প্রথম আলোর সঙ্গে যতটা পথ পেরোলাম
তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। পরিবারের সঙ্গে গ্রাম ছেড়ে শহরে চলে আসতে হলো। ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে শহরের স্কুলে পড়লেও বন্ধুদের সঙ্গে অতটা সখ্য ছিল না। সখ্য ছিল পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে। যাদের বেশির ভাগ পড়ত ভিন্ন স্কুলে। ফলে শহরে আসায় একেবারে একা হয়ে যায়। কোনো কিছুতে মন বসে না। স্কুলে যায়, পড়তে যায় আর বাকি সময় মন খারাপ করে কাটায়। এর মধ্যে একদিন একটা পত্রিকা নিয়ে এলেন, বাবা। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খুঁটে খুঁটে পড়লাম। প্রতিদিন একটা পত্রিকা পেলে সময় কেটে যাবে ভাবলেও গ্রাম ছেড়ে উপজেলা শহরে শিফড হওয়ায় বাড়িভাড়া যোগ হওয়াসহ যাবতীয় খরচ বেড়ে গেছে, বললে মা রাগ করতে পারেন, ভেবে নিজেকে সামলে নিই। তারপর ঠিক কী মনে করে যে মাকে বলেছিলাম, ‘মা, বাবাকে বলবে এই পত্রিকাটা রোজ নিতে? পড়ব। তাহলে ভালো সময় কাটবে।’ ঠিক মনে করতে পারছি না। তবে কথাটা শুনে রাগ করা তো দূর উপরন্তু একগাল হাসি ছড়িয়ে মা বলেছিলেন, ‘তোর পড়ার জন্যই তো বাবা এনেছেন। কাল থেকে হকার আঙ্কেল রোজ একটা করে পত্রিকা দেবে। তবে কাল আর এইটা দেবে না, পরপর কয়েক দিন ভিন্ন ভিন্ন পত্রিকা দেবে। পড়ে দেখ, যেটা ভালো লাগে সেটা রোজ নেব।’ জবাবে বলেছিলাম, ‘আর দেখতে হবে না, তুমি এটিই দিতে বলো।’ সেদিন থেকেই নিয়মিত পত্রিকা পড়া শুরু, প্রথম আলো পড়া শুরু।
সময়ের হিসাবে অনেকগুলো বছর অতিবাহিত হয়েছে। স্কুল, কলেজ শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের আনুষ্ঠানিক লেখাপড়া শেষের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছি। আর এই সময়টাতে প্রথম আলো নিয়মিত আমার সঙ্গে ছিল। এমন খুব কম দিনই গেছে যেদিন প্রথম আলো পড়িনি। অনেকেই জিজ্ঞেস করেন দীর্ঘ সময় ধরে নিয়মিত প্রথম আলো কেন পড়ছি? শুরুর দিনে প্রথম আলো কেন ভালো লেগেছিল, তা স্পষ্ট মনে নেই। তবে বোধ হওয়ার পর থেকে, মানে বলতে চাইছি আলো-আঁধারের খেলা, ভালো-খারাপ, সত্য-মিথ্যা বুঝতে শেখার পর থেকে আজ পর্যন্ত পড়ার কারণ বলতে হলে বলব বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনের জন্য। বোধ করি কেবল এই একটি কারণেই যেকোনো সংবাদের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অসংখ্য পাঠকের মতো আমিও প্রথম আলোর দিকে চেয়ে থাকি।
দিন বদলেছে, বিশ্বায়নের যুগে সংবাদমাধ্যমেও এসেছে আধুনিকতা। সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে যেকোনো ঘটনা মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর এ ক্ষেত্রেও অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে প্রথম আলো। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকতায় রাঙিয়েছে নিজেকে। প্রথম আলো ডট কম আজ বহুল পঠিত ও সমৃদ্ধ একটি ওয়েবসাইট। যা নিয়মিত পত্রিকা পড়ার পথকে সহজ করেছে। আগে কোথাও ঘুরতে গেলে প্রথম আলো খুঁজে নিয়ে পড়তে হতো। আজ আর সেই অবকাশ নেই, ই-পেপার থেকে সহজে পড়ে নেওয়া যায়।
প্রতিদিনের প্রথম আলোর প্রায় সব পাতাতেই কমবেশি চোখ পড়ে। যদিও এ ক্ষেত্রে পারিপার্শ্বিক ঘটনা তথা সময় একটা বড় ভূমিকা রাখে। যেমন ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা যখন চলে তখন বেশি আকর্ষণ কাজ করে খেলার পাতা নিয়ে। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি ভালো লাগা থাকায় শুক্রবারের সাহিত্যপাতা নিয়েও আগ্রহ কাজ করে। এর বাইরে মতামত, আন্তর্জাতিক, অর্থনীতি, বাণিজ্য, বিনোদন, পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, শিক্ষাবিষয়ক খবরও ভালো লাগে। মনোযোগের সঙ্গে পড়ি। ফিচার প্রসঙ্গে বলতে হলে একটা কথায় বলব, ফিচার বরাবরই আমাকে আকর্ষণ করে। বর্তমানে প্রকাশিত শনিবারের ‘ছুটির দিনে’, মঙ্গলবারের ‘অধুনা’, রোববারের ‘স্বপ্ন নিয়ে’সহ জীবযাপন বিভাগে প্রকাশিত প্রায় সব প্রতিবেদন মুগ্ধতা নিয়ে পড়ি। প্রথম আলো মানুষের কথা বলে। দেশের আনাচকানাচে আলো ছড়ানো হার না–মানা আলোকিত মানুষের গল্প তুলে ধরে। যা নতুন কিছু করতে, ঘুরে দাঁড়াতে ও স্বপ্ন দেখতে সাহস জোগায়।
