ফুটবল ফুটবল

কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলের ম্যাচে গ্যালারিতে (বাঁ থেকে) কাকা, কাফু, রবার্তো কার্লোস ও রোনালদোছবি: টুইটার

১.

মুক্তা হোস্টেলের গেস্টরুমে রুশো ভাইকে চা–সিগারেট খেতে দেখে খুব অবাক হয়ে গেলাম। বিশ্বকাপ ফুটবলে আজ ব্রাজিল–ক্যামেরুন খেলা আর রুশো ভাই এখানে? কেসটা কী? রুশো ভাই শোষিতের পক্ষে। বিশ্বকাপ ফুটবলের জায়ান্ট ব্রাজিল, জার্মানি, ইংল্যান্ড ও ইতালির বিপক্ষে যে দলই খেলুক, রুশো ভাই তাদের জন্য উচ্চকণ্ঠ। সন্ধ্যায় ওয়ার্ডে ক্লাস করতে যাওয়ার সময় টিভি রুমে ব্রাজিল দলের সমর্থকদের হম্বিতম্বি দেখে মনে হচ্ছিল, আজই (১৯৯৪ বিশ্বকাপ) তারা শিরোপা নিয়ে যাবে।

এবারের বিশ্বকাপটা নানা দিক থেকেই বৈচিত্র্যময়। এই প্রথম আমেরিকায় ফুটবলের বড় আসরটি বসেছে। খেলার সময়টা অন্য বিশ্বকাপের সময়ের তুলনায় অন্য রকম। স্টেডিয়ামগুলো কেমন গোলাকৃতির। পত্রিকা পড়ে জানতে পারলাম, ‘রোজ বোল’ স্টেডিয়ামসহ সব কটিই রাগবি খেলার মাঠ। স্টেডিয়াম যেমন ভিন্ন আকৃতির, খেলোয়াড়দের কাটিং–পুটিংও আলাদা। অ্যালেক্সি লালাস, টনি মেওলা ভিন্ন ধরনের নাম, হিপ্পিকাট চুটকি দাড়ি ও চুল, ভালদারার পাখির বাসার মতো বাবরি আর রবার্তো বাজ্জোর লেজ মার্কা ঊর্ধ্বমুখী চুল সবকিছুই ব্যতিক্রম। ইউরোপ–লাতিন আমেরিকার ফুটবল খেলায় অনভ্যস্ত আমেরিকান দর্শকেরাও ব্যতিক্রম। জরিপকারীদের কাছে তাঁদের ভাষ্য, ‘বাজ্জোর চুলের মধ্যে অ্যানটেনা ফিট করা আছে বলের গতিপ্রকৃতি ফলো করার জন্য।’ ৩২টা দলের খেলা। প্রায় ভোররাত ও সকালে অনেকগুলো খেলা হওয়ায় আমাদের এই খেলা ফলো করা কষ্ট হচ্ছে।

গত বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা বধকারী জায়ান্ট কিলার ‘রজার মিলা’র ক্যামেরুন প্রথম খেলায়ই সুইডেনের সঙ্গে ২–২ গোলে ড্র করে চমক দেখিয়েছে। তাদের পারফরম্যান্স দেখে ব্রাজিলবিরোধী শিবির, বিশেষ করে আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা আশায় বুক বাঁধছে যদি ব্রাজিলকে রজার মিলা সাইজ করে দেয়! সামনে আমাদের পরীক্ষা। ওয়ার্ড প্লেসমেন্টের ক্লাসগুলো মিস করা যাবে না। হোস্টেলের তীব্র উত্তেজনা ভুলে ক্লাস করতে যাই। বেবেতো, রোমারিও, দুঙ্গার ছবি–প্ল্যাকার্ডে অন্য দলগুলোর সমর্থকেরা চুপসে গেছে। ব্রাজিলের খেলা দেখে মনে হচ্ছে ওরাই চ্যাম্পিয়ন হবে। ফিফা–ব্রাজিলের আঁতাত নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক কানাঘুষা। মনে হচ্ছে, ডোপ টেস্ট বা মাদকসংক্রান্ত কোনো ঝামেলায় ম্যারাডোনাকে বাদ দিয়ে দিতে পারে। এ জন্য আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা ব্রাজিলের বিপরীতে যেকোনো দলের জন্য উচ্চকণ্ঠ।

