্ঘ সময় পড়াশোনা করে বাকি এক সপ্তাহ পড়াশোনা বন্ধ, এমনটি করা যাবে না। অল্প সময় পড়লেও পড়াশোনা করতে হবে নিয়মিত। সঙ্গে নিজ বিভাগের পড়াশোনার বিষয়গুলো জানতে হবে ভালোভাবে। কেননা, যেকোনো চাকরির ভাইভায় নিজ বিষয় থেকেই সিংহভাগ প্রশ্ন করা হয়। পাশাপাশি ডিপার্টমেন্টে নিজের ফলাফলও যেন একটা মোটামুটি অবস্থানে থাকে, সেদিকেও নজর রাখা জরুরি।
২. সিলেবাস–বহির্ভূত পড়াশোনা
নিজ বিভাগের পড়াশোনার বাইরেও অসংখ্য বিষয়ে পড়াশোনা করা যায়। মূলত, বিশ্ববিদ্যালয় তৈরির প্রধান কারণই হলো একজন শিক্ষার্থী যাতে তার জ্ঞানের ক্ষুধাকে পরিপূর্ণভাবে মেটাতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে অসংখ্য বিষয়ের ওপর পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। সেটি যেমন অনলাইনে, তেমনি রয়েছে অফলাইনেও। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি বা যে বিষয় নিয়ে আপনি পড়তে চাইছেন, সে বিষয় সংশ্লিষ্ট বিভাগে যোগাযোগ করলেই তারা আপনাকে প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সাহায্য করতে পারে। তা ছাড়া অনলাইনে আপনি ঘরে বসেই পৃথিবীর সেরা সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে পারেন। তাই এ সময়ে নিজ বিভাগের বাইরেও অন্যান্য বিষয়ের ওপর পড়াশোনা করে নিজের জ্ঞানের পরিধিকে আরও একটু বাড়িয়ে নেওয়া উচিত।
৩. সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ
বিশ্ববিদ্যালয় জ্ঞান অর্জনের স্থান, সেটি ঠিক, তাই বলে সারা দিন শুধু পড়াশোনা নিয়ে পড়ে থাকলেই চলবে না; বরং পড়াশোনার বাইরের বিষয়গুলোর চর্চা করাও অনেক জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের বিশাল সুযোগ। এখানে যেমন প্রতিনিয়ত বিভিন্ন বিষয়ের চর্চা হয়, তেমনি প্রতিটি বিষয়ের জন্য অভিজ্ঞ প্রশিক্ষককেও পাওয়া যায়। তাই নাচ, গান, আবৃত্তি, অভিনয়, বিতর্ক—নিজের পছন্দমতো বিষয়ে সময় দেওয়ার অভ্যাসও ঠিক রাখতে হবে সবার।
৪. সাংগঠনিক সম্পৃক্ততা
কর্মজীবনে আপনি কীভাবে সহকর্মীদের সঙ্গে মিশবেন, কীভাবে অসংখ্য মানুষকে আপনার কাজে সম্পৃক্ত করবেন, তার ব্যবহারিক ধারণা লাভ করা যায় সংগঠন করার মাধ্যমে। আপনি যখন কোনো সংগঠনের কাজের সঙ্গে জড়িত হবেন, তখন বিভিন্ন ধরনের মানুষের সঙ্গে মেশার, তাদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি হবে। কাজের মাধ্যমে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলোকে অতি সহজে বুঝতে পারা যায়, যেটি পরবর্তী সময়ে আপনাকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহায়তা করবে। টিমওয়ার্ক বা দলগত কাজ সম্পর্কেও চমৎকার ধারণা তৈরি হয় সংগঠন করার মাধ্যমে। এ ছাড়া নেতৃত্ব, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট, টাইম ম্যানেজমেন্ট ও কমিউনিকেশন স্কিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর হাতেখড়ি ঘটে সাংগঠনিক কাজের মাধ্যমে, যা পরবর্তী জীবনে সরাসরি কাজে আসে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে কাজ করার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত।
৫. স্কিল বাড়ানো
