কৃষক ছাড়া ভবিষ্যতে দেশ বাঁচাবে কে

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সবাই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে আজকাল ব্যাপক আলোচনা–সমালোচনায় মেতে উঠেছেন। এটা সরকার পতনের প্রধান টার্গেট হিসেবেও অনেকে বেছে নিয়ে মাতামাতি করছেন সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এর পেছনের মূল হোতা কে, প্রধান কারণ কী? কোন জায়গায় এর সমস্যা শুরু? এর প্রতিকার কীভাবে করতে হবে? এসব কথা কেউ কি একবারের জন্যও ভেবেছেন?

নিশ্চয়ই অধিকাংশই এসব কথা কখনো চিন্তাই করেননি। অথচ চিন্তা না করেই সরাসরি সরকারের কাঁধে নিজেদের দোষ চড়িয়ে দিচ্ছি খুব সহজেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, ‘এ দেশের এক ইঞ্চি জমিও যাতে অনাবাদি না থাকে, সেদিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে।’

পৃথিবীর আদি পেশা হচ্ছে কৃষিকাজ। অর্থনীতির মূল ভিত্তি হলো কৃষি। অথচ মানুষ এখন কৃষিকে বাদ দিয়ে অর্থনীতির ওপর গবেষণা করছে। কৃষির ওপর ভর করেই প্রতিটি দেশ তথা সারা বিশ্ব পরিচালিত ও পরিবর্তিত হয়ে আসছে। অথচ আমরা একবারের জন্যও এই পরিচালনা ও পরিবর্তনের শিকড় কী, তা খুঁজতে চাইনি। পৃথিবীর জনসংখ্যা অধিকহারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে দিনের পর দিন কৃষিতে অভিজ্ঞ কৃষক কমে যাচ্ছে। এই মহামূল্যবান কৃষকেরা যে আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন, বিলীন হচ্ছেন, সেদিকে আমাদের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। জমির দাম বাড়ছে। জমিতে অধিক হারে ভবন নির্মাণ বাড়ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে বাঁচার জন্য আমরা খাব কী?

পৃথিবীর প্রত্যকে মানুষের সঙ্গে কৃষকের সম্পর্ক রয়েছে। ধনী লোকের সকালের নাশতা জ্যাম-পাউরুটি থেকে গরিব মানুষের জাউভাত—যাদের বেঁচে থাকার জন্য খাবার দরকার, তাদের প্রত্যেকেরই কৃষির সঙ্গে সম্পর্ক আছে।

আমরা সেই কৃষকের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়াই বেঁচে আছি, যাঁরা আমাদের জন্য ফসল ফলাচ্ছেন। অন্যান্য পেশার কেউ যদি বলেন, কৃষকের সঙ্গে আমাদের কিসের সম্পর্ক? কৃষক কৃষিকাজ করছেন, আমরা আমাদের পেশার কাজ করছি। তাঁদের কাছে আমার প্রশ্ন, কৃষক আর আমরা সবাই কি টাকার জন্য কাজ করি? অবশ্যই ‘না’। কারণ, অন্য পেশার মানুষকে কোনো কারণে কয়েক মাস বেতন না দিলে তখন হয়তো আগের জমানো টাকা থেকে খরচ করবেন! নয়তো সেই পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশাকে বেছে নেবেন। কিন্তু কৃষকেরাও যদি বেশি টাকার জন্য কৃষিকাজ ছেড়ে দিয়ে অন্য কোনো চাকরি করেন, তাহলে আমাদের কী হবে?

প্রতি দুই বছর অন্তর কৃষক ছাড়া বিশ্বের মধ্যে যত ধরনের পেশার মানুষ আছেন, তাঁরা বেতন-বোনাস বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করেন, এমনকি কাজও বন্ধ করে দেন। কিন্তু কৃষকেরা? তাঁর ফলানো ফসল থেকে বছরের পর বছর লাভের মুখ না দেখলেও তাঁর বপন করা প্রতিটি বীজে সারা জীবন ধরে সফলতার আশা খুঁজতে থাকেন। এমন কৃষক আর আমরা কীভাবে এক হতে পারি? এ সবকিছু শুনে বা জেনে অন্যান্য পেশার কেউ যদি বলেন, আমরা এখন পোশাক বদলে কি কৃষিকাজ করব? তবে তাঁদের জানা থাকার বা শোনার কথা, কৃষিকাজ কাপড় বদলানোর মতো এত সহজ কাজ নয়। এ পেশা হলো মাটি ও মানুষের মধ্যকার এক নিবিড় সম্পর্ক।