রুশো ভাই হল্যান্ডের সমর্থক। আর্জেন্টিনা শিবিরের মধ্যমণি! টিভি রুমে ঢুকে ব্রাজিলের সমর্থকদের উদ্দেশে আর্জেন্টিনা–রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড সমর্থকদের ‘রজার মিল্লা-দিব ছিল্লা–লবণ দিয়া খাইব গিল্লা’ টীকা–টিপ্পনী দেখে বেশ ভয়ই লাগল। ৪২ বছরের রজার মিলার বুড়ো হাড়ের ভেলকিতে ব্রাজিল তটস্থ। খেলার প্রায় ২০ মিনিট চলে গেছে, ব্রাজিল সুবিধা করতে পারছে না। টিভি বরাবর সামনের সিটে রুশো ভাই আর্জেন্টিনা–রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড সাপোর্টারদের নিয়ে খেলা শুরুর অনেক আগেই জাঁকিয়ে বসে ছিলেন। রুশো ভাই তুখোড় মানুষ। ওনার জ্ঞানবুদ্ধি আর জানার আগ্রহের তুলনায় আমরা নগণ্য। কম্পিউটারের মতো শার্প ব্রেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যান দিয়ে উনি ‘ঘটি গরম’ করে ফেলেছেন। ব্রাজিলিয়ানরা হতোদ্যম। খেলা শুরুর আগেই ড্যাম খেয়ে গেছে। তাদের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে—রুশো ভাই আর্জেন্টিনা–রেস্ট অব দ্য ওয়ার্ল্ড সমর্থকদের নিয়ে এমন তুকতাক করবেন যেন আজ ব্রাজিল, আমেরিকায় ধরা খেয়ে যায়। তাই ‘কুফা’ রুশো ভাইকে সরাতে প্ল্যান করে ব্রাজিলের কয়েকজন সমর্থক ওনাকে নিচের গেস্টরুমে নিয়ে যায় চা–সিগারেট খেতে। ‘বিলাই পার’ করার মতো টিভি রুম থেকে সরিয়ে গেস্টরুমে পার করে সেখানে ব্যস্ত রাখে। রুশো ভাই ভদ্রলোক, তাদের মতলব বুঝতে পেরে মন খারাপ করে চা খাচ্ছেন। এর আগে গত দিনে উনি পিন্নু হোস্টেলে ব্রাজিলের বিপক্ষে সমর্থন দেওয়ায় আজকের খেলার জন্য টিভি রুমে অবাঞ্ছিত ঘোষিত হয়েছিলেন। উত্তেজনার পারদ বাড়তে বাড়তে টিভি রুমে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের মুখ বন্ধ করতে হকিস্টিক ঢুকে পড়েছে। বেশ বাজে অবস্থা।

ফাইল ছবি

গত পরশু বিকেলে মাঠে খেলতে নামার আগে রুশো ভাই আমাকে ডেকে ‘তুই কোন টিমের সাপোর্টার?’ জিজ্ঞাসা করেছিলেন। জার্মানির কথা বললে সবাই কটাক্ষ করে। তাই বেশ পার্ট নিয়ে ‘খেলা হলো আনন্দের জন্য, এত উগ্র সমর্থন পছন্দ করি না। তাই যে ভালো খেলবে, সেই দলের সাপোর্টার!’ রুশো ভাই আমার কথায় সায় দিয়ে বলেন, ‘হ্যাঁ, রিক্রিয়েশনের জন্য খেলা, তবে একটা দলকে সাপোর্ট দিলে খেলাটা জমে; সবাই তো প্রতিষ্ঠিত দলকে সাপোর্ট দেয়, আমি দুর্বল টিমের পক্ষে।’ ৩৯ মিনিটের সময় রোমারিওর গোলে সব টেনশন রিলিভড। টিভি রুমে গগনবিদারী আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে এক–তৃতীয়াংশ দর্শক মাথা নিচু করে যার যার রুমে পড়াশোনা করতে চলে যায়। রুশো ভাইও মুক্তি পান। বাকি খেলা দেখার উৎসাহ না থাকায় আস্তে আস্তে পিন্নু হলের দিকে চলে যান।

