সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফলসিফিকেশন: ‘অনলাইন পরিচয়’ কেবলই একটা মাস্ক
নেটিজেনদের দ্বৈত আচরণ, একজন ব্যক্তির দুটি জীবন—একটি স্ক্রিনের এপারে, আরেকটি ওপারে। ভার্চ্যুয়ালি প্রবলভাবে আদর্শবাদী, বিভিন্ন সামাজিক ইস্যু নিয়ে প্রতিবাদ করেন। কিন্তু বাস্তব জীবনে আচরণ ঠিক উল্টো রকম দেখা যায়। অফলাইনে তিনি এসব ইস্যুতে জড়ানোর খুব একটা আগ্রহ পান না।
আবার অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুর্নীতির বিরুদ্ধে মোটিভেশোনাল আর মুখরোচক বক্তব্য লিখে সুকৌশলে কিছু লাইক, শেয়ার বা কিছু ভিউ কামাচ্ছে অথচ নিজেরাই সুবিধাবাদী চর্চার অপ্রস্তুত অবস্থা লুকাতে ব্যর্থ।
ভার্চ্যুয়াল জগতে কেউবা পরিবেশবাদী বা আদর্শিক নাগরিক কিংবা পরিবেশ সংরক্ষণের ডাক দেওয়া একজন সচেতন ব্যবহারকারী অথচ বাস্তবে সেই ব্যক্তিই প্লাস্টিকের ব্যবহার কমান না।
অনলাইনে অনেকেই মানবাধিকারকর্মী, কিন্তু বাস্তবে তাদের আচরণেই ফুটে উঠে বিপরীত চিত্র; হয় প্রতিবেশীর অধিকার লঙ্ঘন করছে নয়তো সামাজিক অঙ্গীকার এড়িয়ে যাচ্ছে। অনলাইনে নারীবাদী বক্তৃতা দেওয়া কেউবা অফলাইনে লিঙ্গবৈষম্য রোধে যথাযথ ভূমিকা রাখেন না।
ডিজিটাল যোগাযোগের গতি আমাদের দূরত্ব কমিয়েছে ঠিকই, কিন্তু এর মূল্য চুকিয়েছে মানবিক আবেগ। চ্যাটবক্সে ‘হাসি ইমোজি’ পাঠালেও বাস্তবে কারও চোখের জল মুছতে পারি না আমরা। সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ভার্চ্যুয়াল সম্পর্কের স্থায়িত্বও প্রশ্নবিদ্ধ!
ডিজিটাল ও বাস্তব পরিচয়ের দ্বন্দ্ব আধুনিক জীবনে এক অন্য রকম উদ্বেগ আর অস্থিরতার সৃষ্টি করে। বাস্তবে একজন মানুষের পরিচয় স্থিতিশীল, পরিবার-সমাজ-পেশার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা। অন্যদিকে, অনলাইন পরিচয়ের ক্ষেত্রে ‘সেলফ-কারেন্সি’—নিজেকে সাজানো, মসৃণ করা, এমনকি মুছে ফেলার সুযোগ। অনলাইনে এক, বাস্তবে আরেক। এই দ্বৈততা মানুষকে প্রশ্নের মুখে ফেলছে, ‘কোনটি আসল আমি?’
