আর একটা ওভার!: নব্বইয়ের দশকের ক্রিকেটময় শৈশব
নব্বইয়ের দশক ছিল এক অন্য রকম আনন্দ, অনুভূতি এবং সোনালি দিনের সমাহার। যখন নব্বই দশকের মানুষেরা কল্পনাও করতে পারত না যে ইন্টারনেট, মোবাইল বা ভিডিও গেমের রাজত্বে হারিয়ে যাবে তাদের সেই সুন্দর মুহূর্তগুলো। বিনোদনের মূলকেন্দ্র ছিল পাড়ার সেই মেঠো পথ, ধুলোমাখা মাঠ বা গলির মোড়। স্কুল বা প্রাইভেট থেকে ফিরেই বইভর্তি ব্যাগ নামিয়ে মাঠের দিকে ছুটে যাওয়া ছিল নিত্যদিনের একটি অলিখিত রুটিন। সেই দিনের বন্ধুদের সঙ্গে খেলার দুপুরগুলো ছিল যেন এক অন্তহীন এবং সীমাহীন আনন্দের ফোয়ারা।
আমাদের শৈশবের মূল খেলা ছিল অবশ্যই ক্রিকেট। এখনো মনে পড়ে যখন প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম আমার বাল্য বন্ধু শফি আলমসহ আমরা স্কুলে যাওয়ার আগে নিত্যদিন রাবার বল দিয়ে এবং কাঠ দিয়ে তৈরি একটি ব্যাট নিয়ে খেলতাম। এভাবে আমাদের সঙ্গে আশপাশের বন্ধুবান্ধবও যোগ দিয়েছিল এবং আমাদের ক্রিকেট খেলার টিমটা হয়ে গেল শক্তিশালী। বর্তমান দিনের মতো ক্রিকেট খেলায় এত দামি ব্যাট এবং স্ট্যাম্প আমাদের ছিল না; মহল্লার গলিতে খেললে আমাদের ঘরের ওয়ালগুলো স্ট্যাম্প হিসেবে ব্যবহার করেছি। যখন মাঠে খেলতে যেতাম, আমাদের ওখানে এক বিশাল বাগান ছিল; সেই বাগানের নির্দিষ্ট একটি গাছ দাগ দিয়ে স্ট্যাম্প হিসেবে খেলতাম। আবার যখন স্কুলে ক্রিকেট খেলতাম, ব্যাগ বা ইট দিয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে খেলা করতাম। বল হিসেবে ব্যবহার হতো টেপ টেনিস বা রাবার বল, কখনো কখনো পলিথিন দিয়ে বল বানিয়ে খেলতাম। আবার টেনিস বলের চারপাশে লাল বা সাদা টেপ মুড়ে নেওয়া হতো। আর ব্যাট? সেটি হতো প্লাস্টিকের, অথবা পুরোনো কাঠ ফাটিয়ে তৈরি করা। উপকরণে আভিজাত্য না থাকলেও খেলার প্রতি আমাদের আগ্রহ ছিল প্রবল।
আজও মনের গহিনে কড়া নাড়ে নব্বই দশকের সেই ক্রিকেট খেলার আবেগঘন মুহূর্তগুলো। আমাদের মহল্লা ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায়, খেলার সময় আশপাশে কোনো বাড়ির ভেতরে বল ঢুকে যেত, কারও ঘরের টিনের চালে বল পড়ত, আবার কারও দরজা বা জানালায় বল বাড়ি খেত। এমনকি রাস্তা দিয়ে হাঁটা পথচারীদের শরীরেও বল লেগে যেত। এসব বিষয় নিয়ে চলত নানা রকমের তর্কবিতর্ক; এমনকি বাড়িতে অভিযোগও হতো। কখনো কখনো আমাদের প্রতিবেশীরা মহল্লায় খেলতে দেখলে লাঠি নিয়ে তাড়া করত, আমরাও দৌড়ে চলে যেতাম অন্য জায়গায়। এত কিছুর পরও কিন্তু আমরা মহল্লায় ক্রিকেট খেলেছি। কারণ, ক্রিকেট ছিল আমাদের আবেগ ও ভালোবাসার প্রতীক। আর সূর্য অস্ত যাওয়ার আগমুহূর্তে খেলা শেষ না হতেই মায়ের হাঁকডাক শুরু হয়ে যেত, কিন্তু আমরা বারবার আবদার করতাম, ‘আর একটা ওভার, শুধু একটা ওভার!’ আহা! সেই সময়ের সোনালি দিনগুলো আজও স্মৃতিতে অমলিন হয়ে আছে।