রুশো ভাইয়ের সঙ্গে প্রথম পরিচয়টা বেশ ইন্টারেস্টিং। ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি হওয়ার পর ‘গ্রে–গাইটন–হার্পার’–এর ভয়াবহ নীরস লেখা ও ইংরেজি পড়া আমাদের অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ডিসেকশন রুমের ভয়াবহ অভিজ্ঞতা, চোখে ফরমালিনের ঝাঁঝালো যন্ত্রণা, ক্লাস থেকে ফিরে এসে খাবার টেবিলে অরুচি আর প্রতিদিন আইটেমে দুই বা ততোধিক শিক্ষকের কাছে নিয়মিত ভাইভা দিতে গিয়ে আমরা একেকজন ডিপ্রেশনের রোগী হয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ হেলিপোর্ট হোস্টেলের গেটে ‘বাংলা চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা ও করণীয়’ শীর্ষক একটি পোস্টারে চোখ পড়ে। বিকেলে ১০৬ নম্বর রুমে বিশদ আলোচনার আহ্বান করা হয়েছে। সবাই দাওয়াতি।

বিশ্বকাপ ট্রফি উঁচিয়ে ধরেছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা
ছবি: ফাইল ছবি

১০৬ নম্বর রুমে স্মার্ট রুশো ভাইকে প্রথম দেখে বেশ মুগ্ধ হলাম। চশমার গ্লাস বেশ ভারী, ফরসা ও অভিজাত অবয়ব এবং বুদ্ধিদীপ্ত কথা দিয়ে আমাদের সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে ফেললেন। মেট্রিক, ইন্টারমিডিয়েটে বোর্ড স্ট্যান্ড করা ক্যাডেট কলেজের ছাত্র রুশো ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘“বেদের মেয়ে জোসনা” সিনেমা দেখেছ?’ আমতা–আমতা করে মাথা নাড়াই। আলোচনায় উঠে আসে কী কারণে অনেক দিন পর ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ বক্স অফিস হিট করেছে। চেইন স্মোকার জামালপুর জেলার ইসলামপুরের জমিদারবাড়ির ছেলে রুশো ভাই খুব দ্রুত অন্যদের মতো আমাকেও আপন করে নিয়েছেন।

ঘটনাবহুল আমেরিকার বিশ্বকাপে প্রায় প্রতিদিনই চমকের পর চমক। হ্যাজি, কলাম্বিয়ার এসকোবারের আত্মঘাতী গোল খাওয়ার পর বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া, ডোপ টেস্টে ম্যারাডোনার আউট হওয়া দিনে দিনে সবাইকে এই বিশ্বকাপের প্রতি খুব আগ্রহী করে তুলছে। হোস্টেলের বিশাল মাঠের বিভিন্ন কোনায়, বিভিন্ন সাইজের, বিভিন্ন বয়সের ফুটবলারদের রঙিন ড্রেসে খেলতে দেখাটাও বেশ আনন্দদায়ক। এর মধ্যে মেডিকেল কলেজের কর্মচারী ইউনিয়নের নেতা রওশন মামুকে বল নিয়ে মাঠে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখে চারতলার বারান্দা থেকে দর্শক–শ্রোতাদের উল্লাস আর আনন্দে আমিও শামিল হলাম। রওশন মামু প্রথাগত কর্মচারী ইউনিয়নের নেতাদের মতো নন। দেখতে অভিনেতা ফরিদ আলীর মতো, মোছের ছাঁটও একই রকম। নম্র ও ভদ্র। স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ভুঁড়ি নিয়ে বলে টান দিলেই দর্শক গ্যালারিতে ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়। বল প্লেসমেন্ট, ড্রিবলিং ও পজিশন সেন্স খুব ভালো। উনি কলেজের ক্যানটিনে মাঝেমধ্যে ম্যানেজার হিসেবে বসেন। আমাদের দেখলেই বলেন, ‘মামা, বয়স একটু কম হইলে রোমারিও, বাজ্জো সবাইরে টাইট কইরা দিতাম।’ আমরা নাশতা খেতে খেতে ওনাকে প্র্যাকটিস চালিয়ে যেতে বলি—‘সামনের বিশ্বকাপে আপনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল খেলবে।’ এতে মুরগির লটপটির বেশি করে গ্যাটিস পাওয়া যায়।

