পাতাঝরার দিনে একচিলতে ভালো লাগা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চারদিকে বাগানবিলাস ফুল আজ কদিন থেকেই চোখে পড়ছে। এখন সময়টা বসন্তের শেষ। আর কয়দিন পর গ্রীষ্মকাল। নতুন সবুজ কচিপাতা আসবে। তার আগে শহরজুড়ে পাতাঝরার দিন চলছে। সারা দিন কাজের ফাঁকে ফাঁকেই হাওয়ার মধ্যে পাতাঝরা দেখছি। এত যে কর্মব্যস্ততা, এত যে জীবনের প্রাপ্তির জন্য ছোটাছুটি, তবু ঝরা পাতা চোখে পড়ে। লাল, গাঢ় লাল, সাদা, হলুদ, রানি রঙের অনেক বাগানবিলাস ফুটেছে শহরের আনাচকানাচে। শহরের গৃহকর্তা-গৃহকত্রীরা কি আজকাল সযত্নে বাগানবিলাস লাগাচ্ছেন? তা না হলে এই ইটপাথরের শহরে দেয়ালের ফাঁক গলিয়ে, বারান্দার রেলিং ঝুলে বাগানবিলাস তো ফুটত না!

কয়েক দিন আগে এক দুপুরে অনেক দিন পর রিকশায় উঠলাম। বাংলা মোটর ও মগবাজারের মাঝামাঝি একটা জায়গা থেকে বেইলি রোডে যাচ্ছি। রিকশাচালক বললেন, ‘মা, কোনো চিন্তা কইরেন না, আমি আপনাকে বেইলি রোড পৌঁছে দিব।’ মগবাজার চৌরাস্তার মোড় পার হবার পরই রিকশাচালক রিকশাটি হাতের বাঁ পাশের একটা গলিতে ঢোকালেন। আদ্‌–দ্বীন হাসপাতালের গলি।

আমি অবাক বিস্ময়ে রিকশাচালককে বললাম, ‘এদিক দিয়ে যাবেন?’

রিকশাচালক বললেন, ‘ওই সোজা পথে আজকাল আর যাওয়া যায় না। ট্রাফিক পুলিশ ধরবে। আপনি চিন্তা কইরেন না, আমি আপনাকে নিয়ে যাব।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চালকের বিনয় ও সম্ভাষণে আমি অত্যন্ত আশ্বস্ত হয়ে আদ্‌–দ্বীন হাসপাতালের ভবনটি দেখা শুরু করলাম। আদ্‌–দ্বীন হাসপাতাল আকিজ গ্রুপের, আমার জানা ছিল। কিন্তু এ পথে অনেক দিন আমার আসা হয়নি। হাসপাতালের এত ব্যাপকতা সম্পর্কে আমার ধারণা ছিল না। হাসপাতালটি বেশ কয়েকটি ভবন নিয়ে ব্যাপ্ত। অসংখ্য লোকের আনাগোনা। আমার মনে হলো, এখানে অসংখ্য মানুষ চিকিৎসাসেবা প্রদানে নিয়োজিত এবং অসংখ্য মানুষ চিকিৎসা গ্রহণের জন্য আসছেন। কজনই পারে দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে?

রিকশাটা এক গলি থেকে আরেক গলি চলে যাচ্ছে দ্রুত। সেই আশির দশকের একতলা, দোতলা, তিনতলা বাড়িগুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেল! নতুন নতুন উঁচু সব ভবন। ভবনের চূড়া আমি আর রিকশা থেকে দেখতে পাচ্ছি না। নেই গাছপালা ঘেরা বারান্দায় অপেক্ষারত কোনো মায়ের দৃশ্য। আকাশ ঠেকে গেছে। নেই শিশুর কলকাকলিতে পূর্ণ একতলা বাড়ির সম্মুখভাগ। হঠাৎ মনে হলো, আমি এ কোন পথ দিয়ে যাচ্ছি! এখানে ৪০ বছর আগে প্রায়ই আসতাম। তখন তো এমন ছিল না! শহরটা কেমন পাল্টে যাচ্ছে। এ আমার চেনা শহর নয়।

হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিল একটা সাইনবোর্ড। সেখানে লেখা ‘কাজি অফিস’। আশির দশকেও নওরতন কলোনির পেছনে কাজি অফিসের একটি বাড়ি ছিল। সেই বাড়িটির কাছে এশিয়াটিকের মার্কেট রিসার্চ অফিসে আমরা ছাত্র অবস্থায় জরিপের কাজের জন্য আসতাম। তখন বেইলি রোড এলাকাটি একটি সত্যিকার অর্থেই নান্দনিক আবাসিক এলাকা ছিল। মাঝেমধ্যেই কিছু বেসরকারি অফিস, মহিলা সমিতির ভবন ও গাইড হাউস ছাড়া ছিল কিছু ছোট দোকানপাট। বিকেল থেকে নাট্যকর্মী ও তরুণ–তরুণীদের আড্ডা বসত। আজ অসংখ্য উঁচু তলা ভবন আর দোকানে দোকানে মুখরিত উপর্যুপরি কোলাহল। এত কিছুর মধ্যে আমি অনেক দিনের চেনা, খুবই পরিচিত রাস্তাটাই হারিয়ে ফেলছি। চালককে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘পথটা ঠিক আছে তো?’ তিনি বললেন, ‘আপনি চিন্তা কইরেন না, আমি ঠিক পথেই আসছি।’

তখনই চোখে পড়ল সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের সাইনবোর্ড। আমার পুরো হৃদয় তোলপার হয়ে উঠল। ৪০ বছর আগে, এই পথে একাধিকবার বন্ধুদের সঙ্গে রিকশায় এসেছি। আজও চোখে ভাসে সেদিনের পুরো আকাশ মনজুড়ে যে সবুজ ছিল, তা যেন এক মুগ্ধকর সবুজ দিন। চোখে পড়ল হাজারও ব্যস্ততার মধ্যে পত্রবিহীন একটি বাগানবিলাস রানি রঙের ফুল ছড়িয়েছে পুরো শরীরে! শুধু তা–ই নয়, তার ফুল ঝরে পড়েছে রাজপথেও! পথিক মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। আমার রিকশা ধীরে ধীরে খুঁজে পেল সেই অসাধারণ নওরতন কলোনির পুকুরটি, যা আজ বহুতল বাড়িদ্বারা আবদ্ধ।

নাজনীন হক মিমি, গুলশান, ঢাকা