ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে কাজে লাগাতে হবে
কেমন হবে যদি পুরো একটি জাতি সম্মিলিতভাবে আলাদিনের চেরাগের মতো মহামূল্যবান কিছু একটা পেয়ে যায়? আর আপনি ওই জাতির এক গর্বিত সদস্য। অতঃপর, ওই জাতি আলাদিনের চেরাগ ব্যবহার করে পুরো জাতিকে উন্নত, মার্জিত ও সমৃদ্ধ করে তোলে। রূপকথার গল্পের মতো শোনালেও বাস্তবে আপনি এমনই এক জাতির সদস্য, যারা আলাদিনের চেরাগের মতোই মহামূল্যবান ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ নামক সম্ভাবনাময় সময়ে উপনীত হয়েছে।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের (ইউএনএফপিএ) মতে, একটি দেশে কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কর্মে অক্ষম মানুষের সংখ্যার চেয়ে বেশি হলে তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল বলে। সাধারণত একটি দেশের জনসংখ্যার কর্মে অক্ষম (শূন্য-১৪ বছর ও ৬৫+ বছর) মানুষের সংখ্যা ৪০ শতাংশের কম এবং কর্মক্ষম (১৫ থেকে ৬৪ বছর পর্যন্ত) মানুষের সংখ্যা ৬০ শতাংশের বেশি হলে তাকে জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল বলে। একটি জাতি কয়েক শত বছরে একবার এই জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকাল পেয়ে থাকে।
ছোটবেলায় পড়েছি বাংলাদেশ বহু সমস্যায় জর্জরিত। জনসংখ্যা বৃদ্ধি এসব সমস্যার অন্যতম। অথচ জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত এ অভিশাপই এখন বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ। একসময়ের সমস্যাই এখন সম্পদে পরিণত হতে যাচ্ছে। কারণ, বর্তমানে বাংলাদেশে বেশির ভাগ মানুষই কর্মক্ষম। অবশ্য প্রখ্যাত ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ টমাস রবার্ট ম্যালথাস জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে সমস্যা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন। ম্যালথাসের জনসংখ্যাতত্ত্বমতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারে (১, ২, ৪, ৮, ১৬, ৩২...), অন্যদিকে খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি পায় গাণিতিক হারে (১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬...)। ম্যালথাসের মতে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে একটি দেশ খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়বে। তাই জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন। স্বাধীনতার সময় বাংলাদেশের কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা ছিল ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। এই ৩০ শতাংশ মানুষের ওপর ভর করে চলত পুরো জাতি। অর্থাৎ এই ৩০ শতাংশ মানুষকেই পুরো জাতির চাহিদা পূরণ করতে হতো, যা ছিল অত্যন্ত কঠিন কাজ। ২০০৭ সাল থেকে বাংলাদেশের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি হয়। অর্থাৎ ২০০৭ সালেই ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের যুগে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড সাধারণত ৩০ থেকে ৪০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়ে থাকে। ধারণা করা হচ্ছে যে বাংলাদেশে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময়কাল ২০৩৯ সাল পর্যন্ত থাকবে।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড একটি অপার সম্ভাবনাময় সময়। এ সময় কর্মক্ষম মানুষের আধিক্য থাকায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করা অত্যন্ত সহজ হয়ে থাকে। এ সময়কে কাজে লাগিয়েই জাপান, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়াসহ বহু দেশ সমৃদ্ধি লাভ করেছে। সমৃদ্ধির জন্য দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালকে কাজে লাগাতে হলে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে সুনজর দিতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটে শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, শিক্ষা, প্রযুক্তি ও স্বাস্থ্য খাতে আরও বেশি করে বরাদ্দ ও সরকারের সুনজর দেওয়া উচিত। একই সঙ্গে জনশক্তির দক্ষতা উন্নয়নমূলক খাতগুলোয় সরকারের সুদৃষ্টি পড়লে গড়ে উঠবে সুখী, সমৃদ্ধ ও আধুনিক বাংলাদেশ।
আবার, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে যথাযথভাবে কাজে লাগাতে না পারলে এর পরিণতি অত্যন্ত ভয়াবহ হয়ে থাকে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সময় যে বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী কর্মক্ষম ছিল, ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড শেষ হয়ে যাওয়ার পর দেখা যায়, সেই বিশালসংখ্যক জনগোষ্ঠী বার্ধক্যে উপনীত হয়ে কর্মে অক্ষম হয়ে গেছে। তখন এই বিশাল জনগোষ্ঠীর পেনশন ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতে রাষ্ট্রকে বহু অর্থ ব্যয় করতে হবে। যদি জনসংখ্যাতাত্ত্বিক বোনাসকালকে কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধি অর্জন করা যায়, তাহলে এই ব্যয় নির্বাহ করা সম্ভব হবে। অন্যথায় রাষ্ট্রকে এক কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।
সুতরাং আমাদের সবাইকে চলমান অপার সম্ভাবনাময় সময়কে কাজে লাগাতে বাংলাদেশে দক্ষ জনশক্তি, মূল্যস্ফীতি রোধ, কারিগরি শিক্ষার প্রসারে কাজ করে যেতে হবে। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে উদ্দেশ্য করে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগ বেশি বেশি নেওয়া হলে বাংলাদেশ তড়িৎগতিতে সমৃদ্ধি লাভ করবে। এ সময় দুর্নীতি রোধ, অস্থিরতামুক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি, প্রশাসনের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্য বন্ধ করা আবশ্যক। তাহলেই গড়ে উঠবে আমার–আপনার স্বপ্নের সোনার বাংলা।
*লেখক: মো. মুমিনুল ইসলাম, শিক্ষার্থী, ঢাকা কলেজ