সকাল সাড়ে সাতটায় একসঙ্গে থার্ড, ফোর্থ ও ফিফথ ইয়ারের ছাত্রদের ক্লাস গ্যালারিতে। ৪০০ থেকে ৪৫০ ছাত্রছাত্রীর ক্লাসে স্যার–ম্যাডামরাও খুব মন দিয়ে পড়ান; সর্বোচ্চ প্রিপারেশন নিয়ে ক্লাসগুলো নেন। অনেকেই খুব বিজি প্র্যাকটিশনার। তারপরও এ ক্লাসগুলোয় সর্বোচ্চ যত্নের কমতি থাকত না। আমেরিকা বিশ্বকাপের বেটাইমের খেলা দেখে চোখ ঢুলু ঢুলু অবস্থায় খেলা অন্তঃপ্রাণ বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী খাতা–পত্র নিয়ে লেকচার তুলতে থাকি। খুব সতর্ক থাকতে হয়! যদি কখনো স্যার বা ম্যাডাম লেকচারের মাঝখানে পড়া ধরেন, তবে প্রেস্টিজ পাংচার! এই ভরা মজলিশে চোখ–কান খোলা না রাখলে বিপদ। হঠাৎ সার্জারির অধ্যাপক সোবহান স্যার, ‘ইয়ো বয়, গেট আপ’ বলে আমার সামনের সারির বন্ধুটিকে দাঁড় করালেন। খেলা দেখতে গিয়ে পর্যাপ্ত ঘুমের অভাবে আলপটকা একটা হাই তুলেছিল বন্ধু আমার। ‘হাই’ সংক্রামক। একজনের ‘হাই’ তোলা দেখে পাশের জনও ‘হাই’ তুলে ফেলল। স্যার কী করবেন, কী শাস্তি দেবেন ভেবে না পেয়ে ‘গেট আউট ফ্রম মাই ক্লাস’ বলে দুজনকেই বহিষ্কার করলেন। ওরা খুশিমনে বের হয়ে গেল, আরামসে নাশতা করতে পারবে বলে। সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত লেকচার ক্লাসগুলো করার পর আধা ঘণ্টা গ্যাপ হাসপাতালে ওয়ার্ড প্লেসমেন্টে ক্লিনিক্যাল ক্লাসের জন্য। এর মধ্যে একসঙ্গে এত ছাত্রছাত্রী নাশতা করতে গেলে ক্যানটিনে হুলুস্থুল পড়ে যায়। লেকচার ক্লাসগুলো শেষে ক্যানটিনে এলে রওশন মামা অনুযোগ করে বললেন, ‘আপনার দুই দোস্তরে কইলাম, দেরি কইরা ক্লাসে আইসা ঢুকতে পারতেছেন না, সমস্যা নাই। চলেন, আমি সোবহান স্যারের ক্লাসে ঢোকাইয়া দিই। দুজনে নাকেমুখে নাশতা গুইজ্জা ক্যানটিন থাইক্যা পলাইছে!’

২.