প্রথম আলো বন্ধুসভার বন্ধু
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের পড়ালেখা শুরুর পরপর প্রায় কথাটা কানে এসে বিঁধত। কেবল পড়ালেখা করলে হবে না, দক্ষতা বাড়াতে হবে। কিন্তু কীভাবে কী করি? শেষমেশ পরিচিতদের কয়েকজন পরামর্শ দিলেন ছয় মাসের একটি কম্পিউটার কোর্স করার। চাকরির ক্ষেত্রে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ সার্টিফিকেটের ভূমিকা আছে। প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে কম্পিউটার কোর্সে যুক্ত হই। প্রথম বর্ষের পড়ালেখা শেষ হওয়ার কাছাকাছি সময়ে কোর্সটাও শেষ হয়ে যায়। দ্বিতীয় বর্ষের শুরুতে একটা গিটার কিনে শিখতে শুরু করি। কলেজজীবনে হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান গাওয়া শিখেছিলাম। যে কারণে সাবলীলভাবে বাজাতে না পারলেও গান গাওয়ার উপযোগী গিটার বাজানো শিখতে বেগ পেতে হয়নি। দ্রুত শিখে যাই। তৃতীয় বর্ষে উঠতে না উঠতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সব বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ি চলে আসি। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে যশোরে ফিরে পুনরায় পড়ালেখা ও টিউশন শুরু করি।
একটি সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে যোগ দেওয়া উচিত। ভাবনা থেকে প্রথম আলো বন্ধুসভা, যশোরে যোগ দিই। পাঠচক্র সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সর্বশেষ সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বন্ধুসভায় দায়িত্ব পালনের সৌভাগ্য হয়েছে। ‘একটি করে ভালো কাজ’, মাসিক পাঠচক্র, সহমর্মিতার ঈদ, জিপিএ–৫ কৃতী সংবর্ধনা, গণিত অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স অলিম্পিয়াড, প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীসহ নানা আয়োজনে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেছি। গান, আবৃত্তির মতো গুণগুলো বন্ধুসভায় যুক্ত হওয়ায় মানুষের সামনে উপস্থাপন করা সহজ হয়েছে। এ ছাড়া স্কুল ও কলেজজীবনে ফেলে আসা সঞ্চালনার গুণটিকেও বন্ধুসভা পুনর্জীবন দিয়েছে। বন্ধুসভা ও প্রথম আলোর প্রোগ্রামে সঞ্চালনা ভালো হওয়ায় স্থানীয় সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বড় বড় আয়োজনে সঞ্চালনা করার আমন্ত্রণ পেয়েছি। সঞ্চালনা করেছি। বন্ধুসভায় যুক্ত না হলে নিজের এ সুপ্ত গুণগুলোকে মানুষের সামনে তুলে ধরা কঠিন ছিল।
এ ছাড়া নেতৃত্ব? আমি যে অনেককে নিয়ে কাজ করতে পারি, টিম লিডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে ছোট–বড় প্রোগ্রাম সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারিÑএর প্রমাণও মিলেছে বন্ধুসভায় যুক্ত হওয়ায়। ‘গণিত অলিম্পিয়াড’, ‘ফিজিক্স অলিম্পিয়াড’ ও ‘জিপিএ–৫ কৃতি সংবর্ধনা’র মতো প্রথম আলোর আঞ্চলিক পর্যায়ের বড় আয়োজন প্রথম আলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে সংগঠনের সদস্যদের নিয়ে সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরে সমৃদ্ধ হয়েছি। আত্মবিশ্বাস বহুগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি মানুষের পাশে থাকা, ভালো কাজের সঙ্গে থাকা, শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে থাকা, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাকে হৃদয়ে ধারণ করার মতো বোধগুলো বন্ধুসভায় যুক্ত হওয়ায় দৃঢ় থেকে দৃঢ় হয়েছে। কথায় আছে অভিজ্ঞতাই সম্পদ; সাংগঠনিক দক্ষতা জীবনকে এগিয়ে দেয়, এগিয়ে নেয়। আমাকেও এগিয়ে নেবে নিশ্চয়ই।
