স্মৃতিপটে গড়াই নদ

১২ নভেম্বর ২০২৫। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগের ২০২২–২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের এক বিশেষ দিন। অন্যান্য দিনের মতো ভোরের ঠান্ডা হাওয়া, সকালের মিষ্টি সূর্যের আলো ও স্নিগ্ধ এক পরিবেশ। তবে এসবের প্রতিটিই যেন ভিন্ন সমাচারের জানান দিচ্ছে। তা হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক জীবনের অর্ধসময়ের পরিসমাপ্তি। ওই দিন বিভাগের ভাইভা অনুষ্ঠিত হ‌ওয়ার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে চতুর্থ সেমিস্টারের পরিসমাপ্তি। ব্যাচের সবার মনেই কিছুটা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও প্রশান্তি—মিশ্র অনুভূতি। যথারীতি ভাইভা অনুষ্ঠিত হলো বিভাগের মোট ২২ জন শিক্ষার্থীর। একে একে সবাই সফলভাবে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করল। তখন সকাল গড়িয়ে বেলা তিনটা ছুঁই ছুঁই। বিশেষ এই দিনকে আরও প্রাণোচ্ছ্বল করে তুলতে শুরু হলো ব্যাচের সবার ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা। প্রথমেই আলোচনা হলো ঝিনাইদহ নাকি কুষ্টিয়ায় ঘুরতে যাব। কোথায় গেলে আমাদের দীর্ঘ পরীক্ষা–উত্তর ক্লান্তি থেকে মনকে প্রশান্ত করা যায়। নানাজনের নানা মতামত গ্রহণের পর ঠিক হলো ঐতিহ্যবাহী কুষ্টিয়া শহর ঘেঁষে বয়ে চলা গড়াই নদে ঘুরতে যাওয়া‌।

পরে দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর বিকেল চারটায় ক্যাম্পাসের ডাবল ডেকার বাসে চেপে কেউ সিটে বসে, কেউবা দাঁড়িয়ে গন্তব্য স্থলে র‌ওনা হলাম। মন্থরগতিতে ছুটে চলা বাসে হিমেল বাতাসের ঝাপটায় মুখ পেতে কেউ আনমনা, কেউবা নিজের ক্লান্তিকে নিরাময়ের চেষ্টা। এ সময় সবাই গানের তালে মেতে উঠল। এ যেন ভিন্ন আবেগময় পরিবেশ। কথাটি আবারও স্মরণ করিয়ে দেয়—গান মনকে করে তুলে সতেজ, প্রাণোচ্ছ্বল, উদাস ও আবেগময়। এভাবে দীর্ঘ এক ঘণ্টা যাত্রার পর অবশেষে দেখা মিলল বিখ্যাত সেই গড়াই নদের। যে নদ অসংখ্য কবির সোনার কাঠিতে স্থান করে নিয়েছে কাব্যগ্রন্থে। যেই নদ এঁকেবেঁকে ছুটে চলা, প্রতিটি ঢেউ, দুই পাশে গড়ে ওঠা জনপদকে সমৃদ্ধকরণ, ঐতিহ্য, গ্রামীণ পরিবেশে সরল মানুষের জীবনযাপনসহ প্রভৃতি ভূমিকা পালন করছে। আর এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ ‘গড়াই নদীর তীরে’ পল্লিকবি জসীমউদ্‌দীনের বিখ্যাত কবিতা।

গড়াই নদকে আর‌ও কাছ থেকে উপভোগ করতে একটি ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভাড়া করা হলো। সবাই তাতে চেপে বসলাম। শুরু হলো নদীর প্রবাহের সঙ্গে মানুষের মনের মেলবন্ধনের যোগ সাদৃশ্যের খেলা। নৌকাটি ছুটে চলল নদীর মৃদু বাতাসকে ভেদ করে। এ সময় কেউ ব্যস্ত নিজেকে ফটোবন্দী ও আড্ডায়, কেউবা প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে। নদীর বুক চিরে ছুটে চলতে থাকা দুই পাশের সবুজায়ন, সারি সারি উঁচু–নিচু গাছ যেন পর্বতমালার এক প্রতিচ্ছবি, যা দূরে দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে প্রকৃতির রক্ষক হিসেবে। এক‌ই সঙ্গে নদীর শান্ত ঢেউয়ে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যের লাল রক্তিমার প্রতিফলন যেন রাতের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। অন্যদিকে দিনের কর্মব্যস্ততার শেষে সাম্পান নৌকায় নিজ গন্তব্য ছুটে চলার দৃশ্য। এ যেন যান্ত্রিক বিশ্বে এক ফোঁটা চিরায়ত বাঙালির জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। প্রতিটি দৃশ্য পরম মমতায় পরখ করে ভাববার চেষ্টা করি, কী ছিল প্রাচীন গ্রামবাংলার মানুষের জীবন চলা, কীভাবে অতিবাহিত হতো তাঁদের প্রতিটি সময়? আর‌ও একটু গভীরে গিয়ে ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে ভাবি, ‌এই নদীর কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে, যা কবির সোনার কাঠিতে কবিতা রচনার বিষয়বস্তু হয়েছিল।

এভাবে ভাবতে ভাবতে তীরের অভিমুখে আমাদের নৌকা। তখন সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো। নদী ভ্রমণ শেষে আবারও চিরচেনা সেই ক্যাম্পাসে ফেরার পালা। সারা দিনের এই স্মৃতি যেন এক ভিন্ন বার্তা দেয়। কীভাবে প্রকৃতিকে লেখকেরা লেখনীর মাধ্যমে প্রতিটি বস্তুকে জীবন্ত করে তুলে ছিলেন। যা তাঁদের টুকরো টুকরো চিন্তা থেকে সাহিত্যে স্থান পাওয়া নানা কর্মের ফল। আর গড়াই যেন তার‌ই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

*লেখক: আবু বকর, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]