ঈদের ছুটি শুরু হয়ে গেছে। পরীক্ষার চাপে সময়মতো ট্রেনের টিকিট করতে পারিনি। কখনোই বাসে লং রুটে আসা–যাওয়া করিনি। এই প্রথম রাত আটটায় জাহাজ কোম্পানির মোড় থেকে বাসে উঠে মনটা শুধু খচখচ করছে আব্বার সাবধান বাণী না শোনার জন্য। আব্বা সব সময়ই ট্রেনে আসা–যাওয়ার পক্ষে। এই বাসে আমার আরেক বন্ধু মোস্তাক আছে। সে ঠিক আমার উল্টো—সব সময়ই বাসে যাতায়াত করে; পারতপক্ষে ট্রেনে যায় না। সন্ধ্যা সাতটা থেকে সাড়ে সাতটায় কখনোই ডিনারের চিন্তাও করিনি। খিদেয় পেট চোঁ–চোঁ করছে। উঁচু–নিচু ও ভাঙাচোরা রাস্তা দিয়ে বাসটি ঢাকার দিকে যাচ্ছে। সামনে নগরবাড়ী ঘাট। ড্রাইভার সাহেব ভেতরের লাইট বন্ধ করে প্রথমে হিন্দি গজল–সিনেমার গান ছেড়ে দিয়েছেন। বেশ কয়েকজন যাত্রী মাঝেমধ্যে বাংলাদেশ বেতারের ‘অনুরোধের আসর’ অনুষ্ঠানের মতো বিভিন্ন গানের অনুরোধ করে যাচ্ছেন। সুপারভাইজার তাঁর সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত হিন্দি শেষ করে বাংলায় চিত্রা সিং–জগজিৎ সিং পার হয়ে ডলি সায়ন্তনীতে এসে ঠেকল। হালে ডলির ‘রং চটা জিনসের প্যান্ট পরা’ গানটা খুব চলছে। ধুমধারাক্কায় বেশ বিরক্ত লাগছে, ঘুমাতে পারছি না। কিছু কিছু বোদ্ধা যাত্রী সমানে সিগারেট চালিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কখন ঢাকা যাব, কখন নগরবাড়ী ঘাট আসবে। একসময় অপেক্ষার শেষ হয়। নগরবাড়ী ঘাটে বাস থেকে নেমে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। বিরাট ব্যাপার–স্যাপার। এই রাত সাড়ে ১২টা, পৌনে ১টায় এত আলো, এত মানুষের হল্লায় আমি বেশ ইম্প্রেসড!

একদিকে টেপরেকর্ডার বাজিয়ে গোল হয়ে মজমা জমিয়েছে এক ক্যানভাসার। সঙ্গের বন্ধু নগরবাড়ী ঘাটে আমার ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা ফুরাইছে’ অবস্থা দেখে হাত ধরে টেনে একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে ডিম–পরোটার অর্ডার দিল, আমাকে মৃদু ভর্ৎসনা করল, ‘আবুল একটা’ বলে। খেতে খেতে সবক দিল, ‘জীবনে তিনতলা–চারতলা ফেরিতে উঠেছিস?’ মাথা নেড়ে না বলাতে বলল, ‘ফেরিতে বাস ওঠার সময় বাসের ভেতর থাকবি না, একা একা ডেকে আর ক্যানটিনে যাবি না। দরকার হলে ফেরিতে বাসের ভেতর ঘুমাবি, প্রচুর চোর, বাটপার, জুয়াড়ি ঘুরে বেড়ায় ফেরিতে।’ ঘাটে কীভাবে দুটি পাটাতনের ওপর ভর করে বড় বড় বাস–ট্রাক একটার পর একটা উঠে যাচ্ছে দেখতে লাগলাম। মোস্তাককে অনুরোধ করলাম ‘চলো বন্ধু, ফেরিটা ঘুরে দেখি।’

সার্চলাইট দিয়ে পথ দেখে দেখে ফেরিটা আরিচা ঘাটের কাছে পৌঁছে গেছে। আবার বাসে ঢুকে কতক্ষণের জন্য অন্তরিণ থাকতে হবে, কে জানে? আকাশে সুবহে সাদিকের হালকা আলো দেখা যাচ্ছে। বাসে উঠতেই ড্রাইভার সাহেব ছেড়ে দিলেন, ‘আমি বন্দী কারাগারে, আছি গো মা বিপদে বাইরের আলো চোখে পড়ে না।’ পয়েন্টে পয়েন্টে মিলিয়ে ড্রাইভার সাহেব কীভাবে এই গান সিলেক্ট করলেন, চোখ বুজে ভাবার চেষ্টা করলাম।

*লেখক: আসফাক বীন রহমান, সহযোগী অধ্যাপক, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ, গাজীপুর।

‘নাগরিক সংবাদ’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]