প্রথম আলোর লেখক
লেখালেখি করার স্বপ্ন বা শখ কলেজজীবন পর্যন্ত আমার ছিল না। যদিও কলেজজীবনের শুরুর দিক থেকেই নিজের ভাবনাগুলোকে কবিতার মতো করে লিখতাম। আর এ অভ্যাসের কারণেই বোধ হয়, সম্মান প্রথম বর্ষের মাঝামাঝি সময়ে আস্ত একটা কবিতা লিখতে পেরেছিলাম। যা যশোর থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকে ছাপাও হয়েছিল। লেখালেখির শুরুটা ওই দিন হলেও আমি যে লিখতে চাই, লিখব এই দৃঢ়তার জন্ম তখনো হয়নি। ভালো লাগা আর ছাপার নাম কাগজে দেখার আগ্রহ থেকেই জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকা এবং প্রথম আলোর বন্ধুসভা ডট কমে লেখা পাঠানো শুরু করি। কিছু ছাপা হয়, কিছু ছাপা হয় না। এর মধ্যে করোনাভাইরাস এসে পড়ে। চার দেয়ালের ভেতর বন্দী হয়ে যাই। সময় কাটাতে বই পড়া, লেখালেখি, আবৃত্তি ও গানের ওপর জোর দিই। হঠাৎ একদিন ফেসবুকের নিউজফিড স্ক্রলিং করতে করতে প্রথম আলোর ফেসবুক পেজের একটি বিজ্ঞাপনে চোখ আটকে যায়। ‘বাবা দিবস উপলক্ষে “বাবা তোমাকে বলা হয়নি” শীর্ষক আয়োজনে গল্প আহ্বান করেছে প্রথম আলো ডট কম। সেরা দশ লেখার জন্য আছে পুরস্কার।’ বাবাকে নিয়ে গোটা একটা উপন্যাস লিখে ফেলা সম্ভব। লিখতে মন চাচ্ছে, কিন্তু গদ্য লেখার তো অভিজ্ঞতা নেই। তা ছাড়া গদ্য লেখা কঠিন। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ভাবতে হয়। শব্দবিন্যাস, বাক্য, ক্রিয়ার কালসহ নানা ব্যাপার। ইত্যাদি ভেবে লিখব কি লিখব না করতে করতে সকালে উঠেই গল্পটা লিখে ফেলি। বিজ্ঞপ্তিতে পাওয়া ই-মেইল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই। পুরস্কার পাওয়া তো দূর ভেবেছিলাম লেখা ছাপাও হবে না। কিন্তু দৈবক্রমে হোক আর লেখার গুণেই হোক লেখাটা প্রকাশিত হয় এবং নবম বিজয়ী হিসেবে নির্বাচিত হই। আরও চমৎকার ঘটে লেখার লিংকটা ফেসবুকে শেয়ার দেওয়ার পর। অভিনন্দন, শুভকামনা ও লেখার প্রশংসায় কমেন্ট সেকশন ভরে যায়। ওই দিনই সিদ্ধান্ত নিই। আমি লিখব, হোক না হোক লিখব।
সেই থেকে শুরু। ক্যালেন্ডারের হিসেবে গল্পটা প্রকাশিত হওয়ার দিন থেকে তিন বছরের এ লেখালেখির জার্নিতে ইতিমধ্যে দেশ ও দেশের বাইরের স্বনামধন্য পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে লেখার সৌভাগ্য হয়েছে। প্রথম আলোর অন্য আলো, জীবনযাপন, মতামত, বন্ধুসভা ডট কম ও নাগরিক সংবাদ বিভাগে লিখেছি, লিখছি। লেখালেখির জন্য বেশ কিছু পুরস্কারও প্রাপ্তি হয়েছে। সর্বশেষ প্রথম আলো বন্ধুসভা জাতীয় পরিচালনা পর্ষদ আয়োজিত ‘লেখক বন্ধু উৎসব-২৩’ আয়োজনে ২০২২-২৩ বছরের সেরা ১০ লেখকের একজন হয়ে পুরস্কার গ্রহণ করেছি। যেখানে সেরা দশের প্রথম নামটি ছিল আমার।
৪ নভেম্বর প্রথম আলো ২৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। প্রথম আলোর নিয়মিত পাঠক, বন্ধুসভার বন্ধু ও প্রথম আলোর লেখক হিসেবে প্রথম আলোর এ সফল পদচারণে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে প্রথম আলোর এ অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য হোক। প্রথম আলোর সঙ্গে আমার এ জার্নি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হোক। রবীন্দ্রনাথের গানে কণ্ঠ মিলিয়ে গেয়ে উঠি, ‘প্রথম আলোর চরণধ্বনি উঠল বেজে যেই, নীড়বিরাগী হৃদয় আমার উধাও হলো সেই।’
* লেখক: সৌমেন্দ্র গোস্বামী, কবি ও লেখক, কেশবপুর, যশোর