মনস্তাত্ত্বিক পলায়ন
সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা প্রায়ই ‘ফিল্টার্ড রিয়েলিটি’ তৈরি করেন, যেখানে ব্যর্থতাগুলো লুকিয়ে শুধু সাফল্যের গল্প শেয়ার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একজন ব্যক্তির ‘ডিজিটাল স্ব’ এবং ‘বাস্তব স্ব’-এর ক্রমবর্ধমান তফাত সমাজের সংবেদনশীল বিতর্কের কেন্দ্রে। ক্রমাগত তুলনা (Social Comparison Theory) এবং ‘পারফেক্ট লাইফ’-এর চাপ উদ্বেগ, বিষণ্নতা বা স্বমূল্যায়নে ঘাটতির জন্ম দেয়।
এক জরিপে দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৪ জন কিশোর-কিশোরী প্রায়ই বা মাঝেমধ্যে এমন বিষয় পোস্ট করা থেকে বিরত থাকে, যা তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে (৪০ শতাংশ)। অন্যদিকে, ৩৮ শতাংশ কিশোর-কিশোরী নিজেদের ইমেজ বা ব্যক্তিত্বের সঙ্গে খাপ না খাওয়ার ভয়ে পোস্ট না করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ডাবল স্ট্যান্ডার্ড
অন্যের ভুলে রাগ, নিজের ভুলে নীরবতা: কিছু নেটিজেন অন্যদের ছোটখাটো ভুলের জন্য চরম আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠেন, অথচ নিজেরাই যখন একই ধরনের কাজ করেন, তখন সাধারণত যুক্তি দাঁড় করান বা সামান্য বিষয় মনে করে বিষয়টিকে সহজভাবে এড়িয়ে যান।
ডিজিটাল পাবলিক শেমিং: কোনো ইস্যুতে সমালোচনার ঝড় তুললেও কিছু সময় পর সেই একই অপরাধ বা অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের সমর্থন করেন।
পরিবর্তনশীল নৈতিক মানদণ্ড: পরিচিত বা পছন্দের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে একরকমের নৈতিকতা আর অপরিচিত বা অপছন্দের ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে অন্য রকমের নৈতিকতা চর্চা করা হয়।
ফিল্টার বুদ্বুদ
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃত পরিশ্রম এবং দক্ষতার চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় পারফেক্ট লাইফ, চমকপ্রদ ছবি, ভিডিও বা বাহ্যিক জাঁকজমক (লাক্সারিয়াস লাইফস্টাইল, ভাইরাল হওয়া, লাইক, ভিউ, ফলোয়ার)।
ফলসিফিকেশন বা সাজানো বাস্তবতা তরুণদের মনে আত্মবিশ্বাসের অভাব, হতাশা ও মানসিক চাপ তৈরি করছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় আমরা বেশির ভাগই অন্যদের সাফল্যের গল্প, বিলাসবহুল জীবনধারা, নিখুঁত সম্পর্ক এবং আনন্দময় মুহূর্ত দেখে থাকি। কিন্তু এর পেছনের বাস্তবতা খুব কমই প্রকাশ পায়। এই ফলসিফাইড জীবনধারা দেখে তারা মনে করে যে তাদের জীবনটি কেবল কষ্ট বা সংগ্রাম নিয়ে নয়, বরং সাজানো- গোছানো আর গতিশীল হওয়া উচিত। এর ফলে তারা নিজের জীবনের প্রতি অনুশোচনা বোধ করে এবং অন্যদের মতো দেখতে চায়। তাদের বোঝা দরকার, এখানে কেবল আকর্ষণীয় অংশগুলো তুলে ধরা হয়। সম্পাদিত ছবি, সাজানো ক্যাপশন, কৃত্রিম হাসি এবং লাইক-কমেন্টের প্রতিযোগিতা তরুণদের মনে একধরনের অবাস্তব প্রত্যাশা তৈরি করছে। এই বুদ্বুদ ভাঙতে না পারলে, তরুণরা নিজেদের প্রতি হতাশ হয়ে পড়তে পারে।
সেলফ ব্র্যান্ডিং
বর্তমান সময়ে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে তারকা হওয়া যেন অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে। একাধিক টিকটক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব বা ফেসবুকের মাধ্যমে যাঁরা শুধু তাঁদের সেলফি, অশ্লীল ভিডিও অথবা চটকদার পোস্টের মাধ্যমে ক্ষণস্থায়ী মনোযোগ আকর্ষণ করে পরিচিতি লাভ করছেন।
তারা সামাজিক মাধ্যমকে মূলত তাদের ব্যক্তিগত ব্র্যান্ড তৈরি করার মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করছে কিন্তু এর জন্য কোনো শিল্পচর্চা, সৃজনশীলতা বা দক্ষতা প্রয়োজন হয় না। বরং তাদের কনটেন্টের ধরন শখ, বিনোদন কিংবা ‘হিট’ পাওয়ার লক্ষ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। কনটেন্ট যা–ই হোক, একরকমের ‘হইচই’ সৃষ্টি করতে পারলেও তাতে শিল্পের কোনো গভীরতা বা পেশাদারত্ব পাওয়া যায় না।