আমরা বর্তমানে কৃষিকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে লজ্জা পাই। আমরা অধিকাংশই মনে করি, কৃষিকাজ হচ্ছে সর্বনিম্ন পেশা আর কৃষক হচ্ছেন সমাজের সর্বনিম্ন স্তরের মানুষ। তাই এ পেশায় নতুন কেউ তৈরি হচ্ছে না। এ কারণে আমাদের চাহিদা অনুযায়ী কৃষির জোগান পাচ্ছি না। কৃষকের ন্যায্য সম্মান কেউ কোথাও দিচ্ছেও না। কৃষি ও কৃষক নিয়ে অনেকেই রাজনীতি ও দালালি করে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গিয়েছে। অথচ কৃষি ও কৃষকের কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়নি। তাঁরা আজও সমাজের অবহেলিত মানুষে পরিণত হয়ে আছেন।

কৃষকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে আর ভোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যে ভেজালের পরিমাণও বাড়ছে অত্যধিক হারে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিকিৎসার খরচটাও জুটবে না। এসবের জন্য বর্তমানে কোনো কৃষক তাঁর সন্তানকে কৃষক বানাতে চান না। বর্তমান প্রজন্মের অধিকাংশ জানেই না কৃষিকাজ কী।

কৃষকেরা একসময় সাহস নিয়ে বেঁচে থাকতেন, কিন্তু এখন তাঁরা ভয় নিয়ে বেঁচে আছেন। তিনি ফসল ফলাতে ভয় পান পানির আশঙ্কায়; যদি পানি থাকে, ফসল ঘরে তুলতে ভয় পান; আর যদি ঘরে তোলেন, তবে রক্ষা করতে ভয় পান। সেই একই ভয় নিয়ে তিনি নিজের ফসল ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট তথা দালালদের কাছে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছেন। কিন্তু দালালেরা দশ গুণ বেশি দামে বিক্রি করছে।

যার ফলে যে খাদ্য উৎপাদন করছে, তার ক্ষতি হচ্ছে। আর খাদ্যের সেই ভোক্তা হলাম আমরা সবাই।

আমরাও ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছি। আপনারা কি জানেন, এসব কেন হচ্ছে? কারণ, আমরা কৃষকদের সঙ্গে সম্পর্ক ছাড়া বেঁচে আছি।

আর এসব নিয়ে আপনারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলছেন? এই প্রশ্ন তোলা উচিত আমাদের নিজেদের কাছে নিজেদের। সরকার আসলে কারা—আমরা নই কি? কৃষকের সুরক্ষার দায় কিন্তু সরকারের একার নয়, পৃথিবীতে বসবাসকারী সবারই। এমনকি আমিও বাদ নই। এ জন্য আমি এখন থেকে কৃষিকাজে মনোযোগ দিচ্ছি, কৃষকদের সুরক্ষা ও সম্মান নিয়ে কাজ করার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন থেকে কৃষকেরা ভয় নয়, সাহস নিয়ে বেঁচে থাকবেন। বাংলাদেশের সব গ্রামের কৃষকদের প্রতি সরকারের সুদৃষ্টিও কামনা করছি। কৃষকদের প্রতি আমাদের করুণা থেকে এসব কাজ করার বিষয় নয়, নিজেদের জন্যই নিজেরা করছি বলে মনে করি। কৃষকদের প্রতি আমাদের কারও করুণার দরকার নেই, তাঁদের প্রয়োজন সম্মানের। তাঁরাও সম্মান চান, আমরা প্রত্যেকেই তাঁদের সে সম্মান দিতে বাধ্য।

যত দূরেই যাই না কেন, যত উঁচুতেই উঠি না কেন, গর্ব করে বলব, আমি একজন কৃষকের সন্তান।

সবশেষে বলতে চাই, আমি সত্যিকারের একজন মাটির মানুষ হতে চাই। কৃষির সঙ্গে যার সম্পর্ক নেই, সে কখনো মাটির মানুষ হতে পারে না। তাই আসুন, আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদের মতো আবারও মাটির মানুষ হয়ে উঠি।

  • লেখক: সাজ্জাদ হোসেন, তরুণ সংগঠক ও উদ্যোক্তা, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।