নব্বই দশকের শৈশব: অমলিন স্মৃতির সোনালি দিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নব্বই দশকের শৈশব—কথাটি শুনলেই যেন মনের গহিনে জমে থাকা একরাশ স্মৃতি ভিড় করে আসে। মাঠে খেলাধুলা, বন্ধুদের সঙ্গে নিবিড় আড্ডা, আর স্কুলে যাওয়ার আগে বাবার কাছ থেকে সামান্য আবদার করে টাকা আদায় করার সেই দিনগুলো আজও চোখের সামনে ভেসে ওঠে। সময় বদলেছে, জীবনযাত্রাও হয়েছে আধুনিক; কিন্তু তখনকার সেই সরল আনন্দের অনুভূতি আর মেলে না। যখন আজকের শিশুরা স্ক্রিনের সামনে সময় কাটায়, তখন আমাদের শৈশব কেটেছে মাঠেঘাটে, মুক্ত প্রকৃতির মাঝে।

​কিলোমিটারের পথ ও স্কুল মাঠের উৎসব ​

প্রাইমারি স্কুলে ভর্তির পর থেকেই শুরু হতো বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে দুই কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়া। লম্বা রাস্তা, কিন্তু হাসি-গল্পে তা মুহূর্তেই ফুরিয়ে যেত।

খেলা আর খাবার: স্কুল মাঠে আমাদের প্রিয় খেলা ছিল লুকোচুরি। টিফিনের সময় বসত নানান দোকান—সেখান থেকে মন যা চাইত কিনে খেতাম। নারকেল আইসক্রিম চকবার, পাপর ভাজা আর বুটভাজা ছিল সেরা আকর্ষণ।

লটারি আর হিরোগিরি: বন্ধুরা মিলে লটারি কাটতাম। যদিও বেশির ভাগ সময় সামান্য কম দামি জিনিস জুটত, তবু সেই আনন্দ ছিল অমূল্য। টিফিন সময়ে বান্ধবীদের চোখে ‘হিরো’ সাজার জন্য বন্ধুদের মধ্যে যে মজার মারামারি হতো, তা ছিল আমাদের শৈশবের দুষ্টুমিষ্টি অংশ।

বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা: এটি ছিল বছরের সবচেয়ে বড় উৎসব। নতুন পোশাকে সেজেগুজে আসা, স্কুল মাঠকে রঙিন কাগজ আর বেলুনে সাজানো—যেন এক অন্য রকম মেলা। দৌড়, লং জাম্প, হাই জাম্পের প্রতিযোগিতা চলত দিনভর। আমি সব সময় প্রথম না হলেও, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার নির্মল আনন্দটাই ছিল আসল পুরস্কার!

বিকেল মানেই মুক্তি: খেলার জগৎ

বিকেল ছিল আমাদের সবচেয়ে প্রিয় সময়। স্কুল আর প্রাইভেটের বাঁধাধরা রুটিন শেষ হলেই মন ছুটত মাঠের দিকে।

আড্ডা আর ক্লান্তি দূর করা: মাঠে গিয়ে সারা দিনের ক্লান্তি দূর হতো। খেলাধুলা, আড্ডা আর মজার মজার গল্পে মেতে উঠতাম আমরা।

রাস্তার পাশে বিনোদন: রাস্তার পাশে বায়োস্কোপ দেখতাম। হরেক রকম মিষ্টি বিক্রেতারা মাথা করে ঘুরে বেড়াত, ২ টাকা দিয়ে কিনে খেতাম সেই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টিগুলো। এসব স্মৃতি আজও চোখে জল এনে দেয়।

আলো-আঁধারের জীবন ও প্রযুক্তির সরলতা ​

নব্বই দশকে আজকের মতো আধুনিক প্রযুক্তি ছিল না, ছিল একধরনের সরলতা যা জীবনকে এক ভিন্ন আঙ্গিকে উপভোগ করতে শিখিয়েছিল।

তৎকালীন জীবনযাত্রা

বিদ্যুতের অভাব: হারিকেন বা চেরাগ জ্বালিয়ে লেখাপড়া ও দৈনন্দিন কাজ করা হতো।

যোগাযোগে বিলম্ব: একটি চিঠি পৌঁছাতে ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লাগত।

বিনোদন: একটি মহল্লায় হয়তো একটি টিভি ছিল, যা ছিল সামাজিক মিলনক্ষেত্র।

বর্তমান জীবনযাত্রা

প্রযুক্তি ও দ্রুততা: ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ। দ্রুতগতির আধুনিক প্রযুক্তির কল্যাণে সারা বিশ্বের তথ্য এখন হাতের মুঠোয়।

যোগাযোগে গতি: মুহূর্তেই মুঠোফোনের মাধ্যমে সারা বিশ্বে যোগাযোগ স্থাপন।

বিনোদন: সবাই ব্যক্তিগত স্ক্রিনে ব্যস্ত। শিশুরা মুঠোফোনে মুখ গুঁজে থাকে।

সামাজিক বন্ধন ও হারিয়ে যাওয়া অনুষঙ্গ

টিভি দেখার অভিজ্ঞতা ছিল এক অসাধারণ সামাজিক উৎসব। মহল্লার একমাত্র টিভিটির সামনে বৃহস্পতি ও শুক্রবার বিটিভিতে বাংলা সিনেমা দেখার জন্য দুপুর থেকেই সবাই অপেক্ষা করত। আর শুক্রবার রাত আটটায় ‘আলিফ লায়লা’ দেখার জন্য মহল্লার মানুষ ভিড় জমাত—সেই একসঙ্গে বসে টিভি দেখার অনুভূতি সত্যিই অসাধারণ!

​আজ যখন হাতে হাতে মোবাইল, তখন

পত্রিকার চাহিদা কমে গেছে, হারিয়ে গেছে পত্রিকার হকারদের সেই পরিচিত হাঁকডাক।

ডাকপিওনদের সাইকেলের বেলের ‘ক্রিং ক্রিং’ শব্দ আর বাড়ি বাড়ি চিঠি পৌঁছে দেওয়ার দৃশ্য বিলুপ্ত হয়েছে।

সেই দিনগুলো আর ফিরে পাব না, কিন্তু সেই স্মৃতিগুলো এখনো আমাদের হৃদয়ে অমলিন। হারিয়ে যাওয়া বন্ধু-বান্ধব এবং সেই নব্বই দশকের প্রতিটি মুহূর্ত আজও বেঁচে আছে আমাদের মনে।

যখন বিকেল নামে, পাখিরা বাসায় ফেরে, মৃদুমন্দ বাতাস বয়—তখন সেই নব্বই দশকের শৈশবের স্মৃতিগুলো আরও বেশি করে মনকে ছুঁয়ে যায়।

*লেখক: মো. আজাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ ঢাকা।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]