আবার অনেকেই দ্রুত জনপ্রিয়তার শিকার হয়ে নানা ধরনের আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসছে। সম্প্রতি এক টিকটক তারকা (সম্মানপূর্বক নাম গোপন করা হলো) চ্যানেল স্টুডিওতে উপস্থিত হন, যেখানে উপস্থাপিকা মিডিয়া ইন্ডাস্ট্রি ও শিল্প সম্পর্কে প্রশ্ন করলে তিনি সঠিক উত্তর না দিয়ে মন্তব্য করেন, ‘আমি একজন নায়িকা, উপস্থাপিকার কাছে ক্লাস করতে আসিনি এবং শিল্প সম্পর্কে কোনো একাডেমিক শিক্ষা নেই।’
এই ধরনের মন্তব্য থেকে স্পষ্ট যে তিনি মিডিয়া শিল্পের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা বা গভীরতা অনুভব করেন না। এর মাধ্যমে তিনি নতুন প্রজন্মকে যে বার্তা দিয়েছেন, তা একেবারেই ভ্রান্ত। তরুণেরা যদি মনে করে যে মিডিয়া শিল্পের কোনো একাডেমিক শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা ছাড়া জনপ্রিয়তা অর্জন করা সম্ভব, তাহলে তারা শিল্পের প্রকৃত মূল্য বা তার গুরুত্ব সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবে না।
নারীদের উদ্বেগ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্যপ্রবাহ যত সহজ হয়েছে, ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের প্রসারও ততই বেড়েছে। যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেক কিছু ভাইরাল হয়ে যায়। অনেক সময় ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য ছড়ানো হয়, আবার কখনো অজ্ঞতা বা অসাবধানতার কারণেও এটি ঘটে। বিশেষ করে নারীরা এই তথ্য বিভ্রাটের কারণে বেশি শঙ্কিত বোধ করছেন। কারণ, স্বাস্থ্য, পরিবার, শিক্ষা ও নিরাপত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভুল তথ্য তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বাধা তৈরি করতে পারে।
সম্প্রতি পিউ রিসার্চ সেন্টারের গবেষণায় দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ নারী বিশ্বাস করেন, অনির্ভরযোগ্য উৎস থেকে প্রচুর ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানো হয়। এই ভুল তথ্যের আধিক্য অনেক সময় মানুষকে যাচাইকৃত ও বিশেষজ্ঞদের দেওয়া তথ্য এড়িয়ে যেতে বাধ্য করে, যা সমাজের জন্য উদ্বেগজনক।
ফলসিফিকেশন বা তথ্য বিকৃতি একাধিক স্তরে কাজ করে। এর অন্যতম কারণ ডিপফেইক প্রযুক্তি, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে ভিডিও বা অডিও পরিবর্তন করা হয়।
এ ছাড়া আছে মিথ্যা সংবাদ। অনেক সময় জনপ্রিয় নিউজ পোর্টালের আদলে তৈরি করা ভুয়া ওয়েবসাইট বা সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলো বিভ্রান্তি ছড়ায়। অন্যদিকে, অ্যালগরিদমিক বায়াস এক নতুন ধরনের বিকৃতি সৃষ্টি করছে। ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো ব্যবহারকারীদের পছন্দের ভিত্তিতে কনটেন্ট সাজায়। কিন্তু অনেক সময় এই অ্যালগরিদম মিথ্যা ও চটকদার খবরকে বেশি প্রচার করে; কারণ, এগুলো বেশি ‘এনগেজমেন্ট’ তৈরি করে। ফলে ভুল তথ্য আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছায়।
তথ্যের এ যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একদিকে যেমন গণতন্ত্র ও মতপ্রকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, তেমনি এটি ভুয়া ও বিকৃত তথ্য ছড়ানোরও অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ করতে হলে সচেতনতা, আইন ও প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে হবে। নাহলে সত্য-মিথ্যার পার্থক্য করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে, যেখানে আমরা আর বাস্তবতাকে চিনতে পারব না।
*লেখক: শিউলী আকতার জেমি