এ জাগরণ যেন বৃথা না যায়
কোনো পুঁথিগত বিদ্যা কিংবা কোনো পাঠ্যক্রম থেকে আসেনি এ জাগরণ, আসেনি কোনো সভ্য সমাজের তথাকথিত সমাজসেবকদের গবেষণাপত্র থেকেও। এ জাগরণ কোনো গিরগিটিরূপী মুনাফাভোগী বিত্তশালী ব্যবসায়ী শ্রেণি থেকেও আসেনি কিংবা কোনো জাতি বিভক্তকারী স্বর্গলোভী বিশেষ ধর্মীয় গোষ্ঠী থেকেও নয়। এটা হলো শোষণ আর নিপীড়নের অনলে পোড়া ছাইরূপী জাতির সর্বশেষ ও সর্বকনিষ্ঠ স্ফুলিঙ্গ, যার ঝলকানিতে আজকের বিপ্লবরূপী এ জাগরণ। এ জাতি অন্যায়ের কাছে এতটাই নিষ্পেষিত হয়ে পড়েছিল যে স্বাধিকার আর অধিকারের সংজ্ঞাটাই তার কাছে ছিল অস্পষ্ট।
প্রতিদিন খবরের কাগজের শিরোনাম হয় ঢাকা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে বসবাস উপযোগী শহরগুলোর তালিকায়। আবার কখনো সর্বোচ্চ দূষিত শহরগুলোর তালিকায় প্রথম অবস্থানে আছে। এ ছাড়া রয়েছে লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতি, ধমনি থেকে শিরা অবধি প্রবাহিত দুর্নীতি, কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার, ধনী–গরিবের বৈষম্য, ধারকৃত বৈদেশিক সাহায্যে উন্নয়নের নামে ঋণের বোঝা, প্রহসনের নির্বাচন সাজিয়ে জনসাধারণকে ধোঁকা দিয়ে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িতকরণ, পক্ষপাতমূলক বিচারব্যবস্থা ইত্যাদি। ওপরে উল্লিখিত প্রতিটি ঘটনাই আমাদের জানা, আমাদের মৌলিক অধিকারগুলো হারানোতেই আজ আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। আমরা শুধু ভৌগোলিকভাবেই স্বাধীন হয়েছি, আমাদের দুই পা পরাধীনতা আর দাসত্বের শিকলে বাঁধা। শোষণের মাত্রা যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা এই সদ্য বিদায়ী সরকার বুঝিয়ে দিয়েছিল। তারা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়েছে। অথচ এটি ছিল জাতির সর্বস্তরের জনসাধারণের প্রস্তাবিত একটি দাবি। ইতিহাসে উল্লিখিত স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থাকে নতুনরূপে সংজ্ঞায়িত করেছেন বাংলাদেশের সদ্য পতন হওয়া শাসকেরা।
পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষী, শাসকের শাসন যখন শোষণে পরিণত হয়; পরাধীনতার শিকল পায়ে বেঁধে, কণ্ঠকে রোধ করে, দৃষ্টিশক্তিকে হরণ করে যখন তারা স্বাধীনতাকে উপভোগ করতে বলে তখন বুঝে নিতে হবে জনসাধারণ তাদের সমস্ত অধিকার হারিয়ে নিষ্পেষিত। আর সেখানেই জন্ম নেয় বিপ্লব ও গণজাগরণ। আমরা শুনেছি ফরাসি বিপ্লবের কথা। ফরাসি বিপ্লব ছিল ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা মূলত সংগঠিত হয়েছিল ফরাসি জনগণের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক বৈষম্যের কারণে। মূলত বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সের পুরোনো সমাজকাঠামোর ভিত ধসে যায়। চিন্তাচেতনার ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক ধারা সূচিত হয়। এ বিপ্লবের আদর্শ ছিল সাম্য, স্বাধীনতা ও মৈত্রী। ফরাসি বিপ্লব হলো স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র এবং অভিজাত ও যাজক সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে নির্যাতিত, অধিকারবঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের এক সশস্ত্র সংগ্রামের স্বর্ণালি ইতিহাস। একইভাবে আমরা শুনেছি ইরানের বিপ্লবের কথা, যেটা ইরানকে শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভির একনায়কতন্ত্র থেকে আয়াতুল্লা আলী খামেনির ইসলামিক গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত করে। যার মাধ্যমে ইরানের আড়াই হাজার বছরের পুরোনো রাজতন্ত্রের বিলুপ্তি ঘটে।
আজ বাংলাদেশও এই বিপ্লবী জাগরণের চরম সাক্ষী, যে দেশ ৫৪ বছর যাবৎ নিজেদের স্বাধীনতাকে খুঁজছে। অত্যাচার আর নিপীড়নে নিষ্পেষিত ও কোণঠাসা এ জাতির নিজেদের অধিকারের সর্বস্ব হারিয়ে আবার জেগে উঠেছে তরুণ প্রজন্মের ছাত্রছাত্রীদের এক গণজাগরণের মধ্য দিয়ে। দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ আজ আবার স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের পূর্ণাঙ্গ স্বাদ গ্রহণের লক্ষ্যে বুক বাঁধতে চায়।
তবু কেন যেন ভয় হয়, আজকের এই জাগরণের আদর্শ ধরে রাখতে পারব তো? কারণ, বহু জাগরণে এ জাতি আন্দোলনের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছিল তাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক পটভূমি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই সব জাগরণের আদর্শের বিচ্যুতি ঘটেছিল। ১৯৬৯ সালে গণ–অভ্যুত্থানে আমরা শিশু স্কুলছাত্র মতিউরকে হারিয়েছি, ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদের বিনিময়ে এ দেশকে স্বাধীন করেছি, ১৯৮৭ সালে নূর হোসেনকে মরতে দেখেছি পুলিশের গুলি খেয়ে। অবশেষে ১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী সরকার এরশাদের পতন হয় গণ–আন্দোলনের