ক্রিকেট ছাড়াও নব্বইয়ের দশকে আমাদের জন্য ছিল আরও হরেক রকমের আনন্দময় খেলাধুলা। বাড়ির উঠোনে বা স্কুলের মাঠে চলত গোল্লাছুট, কুতকুত (এক্কাদোক্কা), ডাংগুলি, দাঁড়িয়াবান্ধা, লুকোচুরি, চশমাচোর আর চোর-পুলিশ। এসবের মধ্যে মার্বেল ছিল আরও একটি দারুণ জনপ্রিয় খেলা। মার্বেল নিয়ে আমার একটি স্মৃতি আজও স্পষ্ট মনে পড়ে গেল।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমার মেজ মামা যখন আমাদের বাসায় বেড়াতে এসেছিলেন, তখন তাঁর বয়স ১৫-১৭ বছর ছুঁই ছুঁই হবে। মামা ১০ টাকার মার্বেল কিনে আমাদের গ্রামের এক সিনিয়র ভাই, যার নাম রাজু, তার সঙ্গে খেলতে নামেন। রাজু ভাই তার সব মার্বেল মামার কাছে হেরে যান। তখন মামা মার্বেলগুলো মাটির ব্যাংকে আমার জন্য রেখে দিয়ে কয়েক দিন পর বাসায় চলে যান। এরপর আমি মার্বেলগুলো বের করে রাজু ভাইয়ের সঙ্গেই খেলতে শুরু করি। আমি তার সঙ্গে খেলে সব মার্বেল হেরে যাই।
আমার সব মার্বেল রাজু ভাই জেতার পর আমি কাঁদতে শুরু করি। কান্না দেখে আমি যেন বাসায় বিচার না দিই, সেই ভয়ে রাজু ভাই সব মার্বেল আবার আমাকে ফেরত দিয়ে দেন। আমি পরের দিন আবার তাকে খেলার প্রস্তাব দিলে সে বলে, ‘তুই হারলে তো কান্না করিস, তোর সঙ্গে খেলব না।’ আমি প্রতিজ্ঞা করি, ‘আর কান্না করব না।’ কিন্তু খেলায় আবারও হেরে যাই। প্রথম দিনের মতো আবারও কান্না করলে, ভাই ভয়ে আমাকে সব মার্বেল ফেরত দিয়ে দেন। এভাবে কিছুদিন চলতে থাকে। তবে একদিন আমি ভুল বুঝতে পারি যে হেরে গেলে মার্বেলগুলো রাজু ভাইকে দিতে হবে, তখন আমি তা দিয়ে দিই। রাজু ভাইয়ের সঙ্গে এত সুন্দর একটা মুহূর্ত আমার ছিল, অথচ তার সঙ্গে বহুদিন দেখা হয় না, কথাও হয় না। কারণ, আগে আমরা যে মহল্লায় ছিলাম, সেখান থেকে প্রায় ২৫ বছর হলো আমরা চলে এসেছি। ছোট ছোট এই জিনিসগুলোই আমাদের কাছে ছিল জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
নব্বইয়ের দশকে ক্রীড়াঙ্গনের স্মৃতি ছিল শুধুই বিশ্বকাপ ফুটবল বা ক্রিকেটের উচ্ছল উদ্দীপনা। তখন পল্লিগ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি, তাই ব্যাটারির সহায়তায় সাদা-কালো পর্দায় বা প্রধান মোড়ে বৃহৎ স্ক্রিনে খেলা দেখার জন্য একদিন আগে থেকেই গ্রামবাসীদের কাছে অর্থ সংগ্রহ করা হতো। প্রিয় দলের পতাকা বানানো, আর প্রতিবেশীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে খেলা দেখা এবং মুড়ি-চানাচুর মাখিয়ে ভাগ করে খাওয়ার সেই প্রাণবন্ত দৃশ্যগুলো এখনো হৃদয়ের গভীরে মুদ্রিত। যন্ত্রনির্ভর এই যুগেও, সবুজ মাঠে সেই নিষ্ফলা সময় যাপন, বন্ধুদের সঙ্গে অন্তরঙ্গ আলোচনা, উষ্ণ দিনের শেষে গোধূলিবেলায় ফড়িং ধরা এবং সন্ধ্যার নিস্তব্ধতায় জোনাকি পোকার অবিরাম ডাক ও তাদের হাতের মুঠোয় পুরে খেলার যে অনুভূতি, তা আজও মনকে মুগ্ধ করে।
এই প্রযুক্তিনির্ভর সময়ে জীবনের সেই সরল খেলাধুলা যেন আজ বিলীন। শিশুরা এখন ঘরে আবদ্ধ। সারা দিন স্কুল আর প্রাইভেট নিয়ে তারা যেন ভারাক্রান্ত, তার ওপর অবসর সময়ে মাঠে খেলতে না গিয়ে ফোন বা টিভির স্ক্রিনে ডুবে থাকা তাদের মানসিক বিকাশকে ব্যাহত করছে। আমি যখনই নব্বইয়ের দশকের কথা ভাবি, তখনই মনের গভীরে ভেসে ওঠে সেই পাড়ার মাঠ, স্কুলমাঠে বন্ধুদের সঙ্গে প্রাণোচ্ছল আড্ডা, ধুলোর গন্ধমাখা খেলাধুলোর স্মৃতি আর নিষ্কলুষ শৈশবের সেই স্বর্ণালি অধ্যায়। এই স্মৃতিগুলোই আমাদের সেই নব্বইয়ের দশকটিকে এক আনন্দময় অধ্যায় হিসেবে মনে করিয়ে দেয়, যা প্রতিটি নব্বই দশকের শিশুর স্মৃতির মণিকোঠায় চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
* লেখক: মো. আজাদ হোসেন, শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ, ঢাকা