হোস্টেল বনাম বাড়ি: রাজার মেয়ের দিনগুলো

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

প্রতিবার হোস্টেলে আসার প্রথম দিনেই অনুভব করি, আমি মাত্রাতিরিক্ত হোমসিক। এই হোমসিকনেস আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। বাসায় গেলে স্পেশালি সেমিস্টার ব্রেকে, আমি চিন্তা করার কিছু পাই না। সারা সময় শূন্য মাথা নিয়ে ঘোরাফেরা করি।

সকাল হয় মায়ের ডাকে। মা ঘুমের মধ্যেই জিজ্ঞাসা করে, নাশতায় কী খাব। ঘুম ঘুম মনে যা আসে, তা–ই বলে দিই চিন্তা না করেই। বেলা ১১টায় ঘুম থেকে ওঠার পর দেখি ঘুমের ঘোরে বলা খাবার রেডি, খাবার শেষে ঘন দুধ–চাও টেবিলে রেডি। মা হাসি হাসি মুখে কি সুন্দর এটা–সেটা এনে দেয়। যতই বলি না কেন, এত ঝামেলার কোনো দরকার নেই, আমি সকালে নাশতা এমনিতেও খাই না। কে শোনে কার কথা?

অদ্ভুতভাবে বাসায় গেলে আমার আচার–আচরণ হয়ে যায় রাজার মেয়ের মতো। রাতের বেলা ভাত খেতে ইচ্ছা করে না; ইচ্ছা করে তেহারি খেতে, র‍্যামেন খেতে। পরোটা আর কাবাব, খিচুড়ি, স্ন্যাকস, আইসক্রিম, সেমাইসহ যত উদ্ভট উদ্ভট ক্রেভিংস। বাবা কখনোই খালি হাতে আসে না, কীভাবে কীভাবে যেন কিছু না কিছু হাতে করে আনেই, যা যা আমার পছন্দ। আদরে–আহ্লাদে রাজার মেয়ে আরও মাথায় উঠে যায়।

ছুটির দিনগুলোয় বিকেল কাটে নীরসভাবে...বেকার বসে গুনগুন করতে করতে বারান্দায় যাই বই হাতে। আনমনেই ভাবি, এক মগ চা হলে মন্দ হতো না...তখনই আচমকা মা মগভর্তি চা এনে সামনে দেয়। অস্ফুট স্বরে বলে উঠি, ‘আম্মু, তুমি কীভাবে জানলা আমার এখনই চা দরকার ছিল?’

এসব এক–দুই দিনের ঘটনা নয়; বরং প্রায়ই ঘটে যাওয়া ‘সুন্দর’ ঘটনার একাংশ।

আমার ঘরের সামনে নদী থাকায় সারা দিন উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো বাতাস আসে। কারণে–অকারণে আমার মন হয় উদাস। মন উদাস লাগলে বাবার ঘরের দিকে হাঁটা দিই। গন্তব্য যত কাছে আসে, ঘর থেকে পুরোনো দিনের সফট মেলোডি ততই জোরালো হয়ে কানে আসতে থাকে। এরপর যা হয়, তা ম্যাজিক। আমি ভুলে যাই কী বলতে গিয়েছিলাম। আমি ভুলে যাই আমার কোন কারণে মন খারাপ ছিল। কখনো কখনো সভায় যোগ দেয় মা। হাসাহাসি, কৌতুকহাস্যের এক পর্যায়ে হুট করে খেয়াল হয়, অনেক সময় পর যেন আমি হাসলাম, বহু সময় ধরে মন খারাপ ছিল এবং তখন অদ্ভুতভাবে আমার মন খারাপের কারণটাও আর অত বড় কারণ বলে মনে হয় না; বরং ভাবি, এত ছোট একটা ব্যাপার নিয়ে আমি এতক্ষণ মন খারাপ করে উল্টো নিজেকেই কষ্ট দিচ্ছিলাম!