মুখে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, প্রতিটি আন্দোলনেই যে মর্মকথাকে বুকে লালন করে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিতেও পিছপা হয়নি যে জাতি, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক নৈতিকতা বিসর্জন, স্বেচ্ছাচারিতা, ক্ষমতা দীর্ঘায়িতকরণের অপচেষ্টা সেই জাতির সাধারণ মানুষকে শিকলবন্দি করে রেখেছে, স্বাধীনতার পূর্ণ স্বাদ কখনোই নিতে দেয়নি। বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ ধরে দেশের নিরীহ ও নিপীড়িত মানুষের নীরবতাকে পুঁজি করে শাসকশ্রেণির স্বৈরাচারী মনোভাব এতটাই হিংস্র হয়ে উঠেছিল যে তাদের মতামতবিরোধী কোনো প্রতিবাদকেই মেনে নিতে পারেনি তারা। তাই তো আমাদের চোখের সামনে আবু সাঈদ কিংবা মুগ্ধর মতো শতসহস্র তাজা প্রাণ কেড়ে নিতেও অন্তর কাঁপেনি তাদের। আমার ভাইদের প্রাণের বিসর্জনে অর্জিত আজকের এ গণজাগরণ, যা দেশবাসীর বিবেকবোধকে জাগ্রত করেছে, এ জাগরণকে আমরা কখনোই বৃথা যেতে দিতে পারি না। জাগরণের আদর্শগুলোকে জনমনে গেঁথে দিতে কিছু টেকসই স্থিতিশীল এবং সুদূরপ্রসারী সংস্কারমূলক কার্যনির্বাহ জরুরি।
অর্থনৈতিক অসমতা দূরীকরণ
নতুন বাংলাদেশ তৈরীকরণে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নতুন উদ্যোক্তাদের ব্যাপক আকারে অংশগ্রহণ প্রকল্পে সব ধরনের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে সহায়তা প্রদান আবশ্যক। ঘুষ ও দুর্নীতিকে না বলুন—এ স্লোগানে সমাজ, দেশ ও জাতিকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিমাণ প্রাতিষ্ঠানিক প্রচার–প্রচারণা প্রয়োজন। সব ধরনের রাষ্ট্রীয় সেবাগুলোকে ব্যক্তিস্বার্থ থেকে মুক্ত করতে হবে, যাতে বিশেষ কোনো ব্যক্তি কোনো বিশেষ সুবিধা না নিয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ, একজন পুলিশের সঙ্গে তার জনসাধারণের সেবার বিনিময় হবে শুধু তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিচারালয়গুলোকে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দর্শনের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ, শিক্ষা ও বিচার সর্বজনীন, কোনো নির্দিষ্ট মতাদর্শে বিভক্ত করার ফলে তার সর্বজনগ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়। শিক্ষাব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থাকে দলীয়করণ ও পরাধীন রেখে কোনো বিশেষ ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল ছাড়া কোনো সামষ্টিক জনগোষ্ঠীর সুফল বয়ে আনা সম্ভব নয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি পাঠ্যক্রম কারিকুলাম ও তার শিক্ষাপদ্ধতিকে ইতিহাস ও প্রকৃত দেশপ্রেমের আদলে ঢেলে সাজাতে হবে। শিক্ষা নীতিমালা হবে উদ্যোক্তাবান্ধব। আমাদের প্রত্যেক ছাত্রছাত্রী যেন স্নাতকোত্তর শেষে উদ্যোক্তা হওয়ার মতো সাহস এবং রঙিন স্বপ্ন নিয়ে বের হতে পারে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ থেকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। হোক সেটা আইটি কিংবা কৃষি কিংবা ক্ষুদ্র–মাঝারি ব্যবসার মতো ক্ষেত্র।
শুধু কোটাপদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমে মেধার সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না কর্মসংস্থানে অর্থের বিনিময় পুরোপুরি রোধ করা যাবে। এখানে প্রাথমিক স্কুলের একজন শিক্ষককেও ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি নিশ্চিত করা হয়। অথচ সেখানেই কিনা আমার দেশের শিশুকে অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আদর্শলিপি শেখানো হয়। প্রজাতন্ত্রের প্রতিটি নিয়োগপদ্ধতিকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির আওতায় প্রতিষ্ঠিত করা না গেলে যোগ্যতার মূল্যায়ন এবং যোগ্য ব্যক্তির প্রতিস্থাপন অসম্ভব।
দেশে প্রকৃত গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, যা হবে প্রকৃত অর্থে জনগণের সরকার। যারা রাষ্ট্রের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত হবে এবং তাদের জন্যই কাজ করবে। জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য দক্ষ নির্বাচন কমিশন গড়ে তুলতে হবে। নির্বাচনী প্রার্থী বাছাইকরণে নির্বাচন কমিশনকে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থী কোনো প্রকার ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না। রাজনীতিতে বয়সসীমা নির্ধারণ করতে হবে। একটানা দুইবারের বেশি রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্বে থাকা যাবে না। নির্বাচনী ইশতেহারকে জনগণের কাছে পরিপূর্ণভাবে পৌঁছে দিতে হবে।
প্রকৃত অর্থে বৈষম্যবিহীন একটি সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে; যার মর্মকথা শুধু কাগজে–কলমে নয়, বিবেকে ধারণ করতে হবে।
**নাগরিক সংবাদে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]