বিশ্বায়নের এই যুগে প্রতিনিয়ত কম্পিউটার ও ইন্টারনেটের মতো প্রযুক্তির ব্যবহার ছাড়া একমুহূর্তও চলে না। পরিবর্তনশীল বিশ্বব্যবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে তাই এসবের ব্যবহার জানা জরুরি। ছাত্র অবস্থায়ই কম্পিউটারের কিছু বেসিক সফটওয়্যারের কাজ শিখে রাখা দরকার, যেমন ওয়ার্ড, এক্সএল, পাওয়ার পয়েন্ট, ইলাস্ট্রেটর প্রভৃতি। এসব সফটওয়্যারের ব্যবহার যেমন আপনাকে প্রযুক্তিগত কাজে দক্ষ করে তুলবে, তেমনিভাবে পরবর্তী কর্মক্ষেত্রের জন্যও আপনাকে প্রস্তুত করবে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই কম্পিউটারের এই সাধারণ সফটওয়্যারগুলোর ব্যবহার শিখে নিন। নিজের বন্ধুদের কাছ থেকে শিখতে পারেন বা চাইলে ইউটিউবের মাধ্যমেও এসবের ওপর দক্ষতা অর্জন করতে পারেন।
৬. জীবনের কাছাকাছি যাওয়া
শুরুতেই বলেছি, বিশ্ববিদ্যালয় হলো জীবনকে চেনার সময়। তাই প্রতিদিনের ক্লাস, পরীক্ষা, কাজের ব্যস্ত রুটিনের পাশাপাশিও কিছু করুন। মাঝেমধ্যেই রুটিনে বাঁধা জীবন থেকে বেরিয়ে আসুন। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিন, রাতভর খালি গলায় গান গাইতে গাইতে রাস্তায় হাঁটুন। বিশ্ববিদ্যালয় শেষে এ স্মৃতিগুলোই থাকবে আপনার আজীবনের সঙ্গী। তাই সবকিছুর পাশাপাশি জীবনকে উপভোগ করাটাও শিখুন। কোনো রকম পরিকল্পনা ছাড়াই ঘুরতে বেরিয়ে পড়ুন। দেখবেন আপনার চেনা জীবন আসলে আপনার ধারণার চেয়েও অনেক ভিন্ন। প্রকৃতির কাছাকাছি যান, প্রকৃতির ভাষা বুঝতে পারবেন। দেখবেন, জীবনটা আসলেই অনেক বেশি সুন্দর। বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে স্বাধীনতা আসে অফুরন্ত। তাই এ স্বাধীনতাকে কাজে লাগান ভালো কিছু ও নতুন কিছুর মাধ্যমে।
৭. প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিভিন্ন রকমের প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিজনেস কমপিটিশন, আইডিয়া কমপিটিশন, রচনা প্রতিযোগিতাসহ আরও অনেক কিছু। নিজের পছন্দমতো এগুলোয় অংশগ্রহণ করুন। দেখবেন আপনার সক্ষমতা ও দুর্বলতার জায়গা সম্পর্কে একটা পরিষ্কার ধারণা পাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতাগুলো অংশগ্রহণমূলক হওয়ায় নিজ ক্যাম্পাসের বাইরেও অনেকের সঙ্গে পরিচয় হতে পারবেন, পেয়ে যাবেন অসংখ্য ভালো বন্ধু। তাই নিজের পছন্দের সঙ্গে মিল রেখে কমপক্ষে দুটি প্রতিযোগিতায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করুন। এসব প্রতিযোগিতার খবর আপনার ডিপার্টমেন্টের নোটিশ বোর্ডেই পেয়ে যাবেন। আর পাশাপাশি ইন্টারনেট তো রয়েছেই!
৮. পছন্দের কাজে সময় দেওয়া
সবারই কোনো না কোনো পছন্দের কাজ থাকে। কারও হয়তো ছবি আঁকতে ভালো লাগে, কেউ কবিতা লিখতে পছন্দ করেন, কেউবা গিটার বাজাতে ভালোবাসেন। বিশ্ববিদ্যালয় হলো এ পছন্দের কাজের ক্ষেত্রে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করার সময়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনি একই মানসিকতার, একই রুচির অনেক মানুষকে একসঙ্গে পেয়ে যাবেন। আবার পছন্দের কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনও রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ ক্লাবগুলোর মাধ্যমে নিজের আগ্রহের জায়গায় যেমন চর্চা করতে পারবেন, তেমনিভাবে পছন্দের কাজে নিজের দক্ষতাও বাড়িয়ে নিতে পারবেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে নিজের পছন্দের কাজ বুঝে সেটিতে সময় দিতে শিখুন।
এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা, সহশিক্ষা ও সাংগঠনিক কাজের মধ্যে সমন্বয় এনে একটি সুন্দর বিশ্ববিদ্যালয়জীবন আপনি উপভোগ করতে পারেন। এতে আপনার জ্ঞানার্জন যেমন হবে, তেমনিভাবে জীবনের আনন্দ উপভোগও সম্ভব হবে; পাশাপাশি অর্জন করতে পারবেন কর্মজীবনের প্রস্তুতি।
*লেখক: ফারহান ইশরাক, শিক্ষার্থী, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।