চোখ বন্ধ করলে এখনো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমার বাসার অদূরে বুড়িগঙ্গা নদী। যেখানে সারা দিনই ডিঙিনৌকা ভেসে বেড়ায়। রাতে যায় চারদিক আলোকসজ্জিত জমকালো লঞ্চ।

সন্ধ্যার পরপরই চারদিক ছেয়ে আসে সুনসান নীরবতা। যত দূর চোখ যায়, তত দূর নারকেলগাছ, আমগাছ, কাঁঠালগাছ, মিম আপুর লাগানো বড় বড় নিমগাছ আর ওই অদূরে নদী।

রাত গভীর হয়। নাকে আসে ভেজা মাটির সোঁদা ঘ্রাণ। দূর থেকে পাই নাম না–জানা ফুলের মাথা ধরানো সুঘ্রাণ।

গভীর রাত আরও গভীর হয়, ব্যাঙের ডাক তীব্র থেকে তীব্রতর হয়...আমি খুঁজতে থাকি কোথা থেকে আসে এই ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। খুঁজতে খুঁজতে জাগতিক কত রকম চিন্তা আসে মনে! ভুলে যাই, আমি কী খুঁজছিলাম...

কয়েন পুরোপুরি উল্টো যায় আমি যখন ছুটি শেষে হোস্টেলে আসি।

‘নাগরিক সংবাদ’–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]

চারদিকে যেন দম বন্ধ করা পরিবেশ। থাকতে হয় জানালা–দরজা বন্ধ করে, নয়তো মশার উপদ্রব সহ্য করতে হবে অথবা সহ্য করতে হবে হাজারো গাড়ির অসহনীয় শব্দ। উত্তরের ঘর দিয়ে সব সময় আগুনের উল্কা বয়ে যায়। ঘরে দম আটকে এলে একবার যেয়ে দাঁড়াই বারান্দায়, কিন্তু রাস্তায় গাড়ির শব্দে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাও যেন দায়। গরমে অতিষ্ঠ হয়ে একপর্যায়ে মনকে সান্ত্বনা দিই, এই তো আর কয়েকটা দিন...

বাসার মতো এখানে মা জিজ্ঞাসা করে না, কী খাব। জোগাড় করতে হয় নিজেকেই। এক বেলা খাবার খেলে পরের বেলা কী রান্না করব, এই টেনশন থাকে মাথায়। এক দিন কতটুকু রান্না করলে পরের তিন দিন অনায়াসে খাওয়া যাবে, এ–ও ভেবে ভেবে সারা হই। কী রাঁধব, কাল কয়টায় বাসায় আসব, যাওয়ার আগে কী খেয়ে যাব, এসে খাওয়ার জন্য কী রেডি করে যাব, এসব ভাবতেও উল্টো প্যাঁচ খেয়ে যাই।

এখানে এলে বুঝি, ‘কী রান্না করব বা কী খাব’—এটাও মস্ত টেনশনের একটা পার্ট।

বাজার আর দোকানের জিনিসের দামের ব্যাপারে আমার আইডিয়া বরাবরই কম। এখানে এসেই মূলত নিজের কেনাকাটা নিজেকেই করতে হয়। কিনতে গেলে হাত ওঠে মাথায়। এক হালি ডিমের এত দাম! একটা ছোট পেস্টের দাম ৫০ টাকা! পেঁয়াজের দাম এত! একটা ছোট্ট লাউ ১৩০ টাকা! বাজারে গেলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকি।

হিসাব করে চলা শিখি, আবদার কমাই।

ছোটবেলায় রেগে গিয়ে আম্মুকে বলতাম, একটু খালি বড় হই, আর থাকব না এ বাসায়। জীবনেও আর আসব না। But i forgot, ‘Man proposes, God disposes.’ এখন আমি ঠিকই বাইরে থাকি, আর মন পড়ে থাকে বাসায়।

যাক। কেন লিখতে বসেছি?

মায়ের রান্না করা গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাচ্ছিলাম। বাসায় থাকাকালে এই মাংস দিয়ে আমি সন্ধ্যা থেকে কমপক্ষে তিনবার ভাত খেয়েছি। অথচ সেই একই মাংস প্রথম লোকমায় এত বিস্বাদ লাগল যে পরেরটুকু কোনোরকমে গিলে খেলাম। আশপাশে মা না থাকলে খুব মজাদার খাবারও মুখে রোচে না। লাগে জঘন্য, অত্যন্ত বিস্বাদ।

*লেখক: ফাহিমা আক্তার ঊর্মি, শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়